মুসলিম লীগ, বরিশাল

Barisalpedia থেকে

বরিশালের রাজনৈতিক ইতিহাসে মুসলিম লীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।


গঠন ইতিহাস

১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপস্থিতিতে বরিশাল মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি হলেন আজিজ উদ্দিন উকিল এবং সম্পাদক হলেন আফতাব উদ্দিন উকিল (ঝালকাঠি)। পরে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে খান বাহাদুর হাশেম আলী খান মুসলিম লীগের সভাপতি এবং আফতাব উদ্দিন সম্পাদক নির্বাচিত হন । হাশেম আলী খান কৃষক প্রজা পার্টির সভাপতি ছিলেন। আজিজ উদ্দিন আহমেদ ও মোফাজ্জল হক নতুন মুসলিম লীগ কমিটির বিরোধী ছিলেন। নিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগ মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ছিল। ওবায়দুল হক, আব্দুল কাদের চৌধুরী মানিক মিয়া, ইদ্রিস মোল্লা, এনায়েত হোসেন প্রমুখ মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।


হিন্দু মহাসভার বিরোধিতা

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ব্রজমোহন কলেজ পরিদর্শন করার জন্য বরিশালে আগমন করেন। হিন্দু মহাসভা, কংগ্রেস, ও সতীন সেনের তরুণ সংঘ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা জানায়। মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ ও আনসার সমিতি শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী কর্তৃক বিএম কলেজ পরিদর্শনের বিরোধিতা করে। বরিশালের হিন্দু মুসলমানের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। বিএম কলেজের অধ্যক্ষ শৈলেন্দ্রনাথা ঘোষ কলেজে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। কলেজের মুসলমান ছাত্ররা সকাল হতে বিক্ষোভ শুরু করে। শহর ও কাউয়ারচরের অনেকে মুসলমান ছাত্রদের সাথে যোগ দেয়। বিপ্লবী কর্মী শাহজাহান চৌধুরীও মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে যোগ দেন। বিকেল পর্যন্ত কলেজ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ চলে। শাহজাহান চৌধুরী, আবদুল কাদের চৌধরী (মেদিনীপুর), ওবাযদুল হক, মানিক মিয়া, এম এ সামাদ, এনায়েত হোসেন (ঝালকাঠি), মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া, মীর আনোয়ার হোসেন প্রমুখ ছাত্রদের নেতৃত্ব দেন। হাশেম আলী খান সংগ্রেস ও মুসলীম লীগের মধ্যে সমঝোতার জন্যা চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ব্যায়ামাগারে সভা করবেন। বিকেলে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ব্যায়ামাগারে ভাষণ দেন এবং সন্ধ্যায় অশ্বিনী কুমার টাউন হলে জনসভা করেন। তার সাথে ভোজপুরী ও তরুণ সংঘের কর্মী ছিল। সভায় সতীন সেনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে আনসার সমিতির কর্মী আবদুস সামাদ, হাশেম ও ইয়াকুব আলী প্রমুখ সভায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। বরিশাল আনসার সমিতির সভাপতি ছিলেন হাশেম আলী খান এবং সম্পাদক ছিলেন আবদুস সামাদ। বরিশালে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম বিপ্লবী কর্মী ছিলেন ফজলে রাব্বী চৌধুরী (শাহজাহান চৌধুরী)। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি পরিত্যাগ করেন এবং ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের পর মুসলিম লীগে চলে যান।


বরিশাল মুসলিম লীগের পুনর্গঠন

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উথাপন করা হয়। পরে লাহোরের মূল প্রস্তাব পরিবর্তন করে পাকিস্তান দাবি করে। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এ কে ফজলুল হক ও হাশেম আলী খান মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। বরিশালে মুসলিম লীগ পুনর্গঠন করা হয়। উকিল আজিজ উদ্দিন আহমদকে সভাপতি এবং নবাবজাদা ফজলে রাব্বীকে (১৯০১-১৯৬২) সম্পাদক করে জেলা মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। আফতাব উদ্দিন উকিল, উকিল সদর উদ্দীন, সৈয়দ আনছার উদ্দিন, মীর ফিদে আলী, মোফাজ্জল হক উকিল, মোবারক আলী উকিল, মাওলানা আবুল কাসেম, ইসমাইল চৌধুরী, খান বাহাদুর নূরুজ্জমান, আজিজুর রহমান, খান বাহাদুর আকরাম, উকিল আবদুর রব, আবদুস ছোবহান মোক্তার, আফতাব উদ্দিন উকিল প্রমুখ মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন।১২


১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বরিশালে জয়লাভ

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে বিজয় মুসলিম লীগের গৌরব। বরিশালে নির্বাচন মুসলিম লীগের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষিত সমাজ মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। প্রচারে কৃষক সমাজের অনেকে মুসলিম লীগকে সমর্থন করতে শুরু করে। প্রচার অভিযান পরিচালনার জন্য ওয়ার্কার্স ক্যাম্প গঠন করা হয়। জেলা ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের আহবায়ক ছিলেন আবদুর রহমান চৌধুরী। প্রত্যেক মহকুমা ও থানার দায়িত্বে মুসলিম ছাত্রলীগ নেতাদের নিযুক্ত করা হয়। ছাত্রলীগের কর্মীরা ছিল মুসলিম লীগের প্রধান শক্তি। বরিশালে মুসলিম লীগের সস্কট দেখে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চলে আসেন। তাকে গ্রামের বিরোধী কৃষকদের সম্মুখীন হতে হয়। ভবানীপুর, শেখেরহাট, নলছিটি, ঝালকাঠিতে জনতা তাকে আক্রমণ করে। তৎকালীন, জঙ্গী ছাত্রনেতা মহিউদ্দীন আহমেদ, আখতারউদ্দীন আহমেদ, এবিএম আশরাফ আলী খান, সুলতান আহমেদ, শেখ মালেক প্রমুখ জনসভা সফল করার জন্য সব সময় তৎপর ছিলেন।

শেখ মালেকের বর্ণনায় শেখেরহাটে স্থানীয় জনগণ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর জনসভা পগু করে দেয়। পরে তিনি রাজপাশা খাল পাড়ে জনসভা করেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন প্রাক্কালে প্রথমত মনে হয় সকল আসনে কৃষক পার্টির প্রাথীরা জয়লাভা করবে। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আগমন ও ছাত্রলীগের প্রচারের ফলে জনমত পরিবর্তন হতে থাকে। ৯টি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৬টি আসন দখল করে। পিরোজপুর ও বাকেরগঞ্জ আসনে মূলত একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে ভোটযুদ্ধ হয়েছিল। শেরেবাংলার অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার জন্য সদর উদ্দীন উকিল ও আবদুস ছোবহান মিয়া পরাজিত হন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে মুসলিম লীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ দিনরাত পরিশ্রম করেছে। বাংলাদেশের মধ্যে মুসলিম লীগের রণক্ষেত্র ছিল বরিশাল। কারণ শেরেবাংলার জন্মভূমি বরিশাল। মুসলিম লীগ প্রার্থীর জয়লাভ ছিল এক অসম্ভব ব্যাপার। একমাত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও বিএম কলেজের ছাত্রনেতাদের জন্য এ বিজয় সম্ভব হয়েছিল। বিএম কলেজের তিন হাজার ছাত্রের মধ্যে ২২৫ জন মুসলমান ছিল। ২২৫ জন মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে ২২০ জন পাকিস্তান দাবি সমর্থন করেন। ছাত্রদের মধ্যে জাহিদ হোসেন জাহাঙ্গীর, মোজাম্মেলা হক (বাকেরগঞ্জ) মোশারেফ হোসেন নানু, শামসুদ্দিন আবুল কালাম, চরবাড়িয়ার মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন (উপ-জনশিক্ষা পরিচালক) ও শাহজাহান মল্লিক মুসলিম লীগ বিরোধী ছিলেন। তারা ছাত্র ফেডারেশন ও কৃষক-প্রজা পার্টির সমর্থক ছিলেন।


কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দ্বন্দ্ব

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাচনের পর বরিশালে মুসলমানের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। কংগ্রেসের সাথে মুসলিম লীগের সংঘাত চলতে থাকে। এ সময় কমিউনিষ্ট পার্টি, ফরওয়ার্ড বøক ও আরএসপি দল সুসংগঠিত ছিল। কমিউনিষ্ট পার্টির প্রভাব একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষক প্রজা পার্টি শক্তিহীন হয়ে পড়ে। দলের কর্মীরা অনেকে মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট প্রত্যক্ষ দিবসে বরিশালে মুসলিম লীগ মহিউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে এক বিরাট শোভাযাত্রা বের করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকায় বরিশালে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে কোনরকম অপ্রীতিকর ঘটনা হতে পারেনি। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষ ভাগে বরিশাল টাউন হলে একটি বিতর্ক সভা হয়। সভায় মুসলিম লীগের আজিজ উদ্দীন আহমদ, কংগ্রেসের অবনী ঘোষ, কমিউনিষ্ট পার্টির অমিয় কুমার দাশগুপ্ত বক্তৃতা করেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যা-ই থাকুক নেতারা বরিশালে শান্তিতে বসবাস করার প্রতিজ্ঞা করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে যখন দেশ বিভাগ হতে যাচ্ছিল তখন বরিশালে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়। এ সংবাদ পেয়ে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক বরিশালে ছুটে আসেন এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্ট টাউন হলে জনসভায় ভাষণ দেন। সভায় সভাপতি ছিলেন বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান উকিল মোফাজ্জেল হক। এ সভায় হাশেম আলী খান, আজিজ উদ্দীন আহমেদ, সতীন সেন, বিডি হাবিবুল্লাহ, আবদুল ওহাব খান, শমসের আলী প্রমুখ বক্তৃতা করেন। একে ফজলুল হক জনসভায় উদাত্ত আহবান জানালেন, ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে মুসলমানদের হিন্দুদের আঘাত করা উচিত হবে না। তাই যদি হয় তবে পাকিস্তান হবে রাজনৈতিক ভাঁওতা’।


পাকিস্তান আন্দোলনে বরিশাল মুসলিম লীগ

মুসলমানদের পৃথক আবাস ভূমি পাকিস্তান আন্দোলনে বাকেরগঞ্জ জেলা মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগ বিশেষ অবদান রেখেছে। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন-উকিল আজিজ উদ্দীন আহমেদ, নবাবজাদা সৈয়দ ফজলে রাব্বী, মুহাম্মদ সদর উদ্দিন উকিল, চৌধুরী মুহাম্মদ ইসমাইল খান, আরিফ চৌধুরী (ধনু মিয়া), সৈয়দ আনসার উদ্দিন উকিল, ধূলিয়ার মীর ফিদে আলী (মৃত্যু ১৯৪৫), মোফাজ্জেল হক উকিল, মাওলানা নূরুজ্জামান, মৌলভী মোবারক আলী উকিল, আফতাব উদ্দীন, আবদুর রব উকিল, আবুল কাসেম উকিল, আবদুল লতিফ চৌধুরী, মাওলানা আবুল কাসেম, খোরশেদ আলম চৌধুরী, শমসের আলী উকিল, আবদুল লতিফ মোক্তার, আবদুল লতিফ (চকবাজার), একেএম সিদ্দিক উকিল, আতাহার উদ্দীন আহাম্মদ উকিল, আশরাফ আলী সর্দার উকিল, আছমত আলী সর্দার উকিল, চৌধুরী ফজলে রাব্বী ( শাহজাহান চৌধুরী), আবদুল আজিজ তালুকদার মোক্তার, আমির আলী খান (আমির কুটির, আলেকান্দা), মুজহারুল হক ভ’ঁইয়া (চকবাজার), আমজেদ আলী মৃধা, এস এম রহমত উল্লাহ, কেরামত আলী খান, আবদুল মজিদ খান, মীর আনোয়ার উদ্দীন (দক্ষিণ আলেকান্দা), আনোয়ার মিয়া, আবদুর রশিদ, মুহাম্মদ শাহাজাহান, মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী, ভোলার খান বাহাদুর নূরুজ্জামান, আজিজুর রহমান (নওয়াব মিয়া), সৈয়দ ফজলুর রহমান (বাদশা মিয়া), ফরমুজুল হক, খান সাহেব আবদুর রশিদ, পটুয়াখালীর খান বাহাদুর আকরাম উকিল, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন উকিল, এমদাদ মোক্তার, বেতাগীর আবদুর রহমান খান, গলাচিপার শামসুদ্দিন আহমেদ (সানু মিয়া), পিরোজপুরের আবদুস ছোবহান মিয়া মোক্তার, আফতাব উদ্দিন উকিল, শামসুল হক খান, আব্দুর গফুর মোক্তার, আমিন উদ্দিন উকিল প্রমুখ।


উপসংহার

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। বাকেরগঞ্জ জেলা পূর্ববঙ্গ তথা পাকিস্তনের অন্তভর্‚ক্ত হলো। ১৪ ও ১৫ আগষ্ট জেলার শহর, বন্দর ও গ্রামে মুসলমানরা উৎসব করে। একই মঞ্চ হতে সকল রাজনৈতিক দল বক্তৃতা দেয়। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ফরওয়ার্ড বøক, কৃষক প্রজা পার্টি, আরএসপি ও কমিউনিষ্ট পার্টি শান্তি রক্ষা ও দেশের উন্নতির জন্য কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে অল্পদিনেই সে সম্প্রীতি শূন্যে উড়ে যায়।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।