হদুয়ার পির সাহেব

Barisalpedia থেকে

হদুয়ার পীরসাহেব হযরত মাওলানা মোয়াজ্জেম হোসাইন (রহ.) ঝালকাঠি জেলাধীন নলছিটি থানার হদুয়া গ্রামের এক মশহুর ইসলামী সাধক। বলা হয় তিনি ৪১ বার পবিত্র হজ্জ পালন করেছিলেন।


জন্ম ও শিক্ষা

হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) জন্ম গ্রহণ করেছেন ঝালকাঠির নওয়াপাড়া গ্রামে। সম্ভবত উনবিংশ শতকের আশির দশকে। তাঁর পিতার নাম হেলাল উদ্দীন (রঃ) মাতার নাম কমলা বিবি। হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) সাহেবের পিতা হাজী হেলাল উদ্দিন সাহেব একজন অত্যন্ত পরহেজগার ও আবেদ মানুষ ছিলেন। তিনি তার সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে পবিত্র মক্কা শরীফে দু’পুত্রকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। মক্কা শরীফে এসে মহল্লা মেছফালা নামক স্থানে আবদুল মজিদ গিনার নামক এক ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয় এবং তার পরামর্শ এবং সহযোগিতায় একটি বাসা ভাড়া করে সেখানে অবস্থান নেন। দু’পুত্র এবং হেলাল উদ্দীন সাহেব ঐ বাসায় বসবাস করতে থাকেন।

হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) মক্কা শরীফে প্রথম জীবন থেকে ইলমে শরীয়ত ইলমে মারেফাত সম্পর্কে বিশেষ শিক্ষায় শিক্ষিত হন। তৎকালের যুগ শ্রেষ্ঠ পীর এবং বুজুর্গ বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হযরত আবদুল হক মোহাজেরে মক্কী (রঃ) এর সান্নিধ্য অর্জন করেন। মোয়াজ্জেম হোসাইন সাহেব দীর্ঘকাল (প্রায় ১৫ বছর) ইলমে শরীয়ত এবং মারেফাতে সম্পর্কে বিশেষ তালীম গ্রহণ করার পর তার নিকট থেকে চলে আসেন। এরপর মদীনা শরীফে নবী করীম (রঃ) এর রওজা জিয়ারতের জন্য যান। কথিত আছে যে হযরত মোয়াজ্জেম (রঃ) নবী করীম (সঃ) এর রওজা পাকে এবং মদীনার মসজিদে ১২/১৩ বছর পর্যন্ত ছিলেন।

দেশে প্রত্যাগমন

দীর্ঘকাল মক্কা ও মদীনায় ইবাদত বন্দেগীতে জীবনের বহুলাংশ ব্যয় করার পর হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) তার পীরের এজাজত প্রাপ্ত হয়ে নিজ দেশে আসার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। জানা গেছে পায়ে হেটে তিনি তার কন্যাকে নিয়ে সিরিয়ার পথে এসে জার্মান সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হন। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ চলছিল। জার্মান সৈন্যরা হযরত মোয়াজ্জেম (রঃ) কে গুপ্তচর ভেবেছিল। সিরিয়ার জেলখানায় তাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বন্দী করে রাখা হয়। তার মেয়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে নিখোজ হয়ে যায় সিরিয়া থেকে। জানা যায় হযরত মোয়াজ্জেম হোসেনের কন্যার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিলো পরবর্তিতে ভারতের মুম্বাইয়ে।

পরবর্তীতে প্রমাণিত হলো মোয়াজ্জেম হোসেন (রঃ) গুপ্তচর নন, বরং তিনি একজন মুসলিম আবেদ ব্যক্তি। সিরিয়ার বাদশার নির্দেশ মোতাবেক হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) কে শাহী দরবারে নিয়ে আসা হল। বাদশাহ জানলেন তিনি আবদুল হক মোহাজেরে মক্কী (রঃ) এর ঘনিষ্টতম শিষ্য। সিরিয়ার বাদশাহ একবার আবদুল হক মোহাজেরে মক্কী (রঃ) এর কাছে একটি ফতোয়া চেয়েছিলেন। দেখা গেল সেই ফতোয়াটি হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) এরই হস্তের লেখা। বাদশা মোয়াজ্জেম সাহেবকে মুক্তি দিয়ে স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম এবং একটি এলাকার কাজী পদে নিয়োগ দিলেন।

যুদ্ধাবসানের পর তিনি দেশে আসার জন্য ব্যাকুল হলেন। মুম্বাইয়ে এসে তাঁর নিখোঁজ মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেল। ওখানে স্পেনের এক মহিলাকে তিনি ঐ সময় মা ডেকে তার আশ্রয়ে ছিলেন এতদিন। হযরত মোয়াজ্জেম (রঃ) স্বীয় কন্যাকে নানা বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন পর মাতৃভূমিতে নিয়ে চলে এলেন।


হদুয়ায় বসতি ও ইসলামের খেদমত

নিজ দেশ এই ঝালকাঠির নওয়াপাড়াতে হযরত মোয়াজ্জেম সাহেব তখন এসেছেন দীর্ঘ দিনের পর। খবর শুনে দিক-দিগন্ত থেকে মানুষের ঢল নামলো তাকে দেখবার জন্য। কিছু দিন নওয়াপাড়াতে থাকার পর তিনি হদুয়াতে চলে আসেন হাজী আবদুর রহমান আকনের বাড়িতে যিনি তাঁর পিতা হাজী হেলাল উদ্দীনের খালাতো ভাই ছিলেন। হদুয়া, বৈশাখীয়া সহ আশপাশ গ্রামের মানুষ হুজুরকে দেখার জন্য এবং তার সোহবাত লাভের জন্য দলে দলে আসতে লাগলেন। হযরত মোয়াজ্জেম হোসেন (রঃ) কে হদুয়াতেই থাকার জন্য মানুষ পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ফলে তিনি হদুয়াতে থেকে গেলেন।

ঝালকাঠির বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজন হদুয়াতে এসে মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেবের সান্নিধ্য লাভ করতে লাগলেন। বাখেরগঞ্জ, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী থেকে তার কাছে লোক হাজির হতে লাগল। ঝালকাঠির সারেঙ্গল নামক স্থানের লোকজন খবর পেয়ে চলে আসেন হদুয়াতে। সারেংগল গিয়ে হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) দ্বীনি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা অব্যহত রাখলেন। সরেঙ্গলের সিনিয়র মাদ্রাসাটিও হযরত মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এ জন্যই মাদ্রাসাটির নাম ছারছীনার দাদা হুজুর এবং হদুয়ার পীর সাহেবের যৌথ নামেই সারেঙ্গল নেছারীয়া হোসাইনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা রাখা হয়েছে। সারেঙগলের পাশ গ্রাম নৈকাঠিতে হদুয়ার পীর সাহেবের এক কন্যা মরহুম মৌলভী মোফাখখর আলীর নিকট বিবাহ দিয়েছিলেন। হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইন সাহেব দেশে আসার পর বিভিন্ন এলাকায় দ্বীনি প্রতিষ্ঠান কয়েম এবং দ্বীন প্রচারের জন্য সক্রিয় থাকেন। ১৯৩৩ সালে বাখেরগঞ্জের কাফিলা গ্রামে একটি হাই মাদ্রাসা স্থাপন করেন। কোরান শরীফ শিক্ষা দানে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসাইন। তিনি মক্কা শরীফে ক্বারী আবদুল্লাহ নামক এক ক্বারী সাহেবের নিকট কোরানের তালীম নিয়েছিলেন।

হযরত মোয়াজ্জেম হোসাইনের প্রথম স্ত্রী মক্কা শরীফেই ইন্তেকাল করেন। দেশে আসার পর হাজী আবদুর রহমান আকনের কন্যা মোহতারিমা খাতুনে জান্নাতকে বিবাহ করেন। তিনি ১৯৩৫ সালে হদুয়াতে স্থাপন করেন এক ফোরকানীয়া মাদ্রাসা। সেটিরই বর্তমান রূপ হদুয়ার ফাজিল মাদ্রাসা। ১৯৪১ সালে মাদ্রাসাটি আলিম মনজুরী লাভ করেছিল। জানা যায় নলছিটি থানায় হদুয়া এবং ফয়রা মাদ্রাসাটিই ছিল এতদ অঞ্চলের প্রথম মঞ্জুরীপ্রাপ্ত মাদ্রাসা। বাখেরগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক নূর নবী চৌধুরী, মহকুমা প্রশাসক সিরাজুল ইসলাম প্রায়ই হদুয়া দরবারে হুজুরের খেদমতে হাজির হতেন এবং মাদ্রাসাটিকে মঞ্জুরী দানের ব্যাপারে তাদের অবদান বেশি। হদুয়াতে তিনি একটি রিজার্ভ পুকুর খননের ব্যবস্থা করেছিলেন। এলাকার ভক্তবৃন্দ হুজুরের সফরের জন্য হুজুরকে ৬০০ টাকায় একখানা পানশী বোট তৈরী করে দেন। সফরের বাহন হিসেবে ঐ পানশি নৌকা দীর্ঘকাল এক স্মৃতি বহনকারী হিসেবে ছিল।


মৃত্যু

মোয়াজ্জেম হোসাইন (রঃ) তার এক কন্যাকে হদুয়া মাদ্রাসার সাবেক তত্ত্বাবধায়ক হযরত মাওলানা আবদুল হক সাহেবের নিকট বিবাহ দেন। আর তিনিই হদুয়ায় তার গদ্দীনশীন হন। হযরত মোয়াজ্জেম হোসেন (রঃ) বাংলা ১৩৪৯ সনে ১৭ শ্রাবণ ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে মরহুম এক পুত্র এবং দুজন কন্যা অসংখ্য আত্মীয় স্বজন ভক্ত মুরীদ রেখে যান।


তথ্যসূত্র: আবদুর রশীদ। এই সেই ঝালকাঠি। আল ইসলাম পাবলিকেশনস, ঝালকাঠি। ২০০১।