আসমান সিংহের পুঁথি
১৯ শতকের প্রথম ভাগের বিখ্যাত লোককাহিনী আসমান সিংহের পুঁথি। নলছিটির সুজাবাদ এ ঘটনার কেন্দ্র। মগ জলদস্যুদের দমন করার জন্য সুবাদার শাহ সুজা সুজাবাদে কেল্লা নির্মাণ করেন। মগদের সাথে যুদ্ধে যারা শহীদ, শাহ সুজা তাদের লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেন। আসমান সিংহের পূর্বপুরুষ সুজাবাদ গ্রামটি লাখেরাজ হিসেবে লাভ করে। তারা রাজপুত সৈন্য ছিল। আসমান সিংহ প্রণয় করে একই গ্রামের লোকমান সিংহের কন্যা রায় দুর্গাকে বিয়ে করেন। কেল্লার উত্তর পাশে লোকমান সিংহের বাড়ি ছিল। আসমান সিংহের অবস্থা বেশি ভাল ছিল না। তাই তিনি নলছিটি বন্দরে এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। সে যুগে নলছিটি বন্দরে অনেক বারবনিতা বাস করত। আসমান সিংহ জনৈক বারবনিতার প্রেমে পড়ে দীর্ঘদিন বাড়িতে আসেননি। এদিকে আমিরাবাদ গ্রামের খোদানেওয়াজ খাঁর সাথে দুর্গার প্রণয় ঘটে।
খোদানেওয়াজ খাঁর পূর্ব পুরুষ শাহ সুজার সৈন্য ছিল। ধনু খাঁর পুত্র নবী নেওয়াজ খাঁ এবং পৌত্র শাহনেওয়াজ খাঁ। খোদানেওয়াজ খাঁর পুত্র আছমত আলী খাঁ, পৌত্র নয়া খাঁ এবং প্রপৌত্র আলতাফ খাঁ। তাহলে দেখা যায়, আসমান সিংহের ঘটনা ১৯ শতকের প্রথম ভাগে ঘটেছে। খোদানেওয়াজ খাঁ শিকারের নামে দুর্গার বাড়িতে যেত। দুর্গার প্রণয়ের কথা কন্যা তারামনি তার পিতা আসমান সিংহকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তখন তারামনির বয়স ১০ বছর বলা হয়েছে। কথিত আছে দুর্গার সীতা নামে একটি কন্যা জন্মে। গ্রাম্য চৌকিদার আসমান সিংহকে এ খবর দিলে তিনি ঘটনা জানার জন্য বাড়ি আসেন। তখন খোদানেওয়াজ খাঁ দুর্গার ঘরে ছিল। আসমান সিংহের আগমন টের পেয়ে দুর্গা খোদানেওয়াজ খাঁকে ঘরের পিছনে পালাতে সাহায্য করে। দুর্গা দরজা খুলে দেয়। আসমান সিংহ স্ত্রীর কোলে নবজাত শিশুকে দেখে দুর্গাকে হত্যা করার জন্য তরবারি দিয়ে আঘাত করে। দুর্গা শিশুকন্যা সীতাকে সামনে ধরে। তরবারীরর আঘাতে কন্যা নিহত হয়। বিচারে আসমান সিংহের ফাঁসির আদেশ হয়। তার ভাই ফটিক সিংহ কলকাতা হাইকোর্টে চাকরি করত। তিনি হাইকোর্টে আপীল করেন এবং আসমান সিংহের ফাঁসির আদেশ বাতিল করা হয়। খোদানেওয়াজ খাঁ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাটনীর দ্বারা খেয়া বন্ধ রাখায় এবং ফটিক সিংহ ঠিক সময়ে ফাসির আদেশ বাতিলের আদেশ নিয়ে সুজাবাদে পৌঁছতে পারেনি। কোম্পানি আমলে ফাঁসির আসামীকে ঘটনাস্থলে ফাঁসি দেয়া হতো। দুর্গার দাবিতে আসমান সিংহকে বাড়ির সামনে একটি পুরনো শিমুল গাছে ফাঁসি দেয়া হয়। কেউ বলেন খোদানেওয়াজ খাঁ দুর্গাকে বিয়ে করেন, আবার কেউ বলেন তিনি বিয়ে করেননি। যাহোক দুর্গার সাথে খোদানেওয়াজ খাঁর কিছুদিন সম্পর্ক ছিল। তারপর তিনি দুর্গাকে প্রত্যাখ্যান করেন। দুর্গা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে জীবন যাপন করে এবং শেষে মনোকষ্টে পাগল হয়ে মারা যায়। দুর্গার কাহিনী আজও বরিশালের জনগণের নিকট সুপরিচিত। গ্রামের মেয়েরা একে অন্যকে অভিশাপ দেয় “তোর যেন দুর্গার মতো অবস্থা ঘটে”। ১৯ শতকের জীবন্ত এ কাহিনী নিয়ে অনেকে পুঁথি ও কবিতা লিখেছেন। মনে হয় কয়েকজন কবি আসমান সিংহের গীত রচনা করেছিলেন।
তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্বর প্রকাশনী। ২০১০।