মসজিদবাড়ির মসজিদ, মির্জাগঞ্জ

Barisalpedia থেকে

পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে জনৈক ওয়াজিল খান কর্তৃক এই মসজিদ নির্মিত হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে আঠারোশ ষাট সালে সুন্দরবন এলাকা আবাদকালে মাটির নিচে চাপা পড়া অবস্থা থেকে এই মসজিদটি উদ্ধার করা হয়। মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতার নাম জানা গেলেও তার পরিচয় সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তেমন কিছু জানা যায় না।


মসজিদের ঐতিহাসিক পরিচয়

মসজিদ গাত্রে একটি শিলালিপি ছিল। শিলালিপিখানা কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির জাদুঘরে রক্ষিত আছে। কর্নেল লী শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেন। লী’র ইংরেজি অনুবাদ অনুযায়ী শিলালিপিতে লিখিত আছে: রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে কেহ মসজিদ নির্মাণ করবে আল্লাহ তার জন্য সত্তরটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। এই মসজিদ রাজ্যের সুলতান, ধর্ম ও রাষ্ট্রের শক্তিশালী স্তম্ভ, সুলতান মাহমুদ শাহের পুত্র আবুল মুজাফফর বারবাক শাহের রাজত্বকালে ওয়াজিল খানের দ্বারা ৮৭০ হিজরী সনে (১৪৬৫ ইং) নির্মিত’ (এইচ. বেভারিজ) [The prophet of God (on whom be peace & c.) said, Ò Whose buildeth a mosque, God shall build for him seventy palaces. This mosque was build in the reign of the Sultan, the mighty pillar of the church and state, Abbooal-Mozaffar Barkek Shah, Son of the Sultan Mahmood Shah, by Khan Moazzam Ozyal Khan, Year of Hijira 870” (A.D.1465).]।


Mosjidbari.jpg


মসজিদের শিলালিপির তাৎপর্য

ইতিহাসবেত্তারা মসজিদবাড়ীর শিলালিপি মুসলমান কর্তৃক বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ দখলের সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ বলে স্বীকার করেছেন। বরিশালের ইতিহাসে এ শিলালিপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ শিলালিপি ও মসজিদবাড়ীর মসজিদ প্রমাণ করে যে, গৌড়ের সুলতান বরবক শাহের সেনাবাহিনী সাগর উপকূল সুন্দরবন পর্যন্ত পৌছেছিলেন। এ অভিযানের শেষ প্রান্তে সুলতান বরবক শাহ বাকলা দখল করে হিজরি ৮৭০ বা ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে মির্জাগঞ্জ থানার মসজিদবাড়ী গ্রামে এই এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদই চন্দ্রদ্বীপের প্রথম ইটের নির্মিত কীর্তি।


প্রতিষ্ঠাতার পরিচয়

প্রাপ্ত শিলালিপিতে দেখা যায় যে, বরবক শাহ তার নামের সাথে আবুল মুজাফফর উপাধী ব্যবহার করেছেন। আবুল মুজাফফর রুকনউদ্দীন বরবক শাহের স্মরণে ওয়াজিল খান এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ওয়াজিল খানের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়নি। তিনি সুলতান বরবক শাহের সেনাপতি হতে পারেন। চন্দ্রদ্বীপ জয় করে স্থানীয় মুসলমানদের জন্য ওয়াজিল খান ৮৭০ হিজরী বা ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি সুলতানের কর্মচারীও হতে পারেন। অনেকে মনে করেন ওয়াজিল খান একজন আরবীয় বণিক ছিলেন। সুলতানের সাথে তার সুসর্ম্প ছিল। তিনি অন্য বণিকদের নিয়ে এ অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। সুলতানী আমলে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্র্যথমভাগে এ অঞ্চলে মুসলমান বাস করত। তখন কয়েকজন পীর-আউলিয়া চন্দ্রদ্বীপে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কিংবদন্তি আছে-

“আউলিয়া আসেন, নদীপথ বেয়ে আয়লা নদীর বায়,

পটুয়াখালীর প্রথম মুসলিম তারই হয় প্রত্যয়

ছিলেন তখন বরকত শাহ গৌড় মসনদপতি

প্রভাবে যাহার ইসলাম লভে দক্ষিণ বাকলায় স্থিতি”।

১৫ শতকের প্রথমার্ধে খানজাহান আলী সুন্দরবন অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কথিত আছে তার সাথে আগত ৩৬০ জন আউলিয়া তার নির্দেশে সুন্দরবনে বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণ করেন। ওয়াজিল খান হয়ত খানজাহান আলীর প্রেরিত একজন আউলিয়া। হজরত খানজাহান আলী ১৪৫৯ সালে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর ৬ বছর পরে ১৪৬৫ সালে মসজিদ নির্মিত হয়। মির্জাগঞ্জের মসজিদের নির্মাণ কৌশল অপূর্ব। ডঃ দানী বলেছেন, মসজিদের নির্মাণ কৌশল তুঘলকি স্থাপত্যের সাথে সাদৃশ্য আছে।


মসজিদটি হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস

১৫৮৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বাকলা চন্দ্রদ্বীপ বিশেষ করে বর্তমান পটুয়াখালী জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। রাজা কন্দর্প নারায়ণ বাধ্য হয়ে রাজধানী বাকলা থেকে ক্ষুদ্রকাটিতে স্থাপন করেন। প্রাকৃতিক ধ্বংসের পরই শুরু হয় মগ পর্তুগীজদের আক্রমন। ফলে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের প্রায় অর্ধেক এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং আস্তে আস্তে জনপদগুলো সুন্দরবনে পরিণত হয়। পটুয়াখালী জেলার মাধবখালী, মির্জাগঞ্জ, দেউলী, বিবিচিনি, তালগাছিয়া, মোকামিয়া, কারুণা, গুলিশাখালী, গোসলখালী, ফকিরখালী, আউলিয়াপুর, ধূলিয়া প্রভৃতি গ্রাম সুলতানী আমলে মুসলমান অধ্যুষিত ছিল। ১৬ শতকের শেষভাবে এ অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়লে মসজিদবাড়ির মসজিদ জঙ্গলে আবৃত হয়। মসজিদটি যখন আবিষ্কার করা হয় তখন মসজিদে একজন ফকির থাকত। প্রবাদ াাছে সুন্দরবনের বাঘ ফকিরকে পাহারা দিত এবং লেজ দিয়ে মসজিদ পরিষ্কার করত। মিঃ বেভারিজ মসজিদ পরিদর্শন করেন। ১৯০৪ সালে বাকেরগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ বিটসন বেল মসজিদের ভিতর সংস্কার করেন। মনজিদ সংরক্ষণের একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের মসজিদটির দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালী জেলার এই প্রাচীনতম মসজিদ বরিশালের স্থাপত্য শিল্পের প্রথম নিদর্শন।


তথ্যসূত্র: সাইফুল আহসান বুলবুল। বৃহত্তর বরিশালের ঐতিহাসিক নিদর্শন। গতিধারা, ঢাকা। ২০১২।