পলাশীর যুদ্ধ ও ইংরেজদের দখলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৩৩ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম মীর্যা মোহাম্মদ। তার মাতা আমিনা বেগম আলীবর্দী খানের কন্যা এবং পিতা জইনুদ্দীন বিহারের নায়েব নাজিম ছিলেন। জইনুদ্দীনের পিতা হাজী আহম্মদ ও আলীবর্দী খান আপন ভ্রাতা। ১৭৫৬ খ্রিঃ ১০ এপ্রিল আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর মনসুরুল মুলক সিরাজউদ্দৌলা শাহ কুলী খান মীর্যা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর নাম ধারণ করে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব হলেন। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান, ঢাকার নওয়ারা প্রধান রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, স্বরূপ চাঁদ, উমিচাঁদ, ইয়ার লতিফ, লুৎফে ইয়ার খান ও ঘসেটী বেগম সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে। তারা ইংরেজ কোম্পানির লর্ড ক্লাইভ ও ওয়াটসনের সাথে সিরজউদ্দৌলার পরিবর্তে মীর জাফরকে নবাব করার চুক্তি করেন। এ ষড়যন্ত্রের ফলে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর আ¤্রকাননে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। মীর জাফরের পুত্র মিরনের আদেশে নবাবের অন্নে পালিত মোহাম্মদী বেগ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। হাতির পিঠে করে নবাবের মৃতদেহ মুর্শিদাবাদের রাস্তায় প্রদর্শন করা হয়। সিরাজের মা আমিনা বেগম পুত্রকে দেখতে গেলে মীর জাফরের ভাগিনা খাদিম হোসেন তাকে বেত্রাঘাত করে তাড়িয়ে দেয়। মুর্শিদাবাদের রাস্তায় নবাবের মৃতদেহ দু’দিন পড়ে থাকে। শেষে এক দরবেশ সিরাজকে খোশবাগে সামাহিত করেন। সিংহাসন নিরাপদ করার জন্য মীর জাফর সিরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মীর্যা মেহেদী ও ভ্রাতা একরামুদ্দৌলার পুত্র মুরাদদৌলাকেত হত্যা করে। নবাবের স্ত্রী লুৎফন্নেসা স্বামীর কবরের নিকট থাকতেন এবং কবরে আলো জ্বালাতেন। তিনি ১৭৯৩ খ্রিঃ প্রাণত্যাগ করেন।
পলাশীর ষড়যন্ত্রকারীদের নিষ্ঠুর পরিণতি হয়। মীর মদনের বজ্রাঘাতে মৃত্যু ও লর্ড ক্লাইভ লন্ডনে আত্মহত্যা করে। মীর জাফর কুষ্ঠরোগে মারা যায়।
রাজবল্লভ ও তার পুত্র কৃষ্ণদাস, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, রামনারায়ণ মাহতাবচাঁদ ও স্বরূপচাঁদকে মীর জাফর নামেমাত্র বাংলার নবাব হলেন। বাঙালীরা স্বাধীনতা হারাল। ইংরেজ রাজস্ব শুরু হলো। বাকলা চন্দ্রদ্বীপ ইংরেজ শাসনাধীনে চলে যায়। যে স্বাধীনতা পলাশীর আ¤্রকাননে হারিয়ে যায়, বীর বাঙালীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে সে স্বাধীনতা সশস্ত্র যুদ্ধ করে ফিরিয়ে আনে।
কোম্পানি শাসন
পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানী বাকেরগঞ্জে প্রকাশ্যে দস্যুতা শুরু করে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে তারা লুন্ঠুনের রাজস্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৬৫ খ্রিঃ লর্ড ক্লাইভ দেওয়ানী লাভ করে বাকলা চন্দ্রদ্বীপের ওপর পূর্ণ আধিপত্য বিস্তার করে। পলাশীর যুদ্ধাক্ষেত্র থেকে একদল সৈন্য পালিয়ে বরিশালে আশ্রয় নেয়। তারা নলচিড়ার জমিদার সৈয়দ ইমাম উদ্দিনের নেতৃত্বে শরিকলে একটি কেল্লা নির্মাণ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বাকেরগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, গৌরনদী, সুগন্ধিয়া, নিয়ামতি প্রভৃতি স্থানে ইংরেজ কোম্পানির সাথে বিদ্রোহী সৈন্য ও এ অঞ্চলের জনগণের কয়েকটি সংঘর্ষ হয় এবং অনেক ইংরেজ নিহত হয়। ১৭৭৯ খ্রিঃ ইংরেজরা শরিকলের দুর্গ ও নলচিড়া মিয়াবাড়ী আক্রমণ করে এবং পলাশীর যুদ্ধ ক্ষেত্রের জীবিত সৈনিকেরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করে।