ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা সি এস

Barisalpedia থেকে

সি এস বা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে (Cadastral Survey) নামে পরিচিত ১৯০০-১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ভূমি জরিপ বাকেরগঞ্জের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। বরিশালের জনগণের নিকট এ জরিপ ‘সিএস’ বা ‘১৩১০ সনের বা সংক্ষেপে দশসনা রেকর্ড’ বলে পরিচিত। গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের মুখেও জমিজমা সম্পর্কে সিএস অর্থাৎ ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভের পর্চার কথা অহরহ বলতে শোনা যায়।


ব্যুৎপত্তিগত অর্থ

ক্যাডাস্ট্রাল (Cadastral) শব্দটি ইংরেজি ‘ক্যাডাস্টার’ (Cadastre) এর বিশেষণ রূপ। ‘ক্যাডাস্টার’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ‘কাটা’ ও ‘স্টিখন’ শব্দের যৌথ রূপ থেকে। গ্রিক ‘কাটা’ - ‘স্টিখন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো ‘একের পর এক সজ্জিত’ (organised line by line)। এই ব্যুৎপত্তির ভিত্তিতে বলা যায়, যে জরিপের মাধ্যমে জমির অবস্থান ও হস্তান্তরযোগ্যতার সকল তথ্য একত্রিত ও সংক্ষিপ্ত রূপে এক কাগজে উপস্থাপন করা হয় সেটিই ক্যাডাস্ট্রাল জরিপ।


পটভূমি

বাকেরগঞ্জের ইতিহাসে এই রকম জরিপ প্রথম হয় ১৯০০ থেকে ১৯০৮ সাল ধরে। এই জরিপ বেশ প্রয়োজন ছিল কৃষকদেরকে দখলি স্বত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করতে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জেলার ভ‚মি ব্যবস্থায় অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। কৃষকরা তাদের ভ‚মিস্বত্ব সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল। জমিদার ও তালুকদাররা যখন কোর্টে খাজনার দায়ে প্রজা উৎখাতে মামলা করত তখন প্রজারা তাদের দখলী স্বত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হতো। কারণ তাদের নিকট কোন প্রামাণ্য মৌজা ম্যাপ ও স্বত্ব প্রমাণের কাগজপত্র থাকত না। ফলে ভ‚মি দখল নিয়ে দাঙ্গা ও খুন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই জরিপের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের মদ্যে বিরাজমান এ অসন্তোষ দূর করা।


জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম

ইদিলপুর পরগণার জমিদার সুরেন্দ্র মোহন ঠাকুর ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে ভূমি জরিপের জন্য ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের নিকট দরখাস্ত দাখিল করেন। ইতিপূর্বে বাকেরগঞ্জের জেলা কালেক্টর বিটসন বেল ও ঢাকার কমিশনার মি. ল্যানসেট হেয়ার সমগ্র জেলা জরিপের জন্য রাজস্ব বোর্ডের নিকট প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলেন। এসবের প্রেক্ষিতে সরকার বাকেরগঞ্জ জেলার ভ‚মি জরিপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ২৩ নভেম্বর বিটসন বেল বাকেরগঞ্জের সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ মিঃ জে সি জ্যাকের নিকট দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ডাইরেক্টর অব ল্যান্ড রেকর্ড হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মিঃ জ্যাক এ পদে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন। মিঃ ইসকিলিং, বার্কলি, জনসন ও বেডফোর্ড ট্রাভারস জরিপ ও ক্যাডাস্ট্রাল জরিপের কাজ করেন।


সার্বিক কর্মযজ্ঞ

৪৫ জন ডেপুটি কালেক্টর ও সাব ডেপুটি কালেক্টর বিভিন সময় সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে জরিপ কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ ছাড়া ছিল ২৮ জন রাজস্ব অফিসার, কানুনগো ও কয়েক শ’ আমিন ও চেনম্যান। ডেপুটি কালেক্টর বাবু পিয়ারী মোহন বসু, জ্ঞানেন্দ্রনাথ রায, যোগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী, খান বাহাদুর আবদুল মমিন, খান বাহাদুর আতাউর রহমান বাকেরগঞ্জের জরিপ কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর জরিপের প্রথম ঘোষণা গেজেট প্রকাশিত হয়। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রæয়ারি মাসে বামনা থানায় প্রথম জরিপ শুরু হয়। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুলাই জরিপের প্রকাশনা শুরু হয় এবং ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রকাশনা ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে শেষ হয়। জে সি জ্যাক বাকেরগঞ্জের জরিপ ও ভ‚মি বন্দোবস্তের রিপোর্ট লেখা শেষ করেন এবং তা ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। বাকেরগঞ্জের জরিপ পরিচালনায় সরকারের মোট ব্যয় হয়েছিল ২৮,৩৩,১২১ টাকা। এ ব্যয়বহুল মূল্যবান জরিপের প্রতিবেদন লিখে মিঃ জেসি জ্যাক অসংখ্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সরকারের সচিব মিঃ লি বার্লি বলেছেন, মিঃ জ্যাকের চ‚ড়ান্ত রিপোর্ট একমাত্র বাকেরগঞ্জের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট আছেন তারাই স্বাগত জানাবেন না বরং যারা গ্রামবাংলাকে জানতে চান এবং যারা উন্নত সাহিত্য পছন্দ করেন তারা সকলে স্বাগত জানাবেন।


জরিপের তথ্য সংক্ষেপ

বাকেরগঞ্জ জেলার ১৯০০-০৮ খ্রিস্টাব্দের জরিপ এ জেলাবাসীদের জন্য একটি অমূল্য দলিল। মিঃ জ্যাকের প্রণীত বাকেরগঞ্জের জরিপের পরিশিষ্টসহ প্রায় ৪শ’ পৃষ্ঠাব্যাপী প্রতিবেদনে জেলার গ্রামীণ জীবন ফুটে উঠেছে। আজ পর্যন্ত বরিশাল সম্পর্কে এমন তথ্যবহুল কোন রিপোর্ট রচিত হয়নি। এ জরিপের মোট কৃষিভ‚মির পরিমাণ ছিল ১৯,০৯,১৯৬ একর। শতকরা ৯০ ভাগ ভূমিতে ধান উৎপন্ন হতো। শতকরা ১১ ভাগ ভূমিতে সুপারি ও নারিকেল প্রাভূতি ফলমূলের বাগান ছিল। প্রতি একরে ১২ হতে ১৭ মণ চাল বা গড়ে ২২ মণ ধান উৎপন্ন হতো। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে ১৮ লক্ষ লোক কৃষিজীবী ছিল। গড়ে একরে ১৬ মণ আমন ও ১০ মণ আউশ চাল উৎপন্ন হয়। জনপ্রতি তিন পোয়া চাল এবং একরপ্রতি ২০ সের ধান রেখে এক কোটি মণ চাল প্রয়োজন হতো। মোট উৎপন্ন চালের শতকরা ৪৪ ভাগ বাড়তি ছিল। এক কোটি মণ চালের মধ্যে ৭০ লক্ষ মণ রপ্তানি হতো। জরিপের সময় জেলার কৃষিদ্রব্যের মোট মূল্য ছিল ৯ কোটি টাকা। কৃষক সম্প্রদায় বছরে জমিদার-তালুকদারদের রাজস্ব পরিশোধ করত ৯০ লক্ষ টাকা। দেয় রাজস্ব মোট উৎপন্ন মূল্যের শতকরা ১০ ভাগের কম ছিল।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।