জয় নারায়ণ, রাজা

Barisalpedia থেকে

রাজা জয়নারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের সপ্তদশ রাজা। তাঁর রাজত্বকাল ১৭৭৭-১৮১৩। কার্যার্থে তিনিই চন্দ্রদ্বীপের শেষ রাজা, কারণ তাঁর রাজত্বকালে ১৭৯৯ সালে চন্দ্রদ্বীপ পরগণা নিলামে ওঠে এবং কার্যত চন্দ্রদ্বীপ রাজত্ব হারিয়ে যায়।


রাজ্য বা জমিদারি লাভ

শিবনারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ রাজত্ব লাভ করেন। তিনি অল্প কয়েক দিন রাজত্ব করার পর দেহ ত্যাগ করেন। রানী দুর্গাবতী এ সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তখন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের ৭ লক্ষ টাকা রাজস্ব বাকি ছিল। রাজার দেওয়ান রামজীবন চক্রবর্তী সনদের নবায়নের জন্য ঢাকা ও কলিকাতায় গমন করেন। তিনি ১৭৭৮ খৃৃস্টাব্দে রাজস্ব পরিশোধ করেন এবং রাজার কোন পুত্রসন্তান না থাকায় দুর্গাক্রোড় নারায়ণ নামে সনদ প্রদান করে, কারণ রানী দুর্গাবতী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। সেই জন্য রাজা জয়নারায়ণের আর এক নাম দুর্গাক্রোড় নারায়ণ ওরফে দুর্গাকুর নারায়ণ। শিবনারায়ণের মৃত্যুর কয়েক মাস পরে জয়নারায়ণের জন্ম হয়।


মাতা দুর্গাবতীর রাজ্য পরিচালনা

জয়নারায়ণ শিশু থাকায় রানী দুর্গাবতী রাজ্য পরিচালনা করতেন। এ সুযোগে দেওয়ান শিবশংকর অনেক অর্থ ও ভূসম্পত্তি দখল করে নেয়। শিবশংকর রাজ্যের মধ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে এবং রানী তাকে দমন করতে ব্যর্থ হন। রানী কোম্পানির দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দের সাহায্য কামনা করেন এবং ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বর সনদপ্রাপ্ত হন। এ সনদে ঢাকার প্রাদেশিক কাউন্সিলের সিলমহর ও ঢাকার প্রধান হল্যান্ডের সই আছে। শিবশংকর নলচিড়া হতে প্রথমে কাশীপুর এবং পরে ঝালকাঠির হোসেনপুরে বসতি স্থাপন করেন। তিনি হোসেনপুরের বকশীদের আদি পুরুষ। ইংরেজ সরকার রানীর রাজ্য পরিচালনায় অহেতুক হস্তক্ষেপ করত। বরিশালের ফৌজদার বকশ আলী চন্দ্রদ্বীপ পরগণার শাসন কার্যে বাধা সৃষ্টি করেন। তাই রাজা ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর বকশ আলীর বিরুদ্ধে কোম্পানির নিকট অভিযোগ করেন। ১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে ঢাকার কালেক্টর মি. ডে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ করেন এবং দুর্ভিক্ষ সত্ত্বেও ডে ১৭৮৮ খৃৃস্টাব্দে ১৫ হাজার টাকা রাজস্ব বৃদ্ধি করেন এবং ৭৩টি তালুকের পৃথক রাজস্ব নির্ধারণ করেন।


কালেক্টর ডগলাসের রিপোর্টে জয় নারায়ণ

১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল ঢাকার কালেক্টর মিঃ ডগলাস চন্দ্রদ্বীপের দশসালা বন্দোবস্ত সম্পর্কে কলিকাতা বোর্ড অব রেভিনিউর নিকট যে প্রতিবেদন প্রেরণ করেছিলেন তাতে তিনি লিখেছিলেন। “এ পরগণার (চন্দ্রদ্বীপ) মালিক ১৭ বছরের এক যুবক। তার লেখাপড়ার প্রতি কোন দৃষ্টি দেয়া হয়নি। তিনি মফস্বলের রাজস্ব আদায় সম্পর্কে কিছুই জানেন না। নারী উপভোগে তার সম্পূর্ণ সময় ব্যয় হয়। জমিদারী পরিচালনার ক্ষমতা নিজ হাতে রাখার জন্য তার মা তার লালসা নিবৃত্ত করার সব কিছু সরবরাহ করে থাকেন। মা জমিদারী পরিচালনার ক্ষমতা তার ভ্রাতার ওপর অর্পণ করেছেন। অথচ তার ভ্রাতা এ পদের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।” রানী দুর্গাবতী ও রাজা জয়নারায়ণ সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করে ডগলাস সাবেক কালেক্টর ডে নির্ধারিত রাজস্ব দশসালা বন্দোবস্তের সুপারিশ করেন। রানী ও তার পুত্র জয়নারায়ণের যে সমালোচনা ডগলাস করেছেন তা সত্য নয়। ১৭৯০ খৃৃস্টাব্দে জয়নারায়ণের বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। মা তার নিজপুত্রকে নষ্ট করার জন্য ডগলাস বর্ণিত কাজ করতে পারেন না।


মি. ডে কর্তৃক চন্দ্রদ্বীপের রাজস্ব বৃদ্ধি

১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে চন্দ্রদ্বীপের ভূমি রাজস্ব ছিল ৮৫,৭২৫ টাকা। ডে তার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রস্তাবে হিস্যাজাত ভূমির জন্য ১৫০০০ টাকা বৃদ্ধির সুপারিশ করেন এবং বোর্ড এ প্রস্তাব অনুমোদন করে। ডগলাস ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর চন্দ্রদ্বীপের জমিদার জয়নারায়ণকে ডে’র প্রস্তাব মতে বন্দোবস্ত করার জন্য আহ্বান জানান। চন্দ্রদ্বীপ হতে ৭৩টি তালুক পৃথক করা হয়। তাই রানী ইংরেজ সরকারের অবস্থায়ী বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন।


জয়নারায়ণকে গ্রেফতারের সমন

১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর ঢাকার কালেক্টর মিঃ মেসি এক পত্রে জানান যে, চন্দ্রদ্বীপ পরগণা নিলামে বিক্রি করা হয়েছে এবং তখনও ৩৫০০০ টাকা রাজস্ব বাকি ছিল। এজন্য মেসি রাজা জয়নারায়ণকে ঢাকায় সিভিল জেলে আটক করার জন্য রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন চেয়েছেন। মেসি লিখেছেন ‘তিনি তার অবাধ্যতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং আমার বিশ্বাস তাকে দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করলে এ জেলায় ভাল ফল হবে। মিঃ মেসি রাজা জয়নারায়ণকে গ্রেফতারের জন্য সমনসহ একজন পেয়াদা পাঠিয়ে দেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে রানী দুর্গাবতী গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে এক পত্র দেন। পত্রে তিনি লিখেন- ‘রাজা যে কত অসুস্থ তা আমি কি করে বর্ণনা দেব। সমস্ত জমিদারী বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। রাজা অসুস্থ। আমি সীমাহীন দুঃখে পতিত হয়েছি। আপনি দেশের প্রভু। আমার বিশ্বাস একজন গরীব বিধবার উপর দয়াপরবশ হয়ে আপনি জরিমানা মাফ করে দিবেন। যে প্রকারে হোক আমি দেয় টাকা পরিশোধ করবো।’ মিঃ মেসি রাজাকে গ্রেফতার করেননি। তবে তার কঠোর ব্যবস্থার জন্য চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য ধ্বংস হয়ে যায়।


চন্দ্রদ্বীপের রাজ্যের পতন

১৭৯৯ খৃৃস্টাব্দে খাজনার দায়ে চন্দ্রদ্বীপ পরগণা নিলামে বিক্রি হলে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের শেষ চিহ্ন মুছে যায়। ইতোপূর্বে ১৭৯৩ খৃৃস্টাব্দে পরগণার ১৭।// ক্রান্তি ঢাকা কালেক্টরিতে বিক্রি হয় এবং বর্মণদের পূর্বপুরুষ দালসিং তা ক্রয় করেন। ১৭৯৫ খৃৃস্টাব্দে সাড়ে বারো গণ্ডা নিলামে বিক্রি হলে ঢাকার জন পেনেটি তা ক্রয় করেন। ১৭৯৭ খৃৃস্টাব্দে সাড়ে সতেরো গণ্ডা বিক্রি হয় এবং তা-ও পেনেটি ক্রয় করে। রানী দুর্গাবতী সরকারের দেয় রাজস্ব পরিশোধ করার জন্য তার ভাই ও অন্যান্য অসৎ কর্মচারীর নিকট যে টাকা দিতেন তা তারা কালেক্টরেটে জমা না দিয়ে আত্মসাত করে। এভাবে বাকি রাজস্বের দায়ে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে, বঙ্গাব্দ ১২০৬ সনে অবশিষ্ট ১২ গণ্ডা জমিদারী ঢাকা কালেক্টরিতে নিলামে বিক্রি হয়। নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণ চন্দ্রদ্বীপের জমিদারী নিলামে ক্রয় করেন। রাম মানিক মুদি ১২ গণ্ডা, জন পেনেটি ১০ গণ্ডা এবং দাল সিংহ ১৭ গন্ডা।

জমিদারি উদ্ধারের মামলা

রাম মানিক মুদি বা মানিক মুদি চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের খানাবাড়ির মুদি দোকানদার ছিলেন। মিঃ পেনেটি রাজস্ব বোর্ডের নিকট এক অভিযোগে বলেছিলেন যে, মানিক মুদি রাজার পক্ষে চন্দ্রদ্বীপ পরগণা ক্রয় করেছেন। স্থানীয় বিশ্বাস মানিক মুদি রাজার পক্ষে জমিদারী ক্রয় করেন। মানিক মুদি ঢাকা থেকে ফিরে এসে এক আনা রেখে বাকি জমিদারী রাজাকে ফেরত দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজার পারিষদ রানী দুর্গাবতী ও জয়নারায়ণকে বুঝালেন যে, মুদির সাথে জমিদারী করা যায় না। তাই রাজা জমিদারী উদ্ধারের জন্য দেওয়ানী মামলা শুরু করেন। সুপ্রীমকোর্টে রাজা হেরে যান এবং বিলেতে প্রিভিকাউন্সিলে আপীল করেন। সম্ভবত সুপ্রীমকোর্টের রায়ের পর রানী দুর্গাবতী মৃত্যুবরণ করেন।


জয়নারায়ণের মৃত্যু

রাজা জয়নারায়ণ শোক দুঃখে ১৮১৩ খৃৃস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন। জয়নারায়ণ চন্দ্রদ্বীপ রাজ বংশের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৮০২ খৃৃস্টাব্দে বাকেরগঞ্জের জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট উইল্টন রাজা দুর্গাকুর বা জয়নারায়ণকে জেলার একমাত্র সম্মানিত ব্যক্তি বলে উল্লেখ করেছেন। জয়নারায়ণ চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ রাজা। রাজা দনুজমর্দন যে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সূচনা করেছেন সে রাজ্য জয়নারায়ণের সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।