হেমায়েত বাহিনী
হেমায়েত বাহিনী দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। এর প্রতিষ্ঠাতা হেমায়েত উদ্দিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি করতেন।
পরিচ্ছেদসমূহ
দলের গঠন
১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি তিনি ছুটিতে ছিলেন।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বিভিন্ন বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েকজনকে নিয়ে একটি ছোট দল গঠন করেন। তিনি সর্বপ্রথম ১৭জন সঙ্গী নিয়ে ২৮মার্চ ভোর ৫টায় জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট দখল করেন।উক্ত ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে শতাধিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন।প্রথম পর্যায়ে পথে পথে প্রায় ৩৫/৪০ টি যুদ্ধ ও আক্রমণ করে এগিয়ে যান।এতে তার ৪জন সঙ্গী মৃত্য বরন করেন। দলের গঠন এই ঘটনা থেকে শুরু হলেও এর নাম তখনো হেমায়েত বাহিনী ছিল না।
দলের অভিযান ও যুদ্ধসমূহ
২১শে এপ্রিল ফরিদপুর পুলিশ লাইন দখল করেন এবং উদ্ধারকৃত অস্ত্র-গোলাবারুদ এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী যুবকদের মধ্যে বিতরণ করেন।ফরিদপুর কিছুদিন পাক সৈন্য মুক্ত থাকে।কিন্তু পাকসৈন্য ঢাকা থেকে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ফরিদপুর এলে হেমায়েত উদ্দিন সঙ্গীদের নিয়ে ২৮শে এপ্রিল নিজ গ্রাম কোটালীপাড়ার টুপুরিয়ায় সরে আসেন।
৩০শে এপ্রিল পাক সেনাদের হাতে আটক কোটালী পাড়ার ৩৬জন আওয়ামী লীগ নেতাদের ডাক বাংলো থেকে তালা ভেঙে মুক্ত করেন।এ কারণে ৩রা এপ্রিল পাক বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় হেমায়েত উদ্দিনের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেন। ৫ই মে সঙ্গে থাকা সৈনিক ইব্রাহিম ও সোলেমানকে সঙ্গে নিয়ে কোটালীপাড়া থানা আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র দখল করে নেন এবং কোলা বাড়ি বাবু চিত্ত গাইনের বাড়িতে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিবাহিনী গঠন করেন।৭ই মে পাক বাহিনী কোটালী পাড়া থানা পুনরায় দখল করে।
হেমায়েত বাহিনী নামকরন
৯ই মে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে কোটালীপাড়া থানা হেমায়েত বাহিনী দখল করে সরকারি সমস্ত স্থাপনা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন।এখানে তাদের সাথে যুক্ত হয় আরো ১২জন মুক্তিযোদ্ধা।১৫ই মে মাদারীপুরের এম.সি.এ এডভোকেট অসমত আলী খান ও উজিরপুরের এম.সি.এ হরনাথ বাইন এবং স্থানীয় আওয়ামীল লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের উপস্থিতিতে হাবিলদার হেমায়েত উদ্দিনকে মেজর হেমায়েত উদ্দিন ঘোষণা দিয়ে হেমায়েত বাহিনী নামকরণ করা হয়।
হেমায়েত বাহিনীর অন্যান্য যুদ্ধ
১৪ই জুন ৩০জন পাক আর্মি ও রাজাকার হেমায়েত বাহিনীর হাতে ধৃত হয় কিন্তু যুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিনের বডিগার্ড ইব্রাহিম শাহাদত বরণ করেন।পরের দিন ধৃত ৩০জন পাক সেনাদের বিচারের মাধ্যমে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং কোটালীপাড়ার রাজপুর গ্রামে কবর দেওয়া হয়।হয়। হেমায়েত বাহিনীর মধ্যে বিচার বিভাগও ছিল। নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে ২ জন গ্রুপ কমান্ডার সহ মোট ৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল।
২২শে জুন হেমায়েত বাহিনী কোটালীপাড়া আক্রমণ করে ফুড-গোডাউন দখল করে ৮.০০০ মন গম,চাউল উদ্ধার করে ।১৪ই জুলাই এই বাহিনীকে ৪২টি কোম্পানিতে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়।অগাস্ট মাসে মধুমতি নদী হতে পাক বাহিনীর গানবোট দখল করে কোটালীপাড়ার কোলাবাড়িতে রাখা হয়।
হেমায়েত বাহিনী মোট ১০৪টি ছোট বড় যুদ্ধ ও অপারেশান করে।এ বাহিনীতে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল সর্বমোট ৫,৫৫৮জন।৩ ডিসেম্বর হেমায়েত বাহিনী কোটালীপাড়ায় প্রায় ৫০০পাক সেনাকে পরাস্ত করে এলাকা শত্রু মুক্ত করেন।হেমায়েত বাহিনীর যুদ্ধ তৎপরতায় খুশি হয়ে ৯নং সেক্টর কমান্ডার এম.এ মেজর জলিল হেমায়েত উদ্দিনকে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা দেন।
স্বাধীনতার পরে ২৪শে জানুয়ারি ২৯৭২ সালে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর পদতলে হেমায়েত বাহিনীর সকল যোদ্ধা অস্ত্র সমর্পন করেন।
হেমায়েত উদ্দিনের পরিচয়
হেমায়েত উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার টুপুরিয়া গ্রামে। হেমায়েত উদ্দিন ১৯৪১ সালের ৩ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ আবদুল করিম এবং মা সখিনা বেগম। তিনি জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে ব্যান্ডপার্টির হাবিলদার ছিলেন।হেমায়েত বাহিনীর যুদ্ধ তৎপরতায় খুশি হয়ে ৯নং সেক্টর কমান্ডার এম.এ মেজর জলিল হেমায়েত উদ্দিনকে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ঘোষণা দেন। ২২শে অক্টোবর ২০১৬ শনিবার সকালে ৬:১০মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৩ সালে কোটালীপাড়া উপজেলার টুপুরিয়া গ্রামে হেমায়েত বাহিনী জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হেমায়েত বাহিনীর অবদান চিরস্মরণীয়।