ফজলুর রহমান খন্দকার, বীরউত্তম

Barisalpedia থেকে

সুবেদার বীরউত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বারো আউলিয়া গ্রামে খন্দকারবাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা খন্দকার আবুল হোসেন, মাতা আমিরুন্নেসা, স্ত্রী মমতাজ বেগম। তাদের তিন মেয়ে। ১৯৭১ সালে খন্দকার ফজলুর রহমান রংপুর ইপিআর উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রথমে সাহেবগঞ্জ এবং পরে পাটগ্রাম সাব-সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর হাতিবান্ধা উপজেলায় পাকবাহিনী ক্যাম্প আক্রমণকালে তিনি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন।

সাতাশে সেপ্টেম্বর ভোররাতে শুরু হয়েছিলো পাক হানাদার বাহিনীর সাথে তীব্র যুদ্ধ। লালমনিরহাটের হাতিবান্দা থানা হেড কোয়াটারে পাকবাহিনী আর এর আধমাইল দূরে সিংমারী বিওপি তে মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স। হাতিবান্দা কলেজ, সিও হেড অফিস আর তিস্তা নদীর পাড় জুড়ে বাঙ্কার তৈরি করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানাদার পাকিস্তানীদের চার কোম্পানী সৈন্য এবং প্রায় দেড় হাজর রাজাকার দোসরদের বিরুদ্ধে হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মাত্র তিনশ মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান বীর বিক্রম। সিংমারা বিওপিতে সুবেদার ফজলুর রহমান, তার পশ্চিমে মোঃ মেজবাহ উদ্দীন, তার পাশে সুবেদার মেজর গোলাম মোস্তফার গ্রুপ। এরপর তিস্তা নদী এবং নদীর ওপারে মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বাধীণ অতিরিক্ত প্রোটেকশন ফোর্স।

সারাদিন তুমুল যুদ্ধ ও গোলাগুলি বিনিময়ের তীব্রতা বিকেলের দিকে কমে আসে। কিছুটা সন্ধ্যার অন্ধকারের সুযোগে পাক বাহিনীর সবচেয়ে কাছে থেকে যুদ্ধে লিপ্ত সুবেদার ফজলুর রহমান নিঃশব্দে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে কয়েকশ গজ এগিয়ে পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করেন। নিজেদের পজিশন সহযোদ্ধাদের জানিয়ে, তারা ফায়ার ওপেন করা মাত্রই পাক হানাদারেরা এ অতর্কিত হামলায় দিশেহারা হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানও অন্যান্য যোদ্ধাদের নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকেন। রাত সাড়ে সাতটার দিকে পাকিস্তানীদের গোলন্দাজ বাহিনী সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে অগ্রগামী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপকভাবে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করে। ক্যাপ্টেন মতিউর দুশমনদের প্রচন্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের সংহত রাখার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালান। বাংকার হতে বাংকারে গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরতে ঘুরতে যুদ্ধ পরিচালনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল জোগাতে থাকেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে অয়ারলেসে নিজের আহত হওয়ার খবর দিয়ে সুবেদার ফজলুর রহমান জানালেন পাঞ্জাবীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে তার বাহিনীর একজন শহীদ হয়েছেন। বাকীরা জীবন বাজী রেখে লড়ছেন। আঘাতের অবস্থা সম্পর্কে মতিউরের জিজ্ঞাসার জবাবে সুবেদার ফজলুর রহমান অয়ারলেসে জানান তার জন্যে চিন্তা করতে হবে না। সঙ্গীদেরকেও একথা জানানোর দরকার নেই। ছ’শ গজ পেছনের অবস্থান হতে একথা শুনে ক্যাপ্টেন মতিউর বুঝতে পারলেন আঘাত গুরুতর। তাই তিনি আরেকজনের উপর আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে তুমুল লড়াইয়ের মধ্যেই এগুতে থাকেন সুবেদার ফজলুর রহমানের বাংকারের দিকে। কিন্তু তখন তার জীবন দীপ ক্রমশই নিভে আসছে। কিছুক্ষণ পর যখন সমস্ত বাঁধাবিঘ্ন অতিক্রম করে সাহসী সেনাপতি ক্যাপ্টেন মতিউর পৌঁছালেন বীর সহযোদ্ধার পাশে তখন দেখলেন ফজলুর রহমান আর বেচে নেই। টানা আরো দুদিন ধরে চললো প্রচন্ড লড়াইয়ের পর হাতিবান্ধা মুক্ত হলো।

এ যুদ্ধে ফজলুর রহমান ও হাবিলদার রঙ্গু মিয়াসহ আরো ছয়জন বীর বাঙালি শহীদ এবং তিরিশ জন আহত হয়েছিলেন। খন্দকার ফজলুর রহমান ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিবান্ধা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তাঁর এই বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ‘বীরউত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁর বীরউত্তম সনদ নম্বর-৪৩।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫। ২। তথ্যসূত্র: রুসেলি রহমান চৌধুরী। বরিশালের প্রয়াত গুণীজন। ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিশার্স, ঢাকা। ২০০৬।