মুগা খান মসজিদ, চরামদ্দি, বাকেরগঞ্জ

Barisalpedia থেকে

মুগা খান মসজিদ বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরামদ্দি গ্রামে অবস্থিত একটি সুদৃশ্য ঐতিহাসিক মসজিদ। এই মসজিদ প্রতিষ্ঠার সাথে বরিশালের বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইসমাইল চৌধুরীর পরিবারের আদি পুরুষ মুগা খানের নামটি সম্পৃক্ত।

Muga Khan Mosque Resized.jpg

সুগন্ধিয়ার সর্দারদের পূর্ব পুরুষ শ্রাবণ ঠাকুরের পুত্র মুসলমান হয়ে আহম্মদ নাম ধারণ করেন এবং তাঁর কর্তৃক পত্তন গড়া এই গ্রামের নাম হয় চর আহম্মদিয়া, যা বিকৃত হয়ে পরবর্তীতে চরামদ্দি নামের উদ্ভব হয়েছে। তার অধস্তন কারো নিকট থেকে এই তালুক ইঙ্গা খান ও মুঙ্গা খান নামে দুই ভাই ক্রয় করে নেন। তাদের নাম কোথাও ইঙ্গা খান ও মুঙ্গা খান লিখিত আছে, আবার কোথাও আগা খান ও মুগা খান লিখিত আছে। ইঙ্গা ও মুঙ্গা যে দুটি উচ্চারণ-বিকৃত নাম তা সহজেই অনুমেয়, কেননা মুসলমান নাম হিসেবে আরবি বা ফারসি ভাষার কোনো শব্দ এর সাযুজ্য বহন করে না। তাই বর্তমানে মুগা খান নামটিই বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। মুগা খানের পরিবার আদিতে উড়িষ্যার কটক থেকে আগত হলেও তারা দুই ভাই চরামদ্দিতে তালুক ক্রয়ের আগে ফরিদপুরে রবিপুর নামক স্থানে বসবাস করছিলেন। পরে তারা ঝালকাঠিতে ব্যবসা উপলক্ষ্যে স্থিত হওয়ার পরে চরামদ্দিতে তালুক ক্রয় করেন। এই তালুক ক্রয়ের পরে তাদের বিত্তবিভবের উন্নতি হতে থাকে। মুগা খানের পুত্র আবদুর রশিদ খান ও পৌত্র আরমান খানের হাতে এই জমিদারির আরো প্রসার ঘটে। আরমান খান তাঁর পিতামহ মুগা খানের নামে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট। মসজিদের দেয়াল তিন ফুট পরিমাণ পুরু। পূর্ব পাশে তিনটি দরজা রয়েছে।

তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির মাঝের গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ। মেঝ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫ ফুট। মসজিদের ঠিক ওপরে একই সারিতে অবস্থিত। মূল মসজিদটি আয়তাকার। উত্তর দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য ৩৬ ফুট, পূর্ব পশ্চিমে প্রস্থ ১৮ ফুট। ইট, চুন, সুরকি দিয়ে এটি নির্মিত। মসজিদের পূর্বদিক দিয়ে ৩টি খিলান প্রবেশ পথ আছে। দরজার উপরিভাগ অলঙ্কৃত। এর উচ্চতা ৬ ফুট, চওড়া ৩ ফুট। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দু'টি জানালা আছে। আলো বাতাস প্রবেশের জন্যই এরূপ ব্যবস্থা। জানালার উপর-নিচের দৈর্ঘ্য সাড়ে ৪ ফুট এবং চওড়া ৪ ফুট। পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব। এর উপরিভাগ ফুল পাতার নকশায় আচ্ছাদিত। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় অলঙ্করণের ছাপ রয়েছে। মসজিদটির প্রধান আকর্ষণ ভিতরের চার দেয়ালের মাঝবরাবর এক ফুট চওড়া বেড় দিয়ে তার ভিতর কুরআনের আয়াত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সূরা ফাতিহা, ইখলাস, আর রহমান প্রভৃতি সুন্দরভাবে লিখিত। এ মনোমুগ্ধকর শিল্পকর্মটি মসজিদের অভ্যন্তরকে নান্দনিক ও চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে। শিল্পীর এ নিপুণ কলাকৌশল যে কোন দর্শককে মুগ্ধ করে। সেই আমলের একটি রেকাবিও মসজিদের ভিতরে সংরক্ষিত আছে। রেকাবির মধ্যাংশে ক্যালিওগ্রাফি স্টাইলে সূরা ইখলাস লিখিত। মসজিদের পূর্ব ও পশ্চিমপাশের দেয়ালের ওপরে রয়েছে ৪টি করে ৮টি মিনার। গম্বুজ ও মিনারের শিরোভাগে একটি করে পিতলের কলস সংযুক্তি ছিল। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৪টি কলস লক্ষ্য করা যায়। ৫টি চুরি হয়ে গেছে, ২টি ঢিলে হয়ে যাওয়ায় খুলে রাখা হয়েছে। কলসগুলোতে এক সময় স্বর্ণের প্রলেপ ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কালের স্রোতে তা মুছে গেছে। ২০০১ সালে মসজিদ সংলগ্ন ক্বেরাতুল কোরআন হাফিজিয়া মাদরাসা স্থাপিত হয়। মাদরাসার বর্তমান ছাত্রসংখ্যা ৪৫। কয়েকবছর আগে পূর্ব, উত্তর, দক্ষিণদিকে মসজিদের জায়গা সম্প্রসারণে করা হয় এবং মূল মসজিদের সংস্কার করা হয়। সংস্করণের ফলে প্রাচীন চিহ্ন কিছুটা লোপ পেয়েছে। মসজিদের মূল অংশসহ বর্তমান আয়তন দাঁড়িয়েছে ৪৯৪০ বর্গফুট। মসজিদের চার শতাধিক মানুষ একই সাথে সালাত আদায় করতে পারে। তবে প্রধান অংশে দুই সারিতে ৫০ জনের মত মুসুল্লি একত্রে দাঁড়াতে পারে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব পাশেই রয়েছে দ্বিতল একটি ছোট ভবন। ইমাম, মোয়াজ্জেনের থাকার জন্য। মসজিদের দক্ষিণ পাশে গোরস্তান। এখানে শায়িত আছেন মুগা খান, দক্ষিণ বাংলার বিখ্যাত দরবেশ ইয়াকীন শাহ, দানবীর হাজী আছমত আলী খানসহ অনেকে। মসজিদের পূর্ব ফটক বরাবর আঙিনা। এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। আঙিনার পূর্ব দিকেই পুকুর। শান বাঁধানো ঘাট রয়েছে পুকুরে। পুকুরটি মুগা খানের সময়ে খননকৃত। সবচেয়ে আজ ব্যাপার হলো পুকুরের তলদেশও তখন পাকা করা হয়েছিল। এর কারণ সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায়নি। তবে বর্তমানে পুকুরের নিম্নভাগের পাকা ফ্লোরের ওপর কাদামাটির আস্তরণ পড়েছে। তাই পাকা অংশ দেখতে হলে কর্দমাক্ত মাটি উঠিয়ে আরো গভীরে যেতে হবে।

আরমান খানের পুত্র আসমত আলী খানের সময় থেকে এই পরিবার বরিশালে বসবাস শুরু করায় তাঁরা এ অঞ্চলে আর কোনো স্থাপনা বা উন্নয়ন কাজে উদ্যোগী হওয়া থেকে বিরত থাকায় এর পর থেকে এই পরিবারের এ জাতীয় উদ্যোগের বাস্তবায়ন ঘটেছে বেশিরভাগ বরিশাল শহরে। তবে ১৯২৪ সালে আসমত আলী খানের স্ত্রী ওয়াজেদুন্নেসার নামে এখানে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। আর অধুনা ১৯৯২ সালে চৌধুরীদের ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে ফখরুন্নেসা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শোনা গেছে ফখরুন্নেসা ছিলেন ইসমাইল চৌধুরীর বোন।

মুগা খান মসজিদটির সম্প্রসারণ এবং সংস্কারও হয়েছে অতি সম্প্রতি। ২০১৭ সালে শুরু হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এর সম্প্রসারণ ও সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে। সাথে একটি হেফজ মাদ্রাসা ও একটি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দিন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস। প্রথম খন্ড। ভাস্কর প্রকাশনী, ২০১০। ২। স্থানীয় মুরুব্বিদের সাক্ষাৎকার।