চরবাড়িয়ার যুদ্ধ ১৯৭১

Barisalpedia থেকে

চরবাড়িয়ার যুদ্ধ বরিশালে পাকবাহিনী প্রতিরোধের প্রাথমিক পর্বে সংঘটিত একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ।


প্রতিরোধের প্রস্তুতি

চরবাড়িয়া বরিশাল সদর থানার একটি ইউনিয়ন। ইউনিয়নটি বরিশাল পৌরসভা সংলগ্ন। লামচরী, তালতলী, চরবাড়িয়া, মহাবাজ, উলানঘুনী, মতাসার, কাগাশুরা, বাটনা, আমীরগঞ্জ, প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন। ইউনিয়নের উত্তরে তালতলী ও জুনাহার নদী। উভয় নদী আড়িয়াল খা ও কীর্তনখোলা নদীর শাখা। পূর্বে ঢাকা থেকে লঞ্চ-স্টীমার মেঘনা নদী হয়ে নয়াভাঙ্গলী, ছবিপুর, নন্দীর বাজার, সায়েস্তবাদ হয়ে বরিশাল যেত। জুনাহার নদী হয়ে লঞ্চ-স্টীমার হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ ও খুলনা যাতায়াত করত।

১৯৭১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে বরিশাল সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হয়। প্রতিরক্ষা প্রধান ছিলেন মেজর জলিল। বরিশাল শহরতলিতে অবস্থিত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মহাবাজ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রায় ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পে অবস্থান করে। ক্যাম্প পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম ও সুবেদার পঞ্চম আলী। সায়েস্তাবাদ হাইস্কুলে ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন আনসার কমান্ডার আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার।

নদীপথে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য বরিশাল শহর থেকে ৫ মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে জুনাহারে আরেকটি একটি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। সায়েস্তাবাদের রাজাপুর বাহিনগর ও চরবাড়িয়া গ্রামে সিভিল ডিফেন্স প্রধান হাসান ইমাম চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংকার তৈরি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ সকল বাংকারে অবস্থান নেয়। জুনাহারের সংযোগ স্থলের দু’পাশে ইরানী ও মাজবী নামের ২টি স্টীমার পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য রাখা হয়। স্টীমারে আইডব্লিউটিএর একটি ওয়ারলেস ছিল। ওয়ারলেসের দায়িত্বে ছিল ছাত্র শাহনেয়াজ। মেজর জলিল জীপ ও স্পীডবোটে জুনাহার পরিদর্শন করতেন।


যুদ্ধের বর্ণনা

২৫ এপ্রিল খবর এলো পাকাবাহিনী গানবোটে আসছে। মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত। গানবোটগুলো সায়েস্তাবাদ অতিক্রম করছে এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করে। সাথে সাথে পাকবাহিনী প্রচন্ড শব্দে ইরানী ও মাজবী স্টীমার আক্রমণ করে ডুবিয়ে দেয়। পাক নৌবাহিনীর ভারী অস্ত্রের আঘাতে মুক্তিবাহিনীর বাংকার ও অবস্থান ধ্বংস হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমামের নেতৃত্বে পিছু হটে যায় এবং সায়েস্তাবাদ ও চাঁদপাশায় আশ্রয় নেয়। ঠাকুর মল্লিকের খলিলুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর পরিত্যক্ত অস্ত্র, গোলাবারুদ ঠাকুর মল্লিক গ্রামে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা হয়। জুনাহারে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাক সেনারা ঢাকায় যোগাযোগ করে। সৈন্যবোঝাই দুটি হেলিকপ্টার আধঘন্টার মধ্যে তালতলীর পূর্ব পাশে মাঠে অবতরণ করে। তিনবার ছত্রী সেনা নামানো হয়। পাকবাহিনী নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনীর সমন্বয়ে বরিশাল আক্রমণ করতে থাকে। তালতলীর পশ্চিমে গানবোট নোঙর করা হয়। তারা গানবোট থেকে ভারী অস্ত্র নামিয়ে আনে। তারা প্রচন্ডভাবে গুলিবর্ষণ করে। কামানের গুলি ৫/৬ মাইল দূরে পড়তে থাকে। সমগ্র এলাকায় ভয়ঙ্কর ভীতি ও আতঙ্ক চলছে। পাকসেনারা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই গুলি করে হত্যা করছে। পাকবাহিনী মহাবাজে নাজিরবাড়ির মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। ৩ ঘন্টা যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যায়। পাকসেনারা চরবাড়িয়া, কাগাশুরা, সাপানিয়া, পুরানপাড়ায় গণহত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চরবাড়িয়া ইউনিয়ন জনশূন্য হয়ে পড়ে। বরিশাল শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরে যায়।


ধ্বংসযজ্ঞ

২৫ এপ্রিল চরবাড়িয়ার ভয়ঙ্কর দিন। এদিনের বর্বরতা, জঘন্য হত্যাকান্ড ইতিহাসে বিরল। সারাদিন চরবাড়িয়ার হত্যাকান্ড চলে। পাক বর্বর বাহিনী বাড়ি বাড়ি ঢুকে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিমেষে হত্যা করে। ৯০ বছরের বৃদ্ধাকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। ট্রেঞ্চ ও সদ্য খনন করা পুকুরে যারা আশ্রয় নেয় তাদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। এডভোকেট আবদুর রশীদ ও তার স্ত্রী শিশুপুত্রসহ পুকুরে পালিয়েছিল। পাকসেনারা তাদের গুলি করে গুরুতর আহত করে। তাদের শিশুপুত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মায়ের কোলে মৃত্যুবরণ করে। মা-বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছে, ৮ মাসের শিশু মায়ের কোলে নিহত হয়েছে। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। অসুস্থ ৯০ বছরের ইমামউদ্দিন হাওলাদার নিজ ঘরে শুয়ে ছিল। নরপশুরা ঘরে ঢুকে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। চরবাড়িয়ার আবদুর রহমান খানের বাড়ির একটি পুকুর পুনর্খনন করা ছিল। গানবোটের গোলাগুলির শব্দ শুনে পুকুরে আশ্রয় নেয় সলিমুদ্দিন, আবদুর রহমান, আলী আকবর এবং জাবেদ আলী। পাকবাহিনী গানবোট থেকে উঠেই তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে হত্যা করে। সামসুদ্দিন বেঁচে যায়। আবদুর রহমান খানকে নিজ হাতে খননকৃত ট্রেঞ্চে মাটি দেয়া হয়। তালতলী মসজিদের ইমাম মুন্সী আলী আজিম খান পাকবাহিনীর সামনে পড়ে যান। পাকবাহিনী তাকে গুলি করে। স্ত্রী আমেনা দূর থেকে এ দৃশ্য দেখেন। পাকসেনারা চলে গেলে স্বামীকে কোলে তুলে নেন এবং কোলেই স্বামীর মৃত্যু হয়। সেতারা ও সুফিয়া দুই বোনকে গুলি করে হত্যা করে, তাদের কোলে ছিল বড় বোনের ২ বছরের ছেলে। ছেলেটি ছিল খালাদের মৃতদেহের উপরে। ২৫-২৬ এপ্রিল রাতে মৃতদেহ ব্যতীত কেউ ছিল না চরবাড়িয়া ইউনিয়নে। সকলে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়। তালতলীর ডা. সৈয়দ জাফর আলী কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসা করেন।


শহীদদের তালিকা

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী তালতলী-চরবাড়িয়া ইউনিয়নে নিম্নলিখিত গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে। শহীদদের নাম, পিতার নাম, গ্রামের নাম, বয়স- এই ধারাক্রমে শহীদগণের তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হলো।

১. ইমাম উদ্দিন হাওলাদার, সেফের উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৯০ বছর। ২. মুন্সী আলী আজিম খান,নবী খান, কাপাসিয়া, ৬৫ বছর। ৩. আবদুর রহমান খান, শহীদ আলী আজিম খান, চরবাড়িয়া, ৪৫ বছর। ৪. জবান আলী হাওলাদার, নঈম উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৫০ বছর। ৫. জালালউদ্দিন হাওলাদার, ফয়জদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৫৪ বছর। ৬. লালবড়ু বেগম, স্বামী-শহীদ জালালউদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৪৯ বছর। ৭. রহিমা বেগম স্বামী-জব্বার হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ২২ বছর। ৮. চানবড়ু, স্বামী- ছত্তার হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৩০ বছর। ৯. বাচ্চু, ছত্তার হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ১০ বছর। ১০. আবদুল ওহাব, হাতেম আলী হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৩৫ বছর। ১১.পলাশ, এড. আবদুর রশীদ হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৮ মাস ৮ দিন। ১২. আবুল ফজল রাঢ়ী, জয়নাল আবেদীন রাঢ়ী, চরবাড়িয়া, ২৫ বছর। ১৩. ময়না বিবি, আবদুল ওহাব খান, চরবাড়িয়া, ১৬ বছর। ১৪. মুজাহার আলী হাওলাদার, নূর মোহাম্মদ, চরবাড়িয়া, ২৭ বছর। ১৫. হাসান আলী হাওলাদার, জিন্নাত আলী হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৩৫ বছর। ১৬. ফজলে আলী হাওলাদার, আবদুল লতিফ হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ২৫ বছর। ১৭. আবদুস ছত্তার রাঢ়ী, আবদুল আজিজ রাঢ়ী, চরবাড়িয়া, ২৫ বছর। ১৮. আলফানুন নেসা, স্বামী- আঃ আজিজ রাঢ়ী, চরবাড়িয়া, ৫৫ বছর। ১৯. আ. ওয়াহেদ হাওলাদার , ছবেদ আলী হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ৩৫ বছর। ২০. এসাহাক হাওলাদার, - , চরবাড়িয়া ২৫ বছর। ২১. রিজিয়া বেগম, স্বামী- শহীদ ইসহাক হাওলাদার, চরবাড়িয়া, ২২ বছর। ২২. হুমায়ুন রাঢ়ী, আবদুস ছত্তার রাঢ়ী, চরবাড়িয়া, ২ বছর। ২৩. আঞ্জুমান নেছা, স্বামী- হোসেন উদ্দিন হাওলাদার, চরবাড়িয়া। ২৪. সেতারা বেগম, স্বামী- মুনসুর ফকির, চরবাড়িয়া, ১৬ বছর। ২৫. সাফিয়া বেগম, পিতা- আরজ আলী, চরবাড়িয়া, ২২ বছর। ২৬. জবেদ আলী, আদম আলী, চরবাড়িয়া, ৪০ বছর। ২৭. আঃ ওয়াজেদ হাওলাদার, হাসেম আলী হাওলাদার, সাপানিয়া, ১৫ বছর। ২৮. চান শরীফ, নীল শরীফ, সাপানিয়া, ৫৫ বছর। ২৯. আবদুল বারী, আকরাম আলী হাওলাদার, উলালঘুনী, ৪০ বছর। ৩০. আতাহার আলী হাওলাদার, হাশেম আলী হাওলাদার, উলালঘুনী, ৩৪ বছর। ৩১. মোঃ সুলতান হাওলাদার, আবদুল গনি হাওলাদার, উলালঘুনী, ২৮ বছর। ৩২. মোঃ শাহজাহান মীর, খোরশেদ মীর, চরবাড়িয়া, ২৪ বছর। ৩৩. মতলেব আলী খান, সরুব আলী খান, চরবাড়িয়া, ২২ বছর। ৩৪. নয়ন হাওলাদার, জাফর আলী হাওলাদার, বাঢ়ীমহল, ১২ বছর। ৩৫. এএফএম আলী আকবর, আবদুল মজিদ মিয়া, আমানতগঞ্জ, - । ৩৬. ছফুরজান বিবি, গহের আলী মীর, চরবাড়িয়া, ৫০ বছর। ৩৭. কাবিল খান, - ,কর্ণকাঠি, ৫০ বছর। ৩৮. আবদুর রশীদ হাওলাদার (আনসার কমান্ডার), আকতার উদ্দিন হাওলাদার, খালেদাবাদ, ৩০ বছর। ৩৯. মোঃ আনোয়ার হোসেন (প্রাক্তন সৈনিক), এন্তাজউদ্দিন, হোসনাবাদ, ২৫ বছর। ৪০. আবদুল মালেক গাজী, রত্তন গাজী, উলালঘুনী, ২৮ বছর। ৪১. রকমত আলী, আবদুল জব্বার হাওলাদার, পুরানপাড়া, ৪০ বছর। ৪২. মোঃ জালাল আহমদ, আ. ছত্তার হাওলাদার, কাগাশুরা, ২০ বছর। ৪৩. জামাল, হাসমত আলী, চরবাড়িয়া, ২ বছর ৬ মাস। ৪৪. মোতালেব হাওলাদার (ইপিআর), আদম আলী হাওলাদার, মতাসার, ৪০ বছর। ৪৫. কাজেম আলী, -, কেয়াজংগী, ৩৪ বছর।

এছাড়াও ৪ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। তাদের গণকবর দেয়া হয়। বরিশাল থেকে পালিয়ে তালতলীর পথে অনেকে নিজবাড়িতে ফিরছিলেন। তারা অনেকে নিহত হয়েছেন। পাকবাহিনীর গুলিতে ২৪ জন গুরুতর আহত হয়। তারা চিকিৎসার পর বেঁচে যায়। বরিশাল বারের এডভোকেট আবদুর রশীদ ও তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন উভয়ে গুলিবিদ্ধ হন। তাদের শিশুপুত্র পলাশ গুলিবিদ্ধ হয়ে মায়ের বুকে মৃত্যুবরণ করেন। মা রাবেয়া খাতুন গুলিবিদ্ধ হয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকেন। পাকবাহিনী চরবাড়িয়া ইউনিয়নে ৬৬ টি বাড়ি পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫।