স্বদেশী আন্দোলনে বরিশাল

Barisalpedia থেকে

স্বদেশী আন্দোলনে বরিশাল: ১৯০৫ সালে মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার নামে সৃষ্ট বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করা হলে এ প্রস্তাবের বিরোধিতায় স্বদেশী আন্দোলন উদ্ভূত হয়। ব্রিটিশ পণ্য বর্জন, রাখি বন্ধন, অরন্ধন ইত্যাদি পন্থায় এ আন্দোলন আগাতে থাকে। এ আন্দোলনটি বন্দেমাতরম আন্দোলন নামেও অভিহিত হয়ে থাকে। এর দুটি ধারা ছিল: একটি আধুনিকতাবাদী এবং অপরটি হিন্দু পুনর্জাগরণবাদী। এর এই হিন্দু পুনর্জাগরণবাদিতার জন্য গজনবী, আবদুর রসুল, দীন মোহাম্মদ, দীদার, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ মুসলমানদের আবেগঘন আবেদন সত্ত্বেও বাংলায় মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বিরাট অংশ স্বদেশী আন্দোলন হতে বিরত থাকে। তবে বরিশালে অশ্বিনীকুমার দত্ত একটি ভিন্ন কৌশলে অনেক মুসলমানকে এ আন্দোলনে সামিল করতে পেরেছিলেন।


বি এম কলেজে জনসভা

লর্ড কার্জন ১৯০৩ খৃৃস্টাব্দে বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব করা হলে অশ্বিনী কুমার দত্তের নেতৃত্বে বরিশালে জনসভায় বঙ্গব্যবচ্ছেদের প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৪ খৃৃস্টাব্দে হাজার হাজার লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তিনি ইংরেজ সরকারের নিকট প্রেরণ করেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই ব্রজমোহন কলেজ প্রাঙ্গণে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় উকিল দীনবন্ধু সেনা সভাপতিত্ব করেন এবং বরিশালের জনপ্রিয় নেতা অশ্বিনী কুমার দত্ত ভাষণ দেন।


স্বদেশবান্ধব সমিতি গঠন

১৯০৩ খৃস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব করা হলে তার বিরুদ্বে আন্দোলন চালাবার জন্য বরিশাল শহরে প্রবীণদের নিয়ে নেতৃসংঘ এবং যুবকদের নিয়ে কর্মীসংঘ গঠন করা হয়। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ৬ আগষ্ট নেতৃসংঘ ও কর্মীসংঘ একত্রিত হয়ে ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ গঠন করা হয়। অশ্বিনী কুমার ছিলেন স্বদেশ বান্ধব সমিতির সভাপতি এবং ডা. নিশিকান্ত বসু সমিতির প্রচারক ছিলেন। পরে এ আন্দোলনে অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য আনয়নের জন্য অশ্বিনী কুমার দত্ত দু’জন হিন্দু ও দু’জন মুসলমান প্রচারক নিযুক্ত করেন। তাঁর এ প্রয়াস অনেকখানি সার্থক হয়। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদ ও স্বদেশী আন্দোলন। তবে এর একটি সর্বজনগ্রাহ্য রূপ প্রদানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক এই কর্মসূচির সাথে তিনি আরো যোগ করেন অর্থনৈতিক উন্নয়ন , মাদকদ্রব্য সেবন নিবারণ, স্ত্রীশিক্ষা প্রচলন, সেবকদল গঠন, ব্যায়াম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, স্বদেশী বস্ত্র তৈরি, গ্রাম্য সালিশী প্রভৃতি গ্রামে গ্রামে স্বদেশ বান্ধব সমিতির শাখা গঠন করা। এসব সমাজউন্নয়নের প্রোগ্রাম থাকায় বঙ্গভঙ্গ রদের লক্ষ্যে উদ্ভূত স্বদেশী আন্দোলন বরিশালে ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’র মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।

বঙ্গবঙ্গ রদ আন্দোলনের এ আয়োজনে অশ্বিনী কুমার দত্তের সহযোগীদের মধ্যে ছিলেন বিএম কলেজের অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিএম স্কুলের শিক্ষক আচার্য জগদীশ মুখোপাধ্যায়, কালীশ চন্দ্র বিদ্যা বিনোদ, বিএম কলেজের অধ্যক্ষ রজনীকান্ত গুহ, উপাধ্যক্ষ কালীপ্রসন্ন ঘোষ, সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, উকিল নিবারণ দাশগুপ্ত, ব্যারিষ্টার সৈয়দ মোতাহার হোসেন, হাজী ওয়াহেদ রাজা চৌধুরী, শরৎ কুমার রায়, ডা. তারিণী কুমার গুপ্ত, দুগামোহন সেন, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা, চাণ কবি মুকুন্দ দাশ, ভবরঞ্জন মজুমদার, চৌধুরী মুহাম্মদ ইসমাইল খান প্রমুখ। চারণ কবি মুকুন্দ দাশ গান গেয়ে স্বদেশী আন্দোলনের ডাক ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন। স্বদেশী ও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকারীদের ওপর নেমে আসে ফুলারী নিপীড়ণ ও অত্যাচার। ১৯০৫ খৃৃস্টাব্দে স্যার র্যা মফিল্ড ফুলার পূর্ব বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হন। বরিশালে আন্দোলন প্রবল ছিল সে কারণে বরিশালেই সরকারী নির্যাতন সবচেয়ে বেশি ছিল।


ছাত্র আন্দোলন

শত শত ছাত্র স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেয়। ছাত্রদের আন্দোলন হতে বিরত রাখার জন্য পূর্ববঙ্গের চীফ সেক্রেটারি মি. কারলাইল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর একটি সার্কুলার জারি করেন। কারলাইল সার্কুলার বিরোধিতার জন্য এন্টি সার্কুলার সোসাইটি গঠন করা হয়। কলকাতায় সতীশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় ডন সোসাইটি গঠন করেন। বরিশালের ছাত্ররা কারলাইল সার্কুলারের শিকার হয় এবং অনেক ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করে দেয়। স্টীমার ঘাটে ছেলেরা ফুলারকে বলেছিল “ফুলার গো ব্যাক, ফুলারকে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল।”


চারণকবিদের আন্দোলন

স্বদেশী আন্দোলনেক চারণ কবি মুকুন্দ দাশ জনপ্রিয় করে তোলেন। তিনি বরিশালের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং অনেক জেলায় জাগরণী গান শুনালেন এবং জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি করেন। মুকুন্দ দাশ বাঙালীদের অভয় বাণী শুনালেন অসংখ্য গানে। রঙ্গশ্রীর কবি হেমচন্দ্র মুখোপাধ্যায় স্বদেশী গান গেয়ে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন। বিখ্যাত জারি গায়ক আলাম, আকুব্বার ও মফিজ উদ্দিন স্বদেশী জারি গান গেয়ে হিন্দু মুসলমানকে বিদেশী মাল বর্জনে উৎসাহিত করেন।


বরিশালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন ১৯০৬

বরিশালে স্বদেশী আন্দোলনের সাফল্য বাংলাদেশকে আকৃষ্ট করেছিল। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে ১৯০৬ খৃস্টাব্দে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন বরিশালে অনুষ্ঠিত হবে। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত, সম্পাদক উকিল রজনীকান্ত দাশ, সহযোগী সম্পাদক উকিল নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত এবং উকিল শরৎ চন্দ্র গুহ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান হলেন বিএম কলেজের দর্শনের অধ্যাপক সুরেন্দ্র নারায়ণ মিত্র। অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন ডা. তারিণী কুমার গুপ্ত, ব্যারিষ্টার সৈয়দ মোতাহার হোসেন, ওয়াহেদ রাজা চৌধুরী, মুকুন্দ দাশ, দেবকুমার রায় চৌধুরী, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা, পূর্ণচন্দ্র দে, সতীশ চœদ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের উত্তর দিকের মাঠে বিরাট সভামঞ্চ নির্মাণ করা হয়।

১৯০৬ খৃস্টাব্দে ১৩ এপ্রিল শুক্রবার সন্ধ্যায় খুলনা ও নারায়ণগঞ্জের স্টীমারে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, কৃষ্ণ, কুমার মিত্র ভুপেন্দ্রনাথ বসু, অমৃত বাজার পত্রিকার মতিলাল ঘোষ, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সভাপতি ব্যারিষ্টার আব্দুর রসুল ও তার শ্বেতাঙ্গিনী স্ত্রী, আব্দুল হালিম গজনবী, আনন্দ চন্দ্র রায়, শচীন্দ্র প্রসাদ বসু প্রমুখ এবং অন্যান্য জেলার শত শত প্রতিনিধি বরিশাল আগমন করেন। বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ পূর্বে বরিশালে পৌঁছেন। নেতৃবর্গকে ষ্টীমারঘাট হতে শোভাযাত্রা করে রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে (বর্তমান অশ্বিনী কুমার টাউন হল) আনা হয় এবং সেখানে অভ্যর্থনা জানানো হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ এপ্রিল নেতৃবৃন্দসহ জনতা রাজা বাহাদুরের হাবেলিতে সমাবেত হন। পুলিশ তাদের বন্দে মাতরম ধ্বনি দিতে নিষেধ করে। কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যে বরিশালেই প্রথম ফুলারের নির্দেশ অমান্য হলো। প্রথমে ঘোড়ার গাড়িতে ব্যারিষ্টার রসুল ও তার স্ত্রী যাত্রা শুরু করেন। পুলিশ সুপারিণটেনডেন্ট মিঃ কেম্প এবং সহকারী পুলিশ সুপার হেনস গুর্খা পুলিশ নিয়ে শোভাযাত্রাকে বাধা দেয়। পুলিশের লাঠির আঘাতে বহু লোক আহত হয়ে বাস্তার ড্রেনে পড়ে যায়। লাঠির আঘাতে মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার পুত্র চিত্তরঞ্জনের মাথা ফেটে যায় এবং দিপালী সিনেমার সামনের পুকুরে পড়ে যায়। মিঃ কেম্প সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে গ্রেফতার করে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ইমারসনের বাসভবনে নিয়ে যায়। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সুরেন্দ্রনাথকে চার শ’ টাকা জরিমানা করলেন। ওদিকে সভার কাজ চলছে। মুসলমানদের মধ্যে সভায় উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ ইসমাইল চৌধুরী, আবুল হোসেন, মৌলভী হেদায়েত বকস, ব্যারিষ্টার সৈয়দ মোতাহার হোসেন, মৌলভী হামেজ প্রমুখ।

অশ্বিনী কুমার দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ রায় সভায় উপস্থিত হলে তুমুল হর্ষধ্বনি হলো। সুরেন্দ্রনাথ, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ বক্তৃতা দিলেন। ১৫ এপ্রিল বেলা ১১টায় পুনরায় অধিবেশন আরম্ভ হলো। লক্ষ জনতার কণ্ঠে বন্দে মাতরম গীত হলো। অশ্বিনী কুমার প্রস্তাব করলেন যে স্থানে রেগুলেশন লাঠির দ্বারা পুলিশ দেশপ্রেমিক যুবকদের রক্তপাত ঘটিয়েছে এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে গ্রেফতার করেছে সে স্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত করা হবে। সুরেন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিলেন এবং বিলাতী মাল বর্জনের প্রতিজ্ঞা পাঠ করালেন। পুলিশ বাধা দিলে সভা ভেঙ্গে যায়।


স্বদেশবান্ধব সমিতি সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মন্তব্য

স্বদেশবান্ধব সমিতির কার্যাবলী এত ব্যাপক ও বিপ্লবী ছিল যে পূর্ব বঙ্গ ও আসামের চীফ সেক্রেটারি মি. লায়ন ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট রিপোর্ট দিতে বাধ্য হয়। লায়ন লিখলেন ‘ইহা দেখা যায় যে প্রদেশের অন্যান্য জেলায় বিদ্যমান প্রতিবাদী সংগঠনের চেয়ে বাকেরগঞ্জের অভ্যন্তরের আন্দোলনকারী সংগঠন অনেক শ্রেয় যা ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে। বান্ধব সমিতি যার প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য আছে তা বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত এবং রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার এজেন্ট এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৫০টি শাখা আছে এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।’ লায়ন লিখেছেন, সকল শাখা ব্রিটিশ সরকারের অধীন হতে স্বাধীনতা চায়। এ অনুভূতি সমিতি ও শাখাসমূহের সাধারণ সভায় ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে। পরিশেষে সরকার স্বদেশবান্ধব সমিতি বন্ধ করে দেয়। বরিশালের বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। ভারত সচিব মিঃ মর্লে পার্লামেন্টকে জানিয়েছিলেন যে, ‘বরিশাল ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত সমস্যা তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে।’ ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর বাংলার ৯ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে বরিশালের ছিলেন অশ্বিনী কুমার দত্ত, অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা। অশ্বিনী কুমারকে লক্ষ্ণৌ জেলে আটক করে রাখা হয়। সতীশ চন্দ্রকে রেঙ্গুনে পাঠানো হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রæয়ারি অশ্বিনীকুমার মুক্তি লাভ করেন। ইংরেজ সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর দিল্লীর দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদ করার কথা ঘোষণা করে।



তথ্যসূত্র: ১। বাংলাপিডিয়া ২।সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।