শায়েস্তাবাদের সৈয়দ পরিবার

Barisalpedia থেকে

শায়েস্তাবাদের জমিদার পরিবার দক্ষিণ বাংলার সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী মুসলিম জমিদার পরিবার। এই পরিবারের মির মোয়াজ্জেম হোসেনকে ইংরেজ সরকার নবাব উপাধি দান করেছিলেন। দক্ষিণ বাংলায় নবাব উপাধিধারী জমিদার এই একজনই ছিলেন।


জমিদারির পত্তন

১৬৬৬ খৃৃস্টাব্দে সুবাদার শায়েস্তা খান বাকলা চন্দ্রদ্বীপ হতে মগ-পর্তুগীজদের তাড়িয়ে দেন। তার অভিযানে ইরাজ খাঁ অপূর্ব সাহসের পরিচয় দেন। শায়েস্তা খান পুরস্কারস্বরূপ ইরাজ খাঁকে চন্দ্রদ্বীপ হতে একটি ছোট পরগণা সৃষ্টি করে জায়গীর প্রদান করেন। শায়েস্তা খাঁর স্মরণে পরগণার নাম করা হয় শায়েস্তাবাদ। ইরাজ খাঁ এ পরগণা তার কন্যা উমাদাতুন নেছাকে দান করেন। উমদাতুন নেছা মোহাম্মদ হানিফ চৌধুরীকে শায়েস্তাবাদ পরগণা ইজারা দেন। ১৭৯৩ খৃৃস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের এক পত্রে মির আসাদ আলী বলেছেন, এ পরগণার মালিক ছিলেন তার নানা মোহাম্মদ হানিফ চৌধুরী।

পূর্বে চাখারের মেন্দি মজুমদার এ পরগণার মালিক ছিলেন। সম্ভবত মুহাম্মদ হানিফ চাখারের মেন্দি মজুমদারদের জামাতা ছিলেন। মেন্দি মজুমদারা জামাতার নামে শায়েস্তাবাদ ইজারা দিয়েছিলেন। আবার অনেকে বলেন হানিফ চৌধুরী ইরাজ খানের মেয়েকে বিয়ে করে এই জমিদারি পেয়েছিলেন। হানিফের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী আমেনা খাতুন ১৭৬৫ খৃৃস্টাব্দে বাংলা ১১৭১ সনের ২১ আষাঢ় তার নাতি মির আসাদ আলীকে শায়েস্তাবাদ পরগণা দানপত্রের মাধ্যমে হস্তান্তর করেন।


বংশতালিকা

মির আসাদ আলীর নাতি মির মোয়াজ্জেম হোসেন ১৮৭৫ খৃৃস্টাব্দে বেভারিজকে তার একটি বংশ তালিকা দিয়েছিলেন। উক্ত তালিকামতে এ পরিবার হজরত মুহম্মদের (দঃ) বংশধর। উক্ত তালিকামতে হজরত মুহম্মদ (দঃ) এর কন্যা হজরত ফাতেমা (রাঃ), তাঁর পুত্র হজরত ইমাম হোসেন (রাঃ), তাঁর পুত্র সৈয়দ জয়নাল আবেদীন, তাঁর পুত্র সৈয়দ মোহাম্মদ বাকের, তাঁর পুত্র সৈয়দ মোহাম্মদ ইমাম জাফর সাদি, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ আহমেদ বুলখি, তাঁর পুত্র সৈয়দ আবু লুনাম, তাঁর পুত্র সৈয়দ আনোয়ারুল বুলখি, সৈয়দ আবদুল হক বুলখি, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ আলম বুলখি, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ আবুল খালেক বুলখি (সমরখন্দ), তাঁর পুত্র সৈয়দ আবদুর রাজ্জাক, তাঁর পুত্র সৈয়দ আবদুল কাদের, তাঁর পুত্র, তাঁর পুত্র সৈয়দ গোদুল হক, তাঁর পুত্র সৈয়দ শাহ সুলতান, তাঁর পুত্র সালার সমরখন্দী, তাঁর পুত্র কুমার সমরখন্দী, তাঁর পুত্র শাহ বকসী, তাঁর পুত্র শাহ আমানত, তাঁর পুত্র শাহ জাকারিয়া, তাঁর পুত্র শামসউদ্দিন, তাঁর পুত্র শাহ মোহাম্মদ ওয়ালী, তাঁর পুত্র শাহ আদম ওয়ালী সিন্দ, তাঁর পুত্র মুর্তজা, তাঁর পুত্র হাসামদ্দিন (সিন্ধু থেকে মকিমপুরে আসেন), তাঁর পুত্র সামসউদ্দিন, তাঁর পুত্র সলিম উদ্দিন চৌধুরী, মির আসাদ আলী, তাঁর পুত্র মির এমদাদ আলী, তাঁর চার পুত্র মির তোজাম্মল আলী, আবদুল মজিদ, মির মোয়াজ্জেম হোসেন ও মির আব্দুল্লাহ; মির তোজাম্মল আলীর পুত্র মির তোফাজ্জল আহমেদ; মির মোয়াজ্জেম হোসেনের সন্তানরা হলেন মোজাফফর হোসেন, আবদুর রব, মাহমুদ হোসেন, মোতাহার হোসেন, সালেহা বেগম, সাবেরা বেগম ও ফজলে রাব্বী; মোতাহার হোসেনের সন্তান সাহলী বেগম ও নেহাল হোসেন; সাবেরা বেগমের কন্যা সুফিয়া কামাল; ফজলে রাব্বীর সন্তান মোয়াজ্জেম হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন; মির এমদাদ আলীর তৃতীয় পুত্র মির আব্দুল্লাহর সন্তান ওয়াবদুল্লাহ ও মুহাম্মদ ইসরাইল।


পরিবারের কীর্তিমানগণ

শায়েস্তাবাদের মির পরিবার ১৯ শতকের বাকেরগঞ্জ জেলার মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত পরিবার ছিল এবং এ পরিবারে অনেক গুণী ও খ্যাতিমান সন্তানের জন্ম হয়। কয়েকজনের নাম নি¤েœ উলেখিত হলো।

মির আবদুল মজিদ- মির এমদাদ আলীর দ্বিতীয় পুত্র আবদুল মজিদ ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। জেলার মধ্যে তিনি প্রথম ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও খান বাহাদুর উপাধিধারী ছিলেন।


মির মোয়াজ্জেম হোসেন- মির এমদাদ আলীর তৃতীয় পুত্র মৌলভী মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ১৮১০ খৃৃস্টাব্দে শায়েস্তাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নদীয়া ও যশোরে প্রিন্সিপাল স্মল কজেজ কোর্টের জজ ছিলেন। তিনি অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। বাঙালীদের মধ্যে তিনি প্রথম অতিরিক্ত জজ ছিলেন। তিনি রাজশাহী, মাগুরা, নদিয়া, ঢাকা ও চট্টগ্রামে চাকরি করেন এবং সদর আমিন বা সাবজজ হিসেবে ১৮৭০ খৃৃস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডিন্সিতে অনরারি ম্যাজিষ্ট্রেট ও বাকেরগঞ্জ জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। সরকার তাকে খান বাহাদুর ও নবাবজাদা খেতাব প্রদান করে। জেলার মধ্যে তিনি একমাত্র নবাব উপাধিধারী ছিলেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তিনি উর্দু ও আরবী ভাষায় কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তৎকালীন বঙ্গদেশের অন্যতম খ্যাতিমান মুসলিম জমিদার নবাব সৈয়দ মৌলভী মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী খান বাহাদুর ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ০৭ অক্টোবর ৯৯ বছর বয়সে শায়েস্তাবাদ গ্রামে ইন্তেকাল করেন।


মির আব্দুল্লাহ- মির এমদাদ আলীর চতুর্থ পুত্র মির আব্দুল্লাহ খান বাহাদুর স্মল কজেজ কোর্টের জজ ছিলেন। তার হাইকোর্টের জজ হওয়ার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু হঠাৎ তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।


মির মুহাম্মদ হোসেন- মির মোয়াজ্জেম হোসেনের পুত্র মুহাম্মদ হোসেন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত মাত্র পড়াশোনা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন এতদঞ্চলের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্যক্তি। নিজের চেষ্টায় তিনি বাংলা, ইংরেজী, উর্দু, ফার্সী ও আরবী ভাষায় পা-িত্য অর্জন করেন। ইংরেজী সাহিত্যে তার মতো প-িত বাংলাদেশে বিরল ছিল। তিনি এক সুবৃহৎ লাইব্রেরী গড়ে তুলেছিলেন। তার লাইব্রেরী উপমাহাদেশে বিখ্যাত ছিল। লন্ডন টাইমস পত্রিকা এক সংখ্যায় তার ইংরেজী ভাষার দখল ও লাইব্রেরীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। ইংল্যান্ডের নামী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে তার এই মর্মে চুক্তি ছিল যে, ইংরেজী সাহিত্যের কোন বই প্রকাশিত হবার সাথে সাথে তারা মির মুহাম্মদ হোসেনর লাইব্রেরীতে উক্ত বইয়ের এক কপি পাঠিয়ে দিতো। এ কথা ড. তপন রায়চৌধুরী তাঁর বাঙালনামায় উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ হোসেন পেশাগত জীবনে সাব-রেজিষ্ট্রার ও বাকেরগঞ্জ জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি চৌধুরী পদবি গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৩০ খৃৃস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।


মির মোতাহার হোসেন- মির মোয়াজ্জেম হোসেনের পঞ্চম পুত্র মোতাহার হোসেন ছিলেন তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় ব্যারিষ্টার। কলকাতা হাইকোর্টে তিনি আইন ব্যবসা করতেন। তিনি অশ্বিনী কুমার দত্তের সাথে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯০৪ খৃৃস্টাব্দে তিনি স্যার সলিমুল্লাহর সাথে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তার দুই বিয়ে। দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন শ্রীমতী বেলা কুমারী। তার কন্যা সাহলীন বেগমের সাথে করটিয়ার জমিদার হায়দার আলী খান পন্নীর বিয়ে হয়। তাদের পুত্র বিখ্যাত সমাজসেবক করটিয়ার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী। মোতাহার হোসেনের একমাত্র পুত্র সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন কবি সুফিয়া কামালের প্রথম স্বামী। মোতাহার হোসেন ১৯১১ সালে ইন্তেকাল করেন। তার পুত্র সৈয়দ নেহাল হোসেন ১৯৩৪ সালে অকালে প্রাণ ত্যাগ করেন।


মুহাম্মদ এসরাইল- মির আবদুল্লাহর প্রথম পুত্র মুহাম্মদ এসরাইল ব্যারিষ্টার ছিলেন। তিনি হুগলী জেলার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন।


ওবায়দুল্লাহ- মির আবদুল্লাহর দ্বিতীয় পুত্র মির ওবায়দুল্লাহ চৌধুরী পিরোজপুরে অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। রাজাপুরের সাতুরিয়ার প্রজাহিতৈষী জমিদার মেহেরুন্নেছার মেয়ে শামসুন্নেছা তাঁর স্ত্রী ছিলেন।


কবি সুফিয়া কামাল- মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের কনিষ্ঠ কন্যা সাবেরা বেগমের বিয়ে হয় কুমিল্লার সৈয়দ আবদুল বারির সাথে। সৈয়দ আবদুল বারির কন্যা ছিলেন বেগম সুফিয়া। মামাত ভাই নেহাল হোসেনের সাথে বেগম সুফিয়ার প্রথম বিয়ে হয়। তখন তিনি সুফিয়া এন. হোসেন নামে পরিচিতি ছিলেন। নেহাল হোসেন ১৯৩৪ সালে অকালে প্রাণ ত্যাগ করেন। নেহাল হোসেনের ঔরসে বেগম সুফিয়ার এক কন্যা ছিল, নাম আমেনা।


ড. কামাল হোসেন- বাংলাদেশের খ্যাতিমান আইনজীবী ড. কামাল হোসেন শায়েস্তাবাদ নবাব পরিবারের বংশধর। মির মোয়াজ্জেম হোসেনের কন্যা সালেহা খাতুনের দ্বিতীয় বিয়ে হয় ১৯০২ সালে কলকাতার সৈয়দ আশরাফ হোসেনের পুত্র সৈয়দ সাহাদত হোসেনের (সাদু মিয়া) সাথে। সাদু মিয়ার পুত্র ডা. আহম্মদ হোসেন। ডা. আহম্মদ হোসেনর পুত্র হলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। অর্থাৎ ড. কামাল হোসেন মির মোয়াজ্জেম হোসেনের কন্যার দিক দিয়ে বংশধর।


জমিদারির প্রসার

মির মোয়াজ্জেম হোসেনের সময় শায়েস্তাবাদের জমিদার পরিবারের জমিদারি সবচেয়ে সম্পসারিত হয়। তার জমিদারীর আয় ছিল প্রাায় দু’লক্ষ টাকা। তার সময় কোতোয়ালি, মেহেন্দীগঞ্জ, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, মির্যাগঞ্জ, গলাচিপা, বাউফল, বরগুনা, স্বরূপকাঠি, ফরিদপুরের ভূষণা ও ঢাকা জেলার শ্রীনগর ও মানিকগঞ্জে তাদের জমিদারী ছিল।


স্থাপত্য ও ঐতিহ্য

শায়েস্তাবাদের জমিদার পরিবারের অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপত্যকীর্তিসমূহ নদীর গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে। মির মোয়াজ্জেম হোসেন শায়েস্তাবাদে রাহাত মঞ্জিল নামে সুন্দর এক ভবন নির্মাণ করেছিলেন। তার নির্মিত মসজিদে অনেক মূল্যবান পাথর ও কারুকার্য খচিত ছিল। ১৯১৯-২০ খৃৃস্টাব্দে তাদের বাড়িটি নদীতে ভেঙ্গে যায়। মির মোয়াজ্জেম হোসেনের সমাধিটিও শায়েস্তাবাদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের পরে তাদের বাড়ির মসজিদটি নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। বাসগৃহ ভেঙ্গে যাওয়ায় এ পরিবার বরিশাল শহরে চলে আসে। তারা বরিশাল ফায়ার সার্ভিসের বর্তমান স্থানে বাস করতেন। পরে এ বাড়িটি ঢাকার নবাবদের নিকট হস্তান্তর করেন। পরে তারা জেলা স্কুলের নিকট শায়েস্তাবাদ লজে চলে আসেন। এই লজের পূর্ব নাম ছিল কুঠিবাড়ী এবং মালিক ছিলেন ঢাকার নবাব। নবাব মোয়াজ্জেম হোসেন ১৮৮৭ খৃৃস্টাব্দে নবাব আহসান উল্লাহর নিকট হতে এই কুঠিবাড়ী ক্রয় করে এর নাম দিয়েছিলেন শায়েস্তাবাদ লজ। মির মোয়াজ্জেম হোসেনের একটি বৃহৎ লাইব্রেরী ছিল। চীনামাটিতে নির্মিত সেই লাইব্রেরীও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে।



তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ২০১০।