রমাবল্লভ দেব

Barisalpedia থেকে

রমাবল্লভ দেব রাজা দনুজমর্দন দেবের দ্বিতীয় পুত্র এবং চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের তৃতীয় রাজা। তাঁর রাজত্বের সঠিক সময় মেয়াদ জানা যায় না। তবে এটুকু বলা যায় যে তিনি চতুর্দশ শতকের রাজা ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুকাল আনুমানিক ১৩৮০।


সিংহাসনে আরোহণ

রাজা দনুজমর্দন দেব ১০০ বছরের বেশী জীবিত ছিলেন। খুব সম্ভব ১৩৩০ সালে তার মৃত্যু হয়। ঘটকারিকাদের বিবরণে দেখা যায় মহেন্দ্র ও রমাবল্লভ নামে তার দুই পুত্র ছিল। দনুজমর্দনের মৃত্যুর পর মহেন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অতি অল্পদিন রাজত্ব করেছিলেন বলে অনুমিত হয়। দনুজমর্দনের পুত্র রমাবল্লভ দীর্ঘদিন রাজত্ব করেন। তার রাজত্বকাল ১৩৩২ হতে ১৩৮০ পর্যন্ত ধরা যেতে পারে।


রমাবল্লভের রাজত্ব ও কৃতিত্ব

রমাবল্লভের রাজত্বকালে ফকরুদ্দীন মোবারক শাহ্ ১৩৩৮-১৩৪৯ সাল পর্যন্ত সোনারগাঁওয়ে রাজত্ব করেন। সামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ্ ১৩৫২ সালে ফকরুদ্দীনের পুত্র ইখতিয়ার উদ্দীন শাহকে পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত করে নিজকে শাহ্ বাঙ্গাল বলে ঘোষণা করেন। ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সেকান্দার শাহ্ ১৩৫৭ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সেকান্দার শাহ্ ১৩৯৩ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ইলিয়াস শাহ ও সেকান্দার শাহ্ পূর্ববঙ্গ জয় করলেও তাদের প্রায়ই দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হতো। সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত চন্দ্রদ্বীপের দিকে তারা দৃষ্টি দিতে পারেন নি। রমাবল্লভ দিল্লী ও গৌড়ের শক্তি পরীক্ষার সময় চন্দ্রদ্বীপের তার শাসন ও প্রতিপত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি রাজধানীকে সুরক্ষিত করে চন্দ্রদ্বীপকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করেন। তিনি রাজধানী ও রাজ্যের কয়েক স্থানে দুর্গ নির্মান করেন। ঘটকগণের কুলগ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, রমাবল্লভ অশ্ব, নৌবাহিনী ও হস্তিসৈন্য পরিবৃত থাকতেন। তিনি অস্ত্রশস্ত্র বিশারদ ছিলেন। তিনি গৌড় সুলতানদের আক্রমণের আশঙ্কা করতেন। তাই রাজধানীকে গড়বন্দী করেন এবং শক্তিশালী নৌবাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতেন। সারা বাংলায় যখন ইলিয়াস শাহী সুলতানদের বিজয় পতাকা উড়ছে তখন রমাবল্লভ চন্দ্রদ্বীপের স্বাধীনতা টিকিয়ে রেখে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেন।

কুলপঞ্জিতে উল্লেখ আছে রমাবল্লভ স্বনামে একটি নগর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু অনেক সন্ধান করে রমাবল্লভ নগরের অবস্থান পাওয়া যায়নি। এ নগর কোথায় এবং বর্তমান নাম কি, তা জানা যায়নি। গলাচিপা থানায় বল্লভপুর নামে একটি গ্রাম আছে। কিন্তু এ গ্রামে প্রাচীন শহরের কোন নিদর্শন নেই। বল্লভপুরের নাম রমাবল্লভের নামে যে হয়েছে তা আমরা বলতে পারি না। অনেকে বলেন বাউফল থানার কচুয়াই রমাবল্লভপুর নামে অভিহিত ছিল। চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী বাকলা। খুব সম্ভব তিনি বাকলা শহরে সুরম্য দালানকোঠা ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করে শহরের নামকরণ করেন রমাবল্লভপুর।


রমাবল্লভের সমাজ সংস্কার

বাকলা বা বাঙ্গালা কুলীন কায়স্থ ব্রাহ্মণদের কেন্দ্রস্থল ছিল। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুসলমানদের ভয়ে বর্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যগণ বাকলা নগরে বসতি স্থাপন করেন। রমাবল্লভ তাদের অনেককে রাজপদ প্রদান করেন। তিনি তাদের কার্যাবলী ও সামাজিক ক্রিয়ার্দি দর্শন করে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিভুক্ত করেন। তিনি কায়স্থদের বৈবাহিক কুল সম্বন্ধে কতকগুলো বিধি প্রচলন করে সমাজকে সুদৃঢ় করেন। তার সময় রাজ্যসীমা বিস্তার লাভ করে। পার্শ্ববর্তী ভূস্বামীরা তার বশ্যতা স্বীকার করেন। বাংলার কয়েকজন সামন্ত রাজা তার আনুকূল্য লাভ করে চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয় নেন। রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সুন্দরবন কেটে নতুন নতুন জনবসতি গড়ে ওঠে। তার কর্যাবলী দেখে মনে হয় তিনি অনেক বছর রাজত্ব করেন। তার দীর্ঘ রাজত্বকালে চন্দ্রদ্বীপে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করত। জনগণ তার সুশাসনে শান্তিতে বসবাস করত।


মৃত্যু

রমাবল্লভের মৃত্যুর তারিখ জানা যায়নি। কুলপঞ্জি অনুসারে তিনি ১৪ শতকে রাজত্ব করতেন। আমারা তার মৃত্যুকাল ১৩৮০ সাল ধরে নিতে পারি।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (প্রথম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০