গৈলা
ঐতিহাসিকভাবে গৈলা বৃহত্তর বরিশালের সর্বোচ্চ শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান গ্রাম। এটি বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলা এবং তৎকালীন গৌরনদী থানার অন্তর্গত। শিক্ষাক্ষেত্রে বরিশাল শহরের পরে গৈলার স্থান ছিল।
প্রাচীনকাল হতে গৈলা পণ্ডিতনগর বলে খ্যাত ছিল। গৈলার বিজয় গুপ্ত, ত্রিলোচন দাশ, জানকী নাথ, সুখদেব সেন কবিরাজ, কাশীনাথ সেন, রামভন্দ্র সেন, মদন মোহন দাশ কবীন্দ্র, রাধা মোহন তর্ক ভ‚ষণ, রামচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ পণ্ডিত বিশ্বব্যাপী বরিশালের মুখোজ্জ্বল করেছেন। গৈলার অধিকাংশ অধিবাসী বৈদ্য বলে আয়ুর্বেদ বা কবিরাজী শাস্ত্রে উন্নত ছিল। দুহি সেন, ভবদাশ ও ত্রিলোচন দাশের বংশ সুখ্যাতির সাথে কবিরাজী ব্যবসা করে এসেছে এবং তাদের মধ্যে অনেক বিখ্যাত আয়ুর্বেদ পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করেছে। প্রসিদ্ধ মদন মোহন কবীন্দ্র মহাশয়ের নিকট দেশ-বিদেশ হতে অনেক ছাত্র শিক্ষা লাভ করে বিখ্যাত কবিরাজ হয়েছে। পণ্ডিতনগর গৈলা-ফুল্লশীর ঐতিহ্য ইংরেজ আমলেও বিদ্যমান ছিল। এ গ্রামের পণ্ডিত নামচরণ শিরোরত্ন, নবীন চন্দ্র কর্মকার, আনন্দ চন্দ্র সেন, অন্নদা চরণ সেন প্রমুখ গ্রন্থকার বলে পরিচিত ছিলেন। ১৮৯৫ খৃৃস্টাব্দ পর্যন্ত গৈলা ফুল্লশ্রী গ্রামে ৫ জন এমএ, ১৯ জন গ্র্যাজুয়েট ও একজন ডাক্তার ও একজন ইঞ্জিনিয়ার ছিল। গৈলার চন্দ্র কুমার দাশ জেলার প্রথম গ্যাজুয়েট। এ গ্রামের মধুসূদন সেন জেলার প্রথম ইঞ্জিনিয়ার। তিনি শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হতে পাস করেন। ১৮৯৩ খৃৃস্টাব্দে গৈলা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯৫ খৃৃস্টাব্দে পর্যন্ত জেলার মোট ডিগ্রীধারীদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ গৈলা গ্রামের ছিল।
গৈলা গ্রামের বিখ্যাত ব্যক্তিদের একটি তালিকা নিম্নে প্রদত্ত হলো:
১. ছবি খা (ষোড়শ - সপ্তদশ শতক), মূল নাম সাবিহ খা (?), সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে বাকলার ফৌজদার। ২. কালীপ্রসন্ন তর্কচূড়ামণি (১৮৩৩ - ১৮৯৭) বাকেরগঞ্জের কলসকাঠি গ্রামের জমিদার বরদাকান্ত রায়ের সভাপণ্ডিত ও ধর্মোপদেষ্ট। ৩. ললিতমোহন দাস (৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৮ - ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩২), কলকাতাস্থ ‘বরিশাল সেবা সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ৪. কুসুমকুমারী দাশ (১৮৭৫ - ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮), কবি; কবি জীবনানন্দ দাশের মাতা। ৫. চন্দ্রকান্ত চক্রবর্তী (জন্ম ১৮৮৭ - ১৫ মে ১৯৭১), ১৯১৫-১৭ খ্রি. ভারত-জার্মান ষড়যন্ত্রের যে মামলা আমেরিকায় চলছিল তার আসামি। ৬. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৮৭ - ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫২), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত দার্শনিক। ৭. সুরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৯০১-১৯৯৫), ভারতের জৈব রসায়ণের গবেষণা ও শিক্ষণের ক্ষেত্রে শিষ্যপরম্পরায় এক উল্লেখ্য ঘরানার প্রবর্তক। ৮. অমিয়কুমার দাশগুপ্ত (১৬ জুলাই ১৯০৩ - ১৪ জানুয়ারি ১৯৯২), একজন আন্তর্জার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক (নানাবাড়ি গৈলায় তাঁর জন্ম)। ৯. তারকেশ্বর সেনগুপ্ত (১৫ এপ্রিল ১৯০৫ - ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১), হিজলি বন্দি-শিবিরে রাজবন্দিদের উপর গুলিবর্ষণকালে নিহত। ১০. নয়নাঞ্জন দাশগুপ্ত (২৭.১.১৯০৭ - ১৩.১১.১৯৯২), স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১১. মুকুল সেন (১৪.৬.১৯০৭-২৫.২.১৯৯২), আন্দামানে দ্বীপান্তরপ্রাপ্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী। ১২. মৈত্রেয়ী দেবী (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৪ - ৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৯০), পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত প্রখ্যাত সাহিত্যিক। ১৩. সুপ্রকাশ রায় (সুধীরচন্দ্র ভট্টাচার্য) (১৯১৫- ২১.১২.১৯৯০), স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বামপন্থী ইতিহাস গবেষক। ১৪. অণিমা সেনগুপ্ত (মার্চ ১৯২০ - ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪), লেখিকা; ১৯৫৭ খ্রি. থেকে মৃত্যুকাল অবধি শশিমুখী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ও হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং এসোসিয়েশনের সদস্য হিসাবে কুমায়ুনের ট্রেইল গিরিবর্ত্ম অঞ্চলের অভিযাত্রী। ১৫. জ্যোতির্ময় গুপ্ত (২৩ আগস্ট ১৯২৩ - ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩১) বিপ্লবী ও পরবর্তীতে বিলাতফেরত চক্ষু-বিশেষজ্ঞ। ১৬. ভোলানাথ সেন (১৯২৩ (?)- ১৮.১.১৯৯৮), প্রখ্যাত আইনজীবী ও বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা; কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় পূর্তমন্ত্রী। ১৭. উমা দাশগুপ্ত (১৪ এপ্রিল ১৯২৮ - ২১ জুন ২০০৫), সারা ভারতের জাদু সম্রাজ্ঞী।
তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০। ২। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান।