শেখ শাহাবুদ্দিন
সাতুরিয়ার জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ও ইসলামী সাধু পুরুষ। নিবাস রাজাপুর থানাধীন সাতুরিয়া গ্রাম। জন্ম: শুক্তাগড়ে অবস্থিত তাঁর মাজারের লিপি অনুসারে ১৬২৮ খৃস্টাব্দে জন্ম এবং ১৭৪৫ খৃস্টাব্দে মৃত্যু। তবে মাজারের এই লিপি পরবর্তীকালে সংযোজিত এবং যথাযথ নয় বলে মনে হয় কেননা জনাব শাহাবুদ্দিনের জমিদারির পত্তন ঐতিহাসিকভাবে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগের ঘটনা বলে প্রতীয়মান হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে (সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বরিশাল বিভাগের ইতিহাস ৩৫৬)। জনাব শাহাবুদ্দিনের পিতা: শেখ আলাউদ্দিন। পিতামহ: শেখ মহবত তকী। প্রপিতামহ: শেখ নূর। প্রপিতামহের পিতা: শেখ ফুল।
জমিদারি লাভ
এই পরিবারের অধস্তন পুরুষ শেখ বাহাউদ্দিন মিয়ার বক্তব্যমতে ৩৫০ বছর আগে বার আউলিয়ার সাথে তিনি এতদঞ্চলে আগমন করেন। শেখ বাহাউদ্দিন মিয়া বলেন যে শেখ শাহাবুদ্দিন আলৌকিকভাবে রায়ের কাঠির রাণী মায়ের জমিদারির সমূহ বিপদ সম্পর্কে জানতে পেরে রাণী মাকে অর্থাৎ শিশুপুত্র মহেন্দ্র নারায়ণের মাকে তিনি এ কথা জানালেন। রাণী মা’র বিশ্বাস অর্জনের জন্য তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কাঁচাকলা পাকিয়ে তাঁর অলৌকিক শক্তির প্রমাণ দিলেন। রাণী মা তাঁকে ছেলে বানিয়ে মুর্শিদাবাদে নওয়াবের কাছে গেলেন। এই ছেলের সুবাদে রাণী মা’র জমিদারি রক্ষা হলো। ফিরে পাওয়া জমিদারির সোয়া এগার আনা ছিল সেলিমাবাদ পরগনায় বাকি পৌনে পাঁচ আনা নড়াইল স্টেটে। রাণী মা এই সোয়া এগার আনা ছেলে হিসেবে শেখ শাহাবুদ্দিনকে দান করেন। ফলশ্রুতিতে শেখ শাহাবুদ্দিনের জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ হলো। এই গল্পের ঐতিহাসিক ভিত্তি স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নসাপেক্ষ। আমি এখানে এই ঐতিহাসিক নিরীক্ষায় অগ্রসর হচ্ছি না কারণ ‘কথার কথা’র কথামতে সংকলক হিসেবে এটি আমার কাজ নয়। তবে এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সত্যে পৌঁছার জন্য ড. তপন রায় চৌধুরীর “রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিত চর্চা” শীর্ষক গ্রন্থের এ সংক্রান্ত বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ড. তপন রায় চৌধুরী রায়ের কাঠির জমিদারদের দুর্দশাগ্রস্ত সময়ের এবং সেই দুর্দশার সমাধানরূপে কীর্তিপাশার জমিদারি প্রতিষ্ঠার যে অকপট বর্ণনা দিয়েছেন রাজাপুরের এই তালুকদারি প্রতিষ্ঠায় ঐরূপ কোনো ঘটনার অস্তিত্ব অস্বাভাবিক নয়। ঝালকাঠি জেলার ইতিহাস প্রণেতা সিকদার আবুল বাশারের বক্তব্য মোতাবেক জনাব শেখ শাহাবুদ্দিনের পূর্বপুরুষ ছিলেন হজরত খানজাহান আলীর সহচর হজরত সাজেন্দা। রায়ের কাঠির জমিদার প্রাণ নারায়ণের মৃত্যুর পর শিশু পুত্র মহেন্দ্র নারায়ণ জমিদারি হারান। জনাব শেখ শাহাবুদ্দিন রাণীমাতা এবং শিশুপুত্রকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ নবাবের নিকট যান এবং জমিদারি উদ্ধার করতে সমর্থ হন। এই ঘটনায় সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জনাব শেখ শাহাবুদ্দিন রাণীমাতার নিকট থেকে সেলিমাবাদ পরগণায় একটি খারিজা তালুক লাভ করেন। রেজাউল কবীর পল্টু তার শেরে বাংলার মাতুলালয় ও জন্মস্থান সাতুরিয়া মিঞা বংশের ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন যে এই পরিবার সেলিমাবাদ পরগণার প্রায় ৩৫ হাজার বিঘা জমি খারিজা তালুকরূপে ভোগ করতেন। খারিজা তালুক মানে হলো সামিলী তালুকের মত এই তালুকদার জমিদারের অধীন নন বরং এই তালুকদার সরাসরি সরকারের অধীন এবং সরকারকে কর দিতেন। তবে উল্লেখ্য যে শেখ শাহাবুদ্দিন শেষ জীবনে তালুক-জমিদারি ছেড়ে সুফী সাধকের ফকিরি জীবনে পদার্পণ করেছিলেন। বাকলা গ্রন্থের প্রণেতা রোহিনী কুমার সেন লিখেছেন “সাতুরিয়া মিঞাগণের পূর্ব পুরুষ সেখ সাহাবুদ্দিন রায়েরকাঠিতে চাকরি করিতেন। ক্রমে ক্রমে তিনি রাজ সরকার হইতে কতক তালুকপ্রাপ্ত হইয়া সুক্তাগড় নামক স্থানে বাস করিতে আরম্ভ করেন।” খোসাল চন্দ্র রায় লিখেছেন “[সাজেন্দার] বংশীয় সেখ সাহাবুদ্দিন নামে একজন আওলিয়া (ফকির) রায়েরকাঠির চৌধুরীগণ কর্তৃক কতক চেরাগি ও তালুকাদি প্রাপ্ত হইয়া এই সাতুরিয়া গ্রামের ৫ মাইল পূর্বে সুক্তাগড় নামক পল্লীতে বাস করেন।”
পরিবার ও বংশধর
জনাব রেজাউল কবীর পল্টু উল্লেখ করেছেনে যে জনাব শেখ শাহাবুদ্দিন ফরিদপুরের গিরদা-গুট্টির বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারে প্রথম বিয়ে করেন। ঢাকার মিরপুরে শাহ আলী বোগদাদীর যে মাজার রয়েছে তিনিও গিরদা-গোট্টির এই পরিবারের সদস্য। উল্লেখ্য গালুয়ার সৈয়দ পরিবারও এই গিরদা-গুট্টির বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারের বংশধর বলে কথিত আছে। শেখ শাহাবুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী ছিলেন তিন জন। সিকদার আবুল বাশারের বিবরণ মোতাবেক তাঁর নয় পুত্র ও দুই কন্যা সন্তান ছিল: শেখ নাজিম উল্লাহ, শেখ আজিম উল্লাহ, শেখ বোরহান উল্লাহ, শেখ হাবিব উল্লাহ, শেখ বরকত উল্লাহ, শেখ কুদরত উল্লাহ, শেখ মতি উল্লাহ, শেখ শফি উল্লাহ, শেখ বাবর উল্লাহ, রহিমা বিবি ও খোদেজা বিবি। প্রথম স্ত্রীর সন্তানগণ রাজাপুরস্থ সাতুরিয়ার মিয়াবাড়ি বলে পরিচিত বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানগণ কাউখালীর পাড় সাতুরিয়ায় স্থায়ী হন। তৃতীয় স্ত্রীর সন্তানদেরকে নিয়ে জনাব শেখ শাহাবুদ্দিন শুক্তাগড়ে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন যেখানে এখন তাঁর মাজার বিদ্যমান। প্রথম সন্তান শেখ নাজিম উল্লাহর পুত্রগণ: দ্রাজাতুল্লাহ ওরফে ধন মিয়া (শ্রী খোসাল চন্দ্র রায় ও রোহিনী কুমার সেন তাদের বইয়ে তার নাম দ্রোহতুল্লাহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন), শরফ উল্লাহ, ইজ্জতুল্লাহ, এনায়েত উল্লাহ ও মেহের উল্লাহ (পল্টু ৪৭)। শরফ উল্লাহ মিয়ার কন্যা জমিলা খাতুনের মেয়ে সৈয়দুন্নেসা ছিলেন শেরে বাংলার মা। এনায়েত উল্লাহর পুত্র শেখ আব্দুল আজিজ মনসুর মিঞা এইবংশের প্রতিপত্তিশালীদের একজন এবং তার মেয়ে মেহেরুন্নেছা সম্ভবত সমগ্র মিঞা বংশের মাঝে কীর্তিতে ও কৃতিত্বে উজ্জ্বলতম ব্যক্তি।
জনাব শেখ শাহাবুদ্দিনের নাতি দারাজাতুল্লাহ ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। এই দারাজাতুল্লাহ ওরফে ধন মিঞার প্রতিপত্তির কথা খোসাল চন্দ্র রায় তাঁর ‘বাকরগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনে এবং রোহিনীকুমার সেন তাঁর বাকলা গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। দারাজাতুল্লাহর ছেলে গফুর মিয়া বিয়ে করেন মেহেরুন্নেছাকে। মেহেরেুন্নেসার জনহিতৈষণা ও প্রতিপত্তির কথাও রোহিনীকুমার সেন তাঁর বাকলা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। মেহেরুন্নেছার পিতামহ এনায়েত উল্লাহ ছিলেন দ্রোহাতুল্লাহর আপন ভাই। গফুর মিয়ার মেয়ে শামসুন্নেসার বিয়ে হয় শায়েস্তাবাদ জমিদার পরিবারের সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ ওরফে নওশীন মিয়ার সাথে। নওশীন মিয়ার প্রতিপত্তি এই পরিবারে এত বেশী ছিল যে তাঁর জীবদ্দশায় এই পরিবারের তালুকদারির সকল সিদ্ধান্ত তিনিই গ্রহণ করতেন। রেজাউল কবীর পল্টু তারশেরে বাংলার মাতুলালয় ও জন্মস্থান সাতুরিয়ার মিঞা বংশের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে নওশীন মিয়া পিরোজপুরের সাবরেজিস্ট্রার, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট, মিউনিসিপাল কমিশনার, লোকাল বোর্ড ও জেলা বোর্ডের সদস্য ছিলেন (৫৬)। শেখ বাহাউদ্দিন মিয়ার বর্ণনামতে শামসুন্নেসা খাতুন নিঃসন্তান থাকায় ১৯০৯ সালে তিনি তাঁর সম্পত্তির বিশাল অংশ ওয়াকফ স্টেট ঘোষণা করেন। এক পর্যায়ে শেরে বাংলা এই ওয়াকফ স্টেটের মোতয়াল্লী ছিলেন। বাড়ির সামনের সাতুরিয়া এম.এম. উচ্চ বিদ্যালয় নামক স্কুলটি ১৯৪১ সালে তাঁর মা মেহেরুন্নেছার স্মৃতিতে নির্মিত হয়। স্কুলটির নামের এম.এম. দ্বারা মেহেরুন্নেছা মেমোরিয়াল বোঝায়। জনাব শেখ শাহাবুদ্দিনের দ্বিতীয় স্ত্রীর বংশধরগণ যাঁরা কাউখালীর পাড় সাতুরিয়ায় বসবাস শুরু করেন তাঁদের অন্যতম হাবিব উল্লাহ সাহেবের অধস্তন পুরুষদের একজন আহমদ আলী মিয়া রাজাপুরের সাতুরিয়ার মিয়া বাড়ির শরফুল্লাহ মিয়ার মেয়ে জমিলা খাতুনকে বিয়ে করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে শরফুল্লাহ মিয়া ছিলেন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিত্ব দ্রাজাতুল্লাহর আপন ভাই এবং জনাব শেখ শাহাবুদ্দিনের নাতি। আহমদ আলী ও জমিলা দম্পতির ছিল এক পুত্র ও দু কন্যা। পুত্র আব্দুল হামিদ এবং কন্যা আজিজুন্নেসা ও সৈয়দুন্নেসা। উক্ত সৈয়দুন্নেসার ছেলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক।
প্রতিষ্ঠিত তালুকদারির সীমা
খারিজা তালুক লাভের পরে ক্রমান্বয়ে তালুকদারির সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় এক সময়ে তাঁদের তালুকদারি ছিল বাগেরহাটের কচুয়া, চিতলমারী, আন্ধারমানিক, রঘুনাথপুর, মাটিভাঙ্গা, পাটগাতী, দেপাড়া, পাঁচপাড়া, শাবুখালী, বগা, শিয়ালকাঠী, ভ্রমরগাতি, ধোপাখালী, গজালিয়া; পিরোজপুরের ভাদুরা শংকরপাশা, কুমারমারা, হরিণাগাতী, হরিনাভট্টাচার্য, ডুমুরতলা, বাইনখালী, কেশোতা; এবং রাজাপুরের বারকাকপুর, নারিকেলবাড়িয়া, মনোহরপুর, কৈবর্তখালী, ফুলুহার, উত্তর তারাবুনিয়া প্রভৃতি স্থানে। তথ্য উৎস: মুহম্মদ মুহসিন। চরিতাভিধান: রাজাপুরের গুণী ও বিশিষ্টজন। নালন্দালোক, ঢাকা। ২০১০।