উৎপল দত্ত

Barisalpedia থেকে

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যব্যক্তিত্ব ও শেক্সপিয়ার বিশেষজ্ঞ। তাঁর আদি পৈতৃক নিবাস বরিশালে। পিতা পুলিশ অফিসার গিরিজারঞ্জন দত্তের কর্মস্থলের কারণে জন্ম শিলং-এ। মাতার নাম শৈলবালা। জন্মতারিখ ২৯ মার্চ ১৯২৩ এবং মৃত্যু তারিখ ১৯ আগস্ট ১৯৯৪।


শিক্ষা

উৎপল দত্ত কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজের কৃতী ছাত্র ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ইংরেজিতে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ইংরেজি ছাড়া হিন্দি, স্প্যানিশ, ফরাসি, জার্মান, ল্যাটিন প্রভৃতি ভাষাও ভালো জানতেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত সাউথ পয়েন্ট স্কুলে ইংরেজির শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্রাবস্থায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্সের বন্ধুদের নিয়ে তিনি ‘দি শেক্সপিয়রিয়ান’ নাম দিয়ে থিয়েটারের দল গঠন করেন। তাঁর পরিচালনায় সেখানে প্রথম অভিনীত নাটক ‘রিচার্ড দি থার্ড’-এর নামভূমিকায় ছিলেন তিনি।


নাটক ও অভিনয়

জেফ্রি কেন্ডাল তাঁর বিখ্যাত ‘শেক্সপিয়রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’ নিয়ে কলকতায় এলে উৎপল দত্ত সেখানে যোগ দিয়ে অভিনয় শিক্ষা করেন। এই কোম্পানির সঙ্গে তিনি ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ এবং ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের বহু অঞ্চল নাট্যাভিনয় করেছেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘দি শেক্সপিয়রিয়ান’ নাট্যগোষ্ঠী নতুন নাম গ্রহণ করে- ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি প্রধানত ইংরেজি নাটক প্রযোজনা ও অভিনয় করে গেছেন। এরই মধ্যে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে সলিল চৌধুরী ও নিরঞ্জন সেনের আগ্রহে গণনাট্যে যোগ দেন। এখানেই তিনি প্রথম বাংলা নাটক ‘ম্যাকবেথ’ রচনা ও অভিনয় করেন। যদিও সেখানে তাঁর প্রথম অভিনয় ‘ভাঙা বন্দর’ নাটকে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিজের পরিচালনায় তিনি বাংলা মৌলিক ও অনূদিত নাটক মঞ্চস্থ করতে থাকেন। তাঁর নাট্যগোষ্ঠীতে রবি ঘোষ, শোভা সেন, নীলিমা দাস, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, শেখর চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যোগ দেন। একে একে ‘নীচের মহল’, ‘ছায়ানট’ (১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে রচিত তাঁর প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যরে নাটক), ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’, ‘অলীকবাবু’ প্রভৃতি দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মিনার্ভা থিয়েটার ভাড়া নিয়ে তিনি তাঁর রচিত ‘আঙ্গার’ নাটক প্রথম মঞ্চস্থ করেন। সেটি টানা ৩০০ রজনী চলে। পরে ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘সামার নাইট্স ড্রিম’, ‘ওথেলো’, ‘ভি.আই.পি.’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘জুলিয়াস সিজার’ প্রভৃতি অভিনীত হয়। নৌ বিদ্রোহের (১৯৪৬) পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘কল্লোল’ নাটক সাড়া জাগিয়েছিল। ওই সময় নানা বাধা সত্ত্বেও তিনি তাঁর নাটক চালিয়ে গিয়েছেন। ওই নাটক প্রযোজনার কারণে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়।


রাজনীতি

১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বাম আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। পরের বছর নকশাল রাজনীতির কারণে তাঁকে অন্তরালে যেতে হয়। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার সি.পি.এম. দলে ফিরে আসেন। তিনি এমন কিছু নাটক করেন যা ‘রাজনৈতিক থিয়েটার’ বলে আখ্যাত হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাঁর এল.টি.জি গ্রুপ ভেঙে তিনি ‘পিপ্লস থিয়েটার’ নামে নতুন গোষ্ঠী তেরি করেন। এই দল তাঁর রচিত ‘টিনের তলোয়ার’, ‘মানুষের অধিকার’, ‘ব্যারিকেড’, ‘শৃঙ্খল ঝঙ্কার’, ‘পান্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘ক্রশবিদ্ধ কিউবা’ প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ করে। কংগ্রেসি আমলের জরুরি অবস্থায় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নাটক ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ (১৯৭৪) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নাটকের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি একাধারে অভিনয় করে গেছেন বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ছবিতে।


চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম অভিনয় মধু বসুর ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মৃণাল সেন পরিচালিত ‘ভুবন সোম’- এ অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। হিন্দি ছবি ‘ গোলমাল’ এবং ‘নরম গরম’- এর জন্য দুবার ‘ফিল্ম ফেয়ার’ পুরস্কারও পেয়েছেন। ইংরেজি ছবিতে তাঁর প্রথম অভিনয় (১৯৬৫) মার্চেন্ট আইভরির ‘শেক্সপিয়ারওয়ালা’য়। সত্যজিৎ রায়ের ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’, ‘হীরক রাজার দেশে’ ও ‘আগন্তুক’ ছবিতে তাঁর অভিনয় উল্লেখযোগ্য। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি চিত্র পরিচালনার কাজে হাত দেন। তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘মেঘ’। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে লেনিনের জন্মদিনে ‘লেনিনের ডাক’ নাটক মঞ্চস্থ করে মিনার্ভা থিয়েটার ছেড়ে দেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পেশাদারি দলের জন্য সতেরোটি যাত্রানাটক রচনা করেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে এল.টি.জি ভেঙ্গে গেলে তিনি নতুন ‘আর্য অপেরা’ গঠন করেন। মিনার্ভা থিয়েটার ও যাত্রা দুটিই চালিয়ে যান। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে সত্যজিৎ রায়কে সভাপতি করে ‘ব্রেখট সোসাইটি’ গঠন করেন।


লেখালেখি

একশোটির মতো নাটক রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রস্থ: ‘টুওয়ার্ডস এ রিভোলিউশনারি থিয়েটার’, ‘শেক্সপীয়ারের সমাজচেতনা’, ‘গিরিশ মানস’, ‘প্রতিবিপ্লব’ প্রভৃতি।


পারিবারিক জীবন

অভিনেত্রী শোভা সেন তাঁর স্ত্রী।


তথ্যসূত্র: সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।