আলমগীর কবির

Barisalpedia থেকে

আলমগীর কবির দেশের অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাহিত্যিক। আলমগীর কবিরের আদি জেলা বরিশালের বানারীপাড়ায়। অবশ্য তাঁর জন্ম পার্বত্য চট্টগ্রামের রাংগামাটিতে ১৯৩৭ সনের ১৮ই ডিসেম্বর।


পারিবারিক পরিচয়

মা বাবার প্রথম সন্তান আলমগীর কবির। তাঁর পিতার নাম আবু সৈয়দ আহমেদ। দাদার নাম মুনসুর আহমেদ। মাতার নাম আমিরুন্নেছা খাতুন। দাদা মুনসুর মিয়া সরকারী চাকুরে ছিলেন এবং বরিশাল শহরে নবগ্রাম রোডে নিজে বাড়ী করেন। বাড়ীটি অনেকখানি জায়গা নিয়ে করা হয় এবং নাম দেয়া হয় মুনসুর কোয়ার্টার। সেখানে শিক্ষিতজনেরা ভাড়া থাকতেন এবং এই মুনসুর কোয়ার্টার এককালে খুব বিখ্যাত ছিল। আলমগীর কবিরের দুই চাচা ও চার ফুপু। আলমগীর কবিরের পিতা আবু সৈয়দ আহমেদ সরকারী চাকুরে হলেও নাটক পাগল ছিলেন। তিনি ছাত্র জীবনেও নাটক পরিচালনা করতেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পরিচলনা করে গেছেন। আলমগীর কবিরের শৈশব কাটে হুগলী জেলায়।

আলমগীর কবিরের পাঁচ বোন- বেগম মমতাজ হোসেন, সেলিমা মান্নান, সুলতানা শহিদ, খুরশীদ জাহান আহমেদ ও ইরফাত আজীজ। বিটিভির সিরিজ নাট্যকার ও শিশু সাহিত্যিক বেগম মমতাজ হোসেন আলমগীর কবিরের পিঠাপিঠি বোন। দু’বছরের ছোট হলেও বেগম মমতাজ হোসেন ছায়ার মতো কবিরের দুর্দিনের সাথী। পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই (আলমগীর কবির) মিনদা বড় আদরের। আলমগীরের ডাক নাম ‘মিন্টু’- থেকে আদর করে মিনদায় পরিণত হয়েছিল। আলমগীর কবিরের তিনটি সন্তান অত্যন্ত মেধাবী। বড় মেয়ে ইলোরা কবির পিতার মতোই ধীশক্তির অধিকারী। ইলোরা কবির ফিলম্ ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে পড়াশুনা করে থাকেন। আলমগীর কবিরের প্রথম স্ত্রী মঞ্জুরা কবির দুই কন্যা ইলোরা ও অজন্তাকে নিয়ে লন্ডনে বসবাস করছেন।


শিক্ষাজীবন

হুগলীর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন তিনি। সে সময় কবি গোলাম মোস্তফা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। লেখাপড়ায় আলমগীর অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি হাজি মহম্মদ মুহসীন স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। দেশ বিভাগের পর আলমগীর কবিরের পিতা তার পরিবার নিয়ে ঢাকা আসেন। আলমগীর কবির ঢাকায় কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ঢাকা কলেজ থেকে বিজ্ঞান নিয়ে ইনটারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে তার মাতৃবিয়োগ ঘটে যাওয়ার পর তিনি লন্ডনে অবস্থানরত কবির খালাতো ভাই চার্টাড একাউন্টেন্ট কাজী মশিউর রহমানের কাছে চলে যান। লন্ডনে তিনি আট বৎসর অবস্থান করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি লন্ডনে ইলেকট্রনিকস্ এবং অংক শাস্ত্রে অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন। এরপর সাংবাদিকতা ও সিনেমাটোগ্রাফিতে বিশেষভাবে সাংবাদিক ও চিত্র সমালোচক হয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন।


কর্মজীবন

১৯৫৯ সালে আলমগীর কবির সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে চলচ্চিত্রের ইতিহাস ও পরিচালনার উপর কোর্স সম্পন্ন করেন এবং বিভিন্ন পত্রিকায় চলচ্চিত্র সমালোচনা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে লন্ডনে বামপন্থী রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। ১৯৬৫ সালের মধ্যে কোনো এক সময় ব্রিটিশ পাসপোর্ট ব্যবহার করে প্যালেস্টাইন যান এবং প্যালেস্টাইনী যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। একই বছরে পিতা আবু সাইয়েদ আহমেদ ইন্তেকাল করেন। এবার ঢাকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য আইয়ুব সরকারের অধীনে তিন মাস কারাদন্ড ভোগ করেন এবং এক বছর ঢাকায় পৌর এলাকার অন্তরীণ অবস্থায় কাটান। ১৯৬৭ সালে সাপ্তাহিক হলিডের সিনিয়র এডিটর হিসাবে যোগদান করেন। ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তান ফিল্ম সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে মনজুরা ইব্রাহীমকে বিবাহ করেন। ১৯৬৯ সালে ঢাকায় তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় ফিল্ম সোসাইটি “ঢাকা সিনে ক্লাব” প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে বড় মেয়ে ইলোরার জন্ম হয়। একই বছর মাওলানা ভাসানীর উপর প্রামাণ্য চিত্রের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৯৭১ সালে জহির রায়হান, শফিক রেহমান, গাজী শাহাবুদ্দিন প্রমুখের সাথে Express পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীন বাংলা বেতারে ইংরেজী সংবাদ পাঠক হিসাবে যোগদান করে পরে নবগঠিত সরকারের প্রতিবেদকের দায়িত্ব পালন করেন। জহির রায়হানের সাথে ‘ষ্টপ জেনোসাইড’ এ চিত্র নাট্যকার ও ধারভাষ্যকারের কাজ করেন। “লিবারেশন ফাইটার্স” নির্মাণ করেন। ১৯৭২ সালে ‘ধীরে বহে মেঘনার’ কাজ শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে কনিষ্ঠ কন্যা অজন্তার জন্ম। ১৯৭৫ সালে জয়শ্রীকে বিবাহ করেন। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভস নির্মাণে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ সালে পুত্র লেলিনের জন্ম। “ধীরে বহে মেঘনা”, “সূর্যকন্যা” ও “সিমানা পেরিয়ে”- ছবি তিনটির চিত্রনাট্য বই আকারে প্রকাশ। ১৯৮০ সালে মোহনার কাহিনী রচনা করেন। ১৯৮১ সালে ফিলম্ম ইন্সটিটিউট ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার পর চলচ্চিত্র প্রশিক্ষণ কোর্স করা হলে তিনি প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮২ সালে জয়শ্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৮৪ সালে “মোহনা” চিত্রনাট্য বই আকারে প্রকাশিত হয়। একই বছর গ্রন্থ "This was Radio Bangladesh 1971" প্রকাশ পায়। ১৯৮৬ সালে শরৎচন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে “পরিণীতা” নির্মাণ করেন। ১৯৮৭ সালে “হাঙর নদী গ্রেনেড” উপন্যাসের চলচিত্রায়নের কাজ শুরু করেন। একই বছর গুরুতর অসুস্থ হয়ে লন্ডন গমন করেন। ১৯৮৮ সালে “আলতামনির কড়চা”র সুটিং শুরু করেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্র মনিকাঞ্চন নির্মাণ করেন। ১৯৮৮ সালেই প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্র উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব তাঁর ওপর অর্পিত হয় ।

মৃত্যু

১৯৮৯ সালে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচিত্র ‘আবর্তন’- এর উদ্বোধন এবং বগুড়া চলচ্চিত্র সংসদ সংগঠনের পর সেখান থেকে ফেরার পথে নগরবাড়ী ফেরীঘাটে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার তার কর্মময় বর্ণাঢ্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।


তথ্যসূত্র: রফিকুল ইসলাম। বরিশাল দর্পণ। ঢাকা, ১৯৯০।