ইয়ারউদ্দিন খলিফা

Barisalpedia থেকে

ইয়ারউদ্দিন খলিফা দক্ষিণ বঙ্গের অন্যতম সুফি সাধক ও বুজুর্গ ব্যক্তি। তাঁর মাজার মির্জাগঞ্জে অবস্থিত হলেও তার পৈতৃক নিবাস মূলত ছিল শরীয়তপুর জেলায়।


জন্ম ও কৈশোর:

মির্জাগঞ্জের আধ্যাত্মিক সাধক ইয়ার উদ্দিন খলিফা শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানার রাজনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সরাই খা। সরাই খা’র ছিল তিন ছেলে: মদন খা, ইয়ার উদ্দিন খা ও আদম খা। আর ছিল এক মেয়ে। নাম মরিয়ম বেগম। ইয়ারউদ্দিন খাঁর জন্ম হয়েছিল আনুমানিক বাংলা ১২৫৮ মোতাবেক ইংরেজি ১৮৫১ সালে। জানা যায় ইয়ার উদ্দিন খান এর পিতা সরাই খা হাজী শরীয়ত উল্লাহর সহকর্মী ছিলেন। ইয়ার উদ্দিন খাঁ এবং তার ভাই আদম খানের বংশধরদের কেউ বেঁচে নেই। তবে তার বড় ভাই মদন খার তিন ছেলে ছিল সুলতান খা, ওফাজ উদ্দিন খাঁ, এবং আজিজ খা। তন্মধ্যে আজিজ খানের সন্তান-সন্ততি বা বংশধর এখনো বেঁচে আছে।

ইয়ারউদ্দিন খলিফা বাল্যকালে পিতাকে হারানোর পরে মায়ের সাথে তাদের নানা বাড়িতে ধামসি গ্রামে চলে আসেন। এই গ্রামে নবু দরবেশ নামে এক লোকের কাছে তিনি কোরআন পড়া শেখেন। পরবর্তীতে এই গ্রামের আইয়ুব আলী সর্দারের কাছেও তিনি দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেন। ইয়ার উদ্দিন খলিফা শিক্ষাজীবন মূলত এ পর্যন্তই।


বিবাহ ও মির্জাগঞ্জে আগমন:

ইয়ার উদ্দিন খলিফা অনেকটা অল্প বয়সেই শরীয়তপুর জেলার পালং থানার দেওভোগ গ্রামে এক মুসলিম পরিবারে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম ছিল ফাতেমা বেগম। তাদের এক সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। তার নাম রাখা হয়েছিল পবন খা। একদিন কলেরায় আক্রান্ত হয়ে স্ত্রী ফাতেমা বেগম এবং পুত্র পবন খা মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রী ও পুত্র বিয়োগে ইয়ার উদ্দিন খলিফা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি শোকে নিজ এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে মনস্থ করেন। তখন ফরিদপুর এলাকা থেকে মানুষেরা ধান-সুপারির ব্যবসার জন্য দক্ষিণবঙ্গে আসতো। তিনিও তাদের সাথে দক্ষিণবঙ্গে চলে আসেন। দক্ষিণবঙেগ তিনি শ্রীমন্ত নদীর পাড়ে থাকার জন্য খড়-কুটার একটি ঘর তৈরি করেন থাকার জন্য। এরপর মির্জাগঞ্জে স্টীমারঘাটের পাশের সুড়ঙ্গের মতো একটি পথের ধারে একটি একচালা ছাপড়ার ঘর তৈরি করেন এবং সেখানে সুচ-সুতা দিয়ে সেলাই করে টুপি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি বানিয়ে সামান্য রোজগারের ব্যবস্থা করেন। এই কাজ যারা করতো তাদের গ্রামের লোকেরা খলিফা বলতো বিধায় ইয়ারউদ্দিন খা লোকমুখে পরিবর্তিত হয়ে ইয়ার উদ্দিন খলিফা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।


কর্মজীবন ও আধ্যাত্মিক সাধনা:

ইয়ারউদ্দিন খলিফা এই দরজি কাজ থেকে কিছু পয়সা সঞ্চয় করে নদীর পাড়ের জমি ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কায় কেউ পত্তনি নেয় না বিধায় তাঁর বর্তমান দরগাহ এলাকায় খুব কম মূল্যে ২৫ শতাংশ জমি নবাবের নিকট থেকে পত্তনি লাভ করেন। এই জমি পেয়ে তাঁর ছাপড়া ঘরটি আরেকটু বড় করে দরজিগিরির সাথে সাথে সেখানে কিছু মুদি মালামালও বিক্রয় শুরু করেন। আরও পরে গ্রামীণ লোকজনের সুবিধার্থে তিনি এই মুদি মালামাল দূরের হাটগুলোতেও হাটবার দিনে নিয়ে যেতেন এবং হাট শেষে আবার নৌকায় নিয়ে স্টিমারঘাটে তাঁর ঠিকানায় চলে আসতেন। তাঁর এই কাজে তাঁর সহযোগৗ ছিল স্থানীয় বাসন্দা গগন মল্লিক। গগন মল্লিক ধীরে ধীরে তাঁর কাজের সহযোগী হওয়ার সাথে সাথে তাঁর আধ্যাত্মিক চর্চারও সাথী হয়ে উঠেন।

ইয়ারউদ্দিন খলিফার আধ্যাত্মিক চর্চা কোনো তরিকতের পিরের সবকের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না, বরং তাঁর আধ্যাত্মিক চর্চা ছিল সাধারণ ইবাদতবন্দেগি, জিকিরআজকার ও সার্বক্ষণিক সৎকর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি হাটে গিয়ে তার মুদি মালামাল হাটের ছাপড়া ঘরের নিচে সাজিয়ে নিজে চটের ওপর বসে কোরান তেলাওয়াতে বা জিকিরে মশগুল হয়ে যেতেন। খদ্দের আসলে তাদেরকেই তিনি নিজ হাতে মেপে সওদা নিয়ে টাকা রেখে যেতে বলতেন। কেউ মাপে একটু বেশি নিয়েছে এমনটা অন্য কেউ যদি বলেও দিতে চাইতেন, খলিফা সাহেব বলতেন- ‘যাক, বাবা, না বলি, লোকটি লজ্জা পাবে’। এই ছিল খলিফা সাহেবের সৎকর্মের নমুনা এবং ইহাই ছিল তাঁর আধ্যাত্মিকতার ধরন। এবাদতবন্দেগি, সদব্যবসা, কম খাদ্যগ্রহণ আর সবসময় খোদার ভাবনায় মশগুল থাকা এই ছিল তার সাকুল্য আধ্যাত্মিকতা আর সাকুল্য বুজুর্গিয়াত। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই বুজুর্গিয়াত সম্বন্ধে ধারণা করাই সম্ভব হতো না, যদি তাঁর কিছু কারামত বা অলৌকিক ঘটনা মানুষের কাছে ধরা না পড়তো।


কারামত:

তাঁর জীবদ্দশায় এবং এমনকি মৃত্যুর পরেও অনেক কারামতের ঘটনা জনগণের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

ক) একবার নবাব বাড়ির কিছু কর্মচারী খলিফা সাহেবের বাগান থেকে একটি বড় পাকা কাঁঠাল চুরি করে এবং কাছারিতে নিয়ে ভেঙে দেখে তার ভিতরে একটিও কোষ নেই। তারা জানে খলিফার বাড়ির কাঁঠাল গাছ থেকে এলাকার মানুষেরা তাঁকে বলে কাঁঠাল নিয়ে খায় এবং কাঁঠালের খুব প্রশংসা করে। তাদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনার কোনো নজির নেই। অথচ এতবড় পাকা কাঁঠালটির বেলায় এমন ঘটলো, এটা নিঃসন্দেহে খলিফার নিকট না বলে খাওয়ার কারণে তাঁর কারামতে ঘটেছে মর্মে তারা বুঝতে পারে। এই উপলব্ধি থেকে তাঁরা এসে ইয়ারউদ্দিন খলিফার নিকট পুরো ঘটনা খুলে বলে এবং মাফ চায়। খলিফা খুশি হয়ে তাদেরকে বাগান থেকে আরেকটি কাঁঠাল নিয়ে যেতে বলেন এবং সে কাঁঠাল একেবারে কোষপূর্ণ এবং অত্যন্ত সুমিষ্ট হয়।

খ) একবার মির্জাগঞ্জ থানার দারোগা মেসের আহম্মদ তাঁর মাঝিকে দিয়ে খলিফাকে হাদিয়া স্বরূপ এক ঝুড়ি কৈ মাছ পাঠান। দারোগা কৈ মাছ পাঠিয়েছেন শুনে খলিফা ঐ মাঝিকেই বলেন মাছগুলো তাঁর বাড়ির নদীর ঘাটে পানিতে ছেড়ে দিতে। মাঝির কাছে এই বর্ণনা শুনে দারোগা খলিফার প্রতি মারাত্মক ক্ষুব্ধ হন। দারোগা মাঝিকে আদেশ দিলেন খলিফার কাছে গিয়ে তাঁর দেয়া কৈ মাছ ফেরত চাইতে। মাঝি এসে কৈ মাছ ফেরত চাইলে খলিফা সাহেব মাঝির নিকট থেকে ঝুড়িটা নিয়ে নদীর ঘাটের পানিতে ডুবিয়ে ধরলেন। কৈ মাছগুলো ঝুড়িতে চলে আসলো। এভাবে কৈ মাছ ফেরত পেয়ে দারোগা মেসের আহম্মদ বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে খলিফার পায়ের নিকট এসে ক্ষমা চাইলেন এবং এরপর থেকে দারোগা মেসের আহম্মদ ইয়ারউদ্দিন খলিফার এক চিরকালীন ভক্তে পরিণত হলেন।

গ) খলিফা সাহেবের মৃত্যুর চার/পাঁচ বছর পরে আরএসএন কোম্পানির পটুয়াখালিগামী একটি স্টিমার একবার দুই যাত্রীকে টিকিটের টাকা দিতে না পারায় লাঞ্ছিত করে সুবিদখালিতে নামিয়ে দেয়। অসহায় লোকদুটো খলিফার মাজারের নিকট এসে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করে। স্টিমারটি সুবিদখালি থেকে এই মাজারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ ছিদ্র হয়ে যায়। মানুষগুলো ধীরে ধীরে নেমে যাওয়ার পরে স্টীমারটি নদীতে তলিয়ে যায়। ডুবুরি এনে জাহাজটি তুলতে গেলে হিন্দু ডুবুরি জাহাজে দড়ি বাঁধতে গিয়ে দেখে সেখানে এক দাড়ি টুপি পরা লোক বসে বসে কোরান পড়ছেন। জাহাজ কোম্পানির লোকেরা এই কথা শুনে বুঝতে পারে তাদের জাহাজ ডুবেছে মূলত জাহাজে লাঞ্ছিত দুজন কর্তৃক খলিফা সাহেবের মাজারে এসে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদের কারণে। তারা এবার ভুল বুঝতে পেরে খলিফার দরবারে শিরনি মানত করে এবং খলিফার মাজার চতুর্দিক দিয়ে পাকা করে দেয়। এই ঘটনার পর থেকে খলিফার মাজারে শিরনি মানতের প্রথা শুরু হয় বলে অনেকে মনে করেন।

মৃত্যু:

খলিফা সাহেবের শেষ জীবনে তাঁর ভাতিজা সুলতান খা তাঁকে তাদের তৎকালীন বাসস্থান শরীয়তপুরের ধামসিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মির্জাগঞ্জ আসেন। কিন্তু সুলতান খা মির্জাগঞ্জ এসে এখানেই অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। খলিফা সাহেব নিজ হাতে ভাতিজাকে শ্রীমন্ত নদীর পাশে আমগাছের নিচে চিরনিদ্রায় শায়িত করেন। ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদে মেজভাই ওফাজ উদ্দিন খা মির্জাগঞ্জ আসেন। ওফাজ উদ্দিন খাকে তিনি কথা দেন বেঁচে থাকলে পরের শ্রাবণ মাসে শরীয়তপুরে যাবেন। আনুমানিক বাংলা ১৩২৮ সালের সেই শ্রাবণ মাসেই দুদিন জ্বর ভোগ করে খলিফা সাহেব চলে যান, তবে শরীয়তপুরে নয়, বরং তাঁর চিরস্থায়ী নিবাস পরপারে। বাংলা ১৩২৮ সালের শ্রাবণ মোতাবেক সম্ভবত সেই দিনটি ১৯২১ সালের জুলাই মাসের শেষার্ধের কোনো এক দিন।


খলিফা সাহেবের মাজার:

বাংলাদেশের বেশিরভাগ বুজুর্গদের মাজারের মতোই খলিফা সাহেবের মাজারেও তহবিল তছরুপ ও বেদাতি কর্মকাণ্ডের ঘটনা চলছিল। এই অবস্থা থেকে মাজারকে পবিত্র রূপে ইসলামের খেদমতে ফিরিয়ে আনতে ১৯৯০ এর দশকে উদ্যোগ নেন স্থানীয় আবদুল মান্নান নামক এক ব্যক্তি। তাঁর আবেদনে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসক মির্জাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে সভাপতি এবং এম এ মান্নান হাওলাদারকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৩ সদস্যের একটি নির্বাহী কমিটি অনুমোদন করে। কমিটির ইসি নং ১৭৪৭৭। এই কমিটির ব্যবস্থাপনায় যাওয়ার পর থেকে এই দরগাহ ইসলাম ও জনগণের কল্যাণে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণে সক্ষম হয়েছে। ক) এই দরগায় দেড়শত ইয়াতিম শিক্ষার্থীকে তিনবেলা খাবার সুবিধা দিয়ে লেখাপড়া করানোর একটি ইয়াতিম খানা চালু রয়েছে। খ) ৩৫০ ছাত্রের জন্য একটি সিনিয়র মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে ছাত্ররা তিন বেলা লিল্লাহ বোর্ডিঙে খাবার পায়। গ) দেড়শত ছাত্রের একটি হেফজখানা রয়েছে। ঘ) একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে দরগাহর অর্থে শিক্ষার্থীদেরকে দুপুরে খাবার দেয়া হয়। ঙ) দুইশত অনাথদুঃস্থকে নিয়মিত দুবেলা খাবার দেয়া হয়। চ) ১৫০ জন শিক্ষার্থীর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল পরিচালিত হয়। ছ) মসজিদের ইমাম. মুয়াজ্জিন, খাদেম, দরগার খাদেম, মাদ্রাসার শিক্ষক প্রমুখের প্রায় ১০০ জনকে মাসিক বেতনভাতা দরগার আয় থেকে পরিশোধ করা হয়।



তথ্যসূত্র: মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান। যুগশ্রেষ্ঠ অলী মরহুম হযরত ইয়ারউদ্দিন খলিফা সাহেব (রহঃ)। মির্জাগঞ্জ দরবার শরীফ। ২০১৪।