সৈয়দ হাতেম আলী

Barisalpedia থেকে

সরকারী সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল- এর প্রতিষ্ঠাতা। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি।পূর্ণ নাম: সৈয়দ হাতেম আলী। ওরফে হাতেম মীরা। গ্রাম: গালুয়া, রাজাপুর। জন্ম: ১৯০৭। মৃত্যু ২৮ মার্চ ১৯৭৪। পিতা: সৈয়দ সা’দত হোসেন ওরফে ছাদন মীরা। পিতামহ: সৈয়দ খবির উদ্দীন। প্রপিতামহ: সৈয়দ নিজাম উদ্দিন। উল্লেখ্য যে সৈয়দ সা’দত হোসেনের তিন স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রীর ছেলে মুক্তা মিয়া ও মানিক মিয়া। দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে সৈয়দ হাতেম আলী ও সৈয়দ বজলে আলী। তৃতীয় স্ত্রী অপুত্রক (?)।

পূর্বপুরুষ, জন্ম ও শৈশব

গালুয়ার বিখ্যাত সৈয়দ বা মীর পরিবারের শ্রেষ্ঠ সন্তান সৈয়দ হাতেম আলী। এলাকায় এ বংশের লোকেরা মীরা এবং মিয়া উভয় নামেই পরিচিত। পূর্ব পুরুষের দিক দিয়ে এঁদের অনেক আত্মীয় স্বজনের নিবাস এখনো ফরিদপুরের গোয়ালদী, খাবাসপুর, কুরপাল, গেরদা ইত্যাদি জায়গায় আছে বিধায় ন্যায়ত অনুমান করা যায় যে এ বংশের প্রথম পুরুষ সৈয়দ নিজাম ফরিদপুর থেকে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। সাড়ে বিশ হাজার টাকার তালুক কিনে তালুকদার হিসেবে সৈয়দ নিজাম এখানে প্রজাপত্তন শুরু করেন আনুমানিক ১৮৪০ সালের দিকে। দুই ছেলের মধ্যে প্রথম ছেলে সৈয়দ আকতার হোসেন ওরফে আকতার মীরাকে সৈয়দ নিজাম প্রতিষ্ঠিত করেন ছোট গালুয়ায় এবং ছোট ছেলে সৈয়দ খবির উদ্দীনকে প্রতিষ্ঠিত করেন বড় গালুয়ায়। সৈয়দ খবির উদ্দীনের ছেলে সৈয়দ সা’দত হোসেন এলাকায় পরিচিত ছিলেন ছাদন মীরা নামে। উক্ত সৈয়দ সা’দত হোসেন ওরফে ছাদন মীরার দ্বিতীয় ছেলে সৈয়দ হাতেম আলী। সৈয়দ হাতেম আলীর বড় ভাই সৈয়দ আওলাদ হোসেন ওরফে মুক্তা মিয়া এবং ছোট ভাই বাদশা মিয়া। তবে তিন ভাই এক মায়ের সন্তান নন। সৈয়দ হাতেম আলীর মা ভিন্ন। তাঁর মাতুলালয় আঙ্গারিয়া খাঁ বাড়ি। আঙ্গারিয়া মোহন খাঁ-দের বাড়ির পিছনে আফসার খাঁ ছিলেন সৈয়দ হাতেম আলীর মামা। সৈয়দ হাতেম আলীর জামাতা অধ্যক্ষ কাজী মোতাহার হোসেনের ভাষ্যমতে সৈয়দ হাতেম আলীকে তাঁর বাবা তাঁদের আঙ্গারিয়ার ওশদ তালুক (আওসাত তালুক অর্থাৎ অর্ধ তালুক) দান করে দিলে বড় ভাই আওলাদ হোসেন ক্ষেপে যান এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে সৈয়দ হাতেম আলীকে তাঁর মামা বাড়িতে চলে যেতে হয়। এ ঘটনা যখন ঘটে সৈয়দ হাতেম আলীর তখন বালক বয়স। ফলত সৈয়দ হাতেম আলীর যেটুকু যা স্কুল পর্যায়ের পড়াশুনা সেটুকু মামা বাড়িতে থেকেই সম্পন্ন হয়।

কর্মজীবন

জুনিয়র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশুনা করে পিতৃকুলে অবহেলিত সৈয়দ হাতেম আলী মামীর দেয়া অল্প কিছু টাকা নিয়ে ভাগ্যের অন্বেষণে তৎকালীন বরিশাল শহরে আগমন করেন। ভাগ্যদেবীর বর এবার তাঁর উপর অকৃপণ হস্তে বর্ষিত হতে শুরু করলো। ছোট ছোট ব্যবসা যেটি ধরেন সেটিতেই তাঁর অপার সাফল্য। হাতেম আলী কলেজের বাংলার শিক্ষক লুৎফ-এ-আলম এর তথ্য মতে পানের দোকান দিয়ে তাঁর ব্যবসা শুরু। এরপরে মিষ্টির দোকান। তাঁর প্রথম প্রতিষ্ঠিত বর্ধিষ্ণু ব্যবসা ছিল কলকাতা থেকে কাপড় এনে বিক্রি। এই ব্যবসার সাফল্যেই লেচু শাহের মাজারের নিকটে প্রথম জমি কেনেন। এই পর্যায়েই এই প্রতিশ্রুতিশীল ব্যবসায়ী মহাবায, গাওয়াসার এবং কাউনিয়ায় বিশাল তালুকের মালিক নওয়াব আলী সর্দারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কাউনিয়ার আব্দুল গফুর খাঁয়ের ঘটকালিতে নওয়াব আলী সর্দার তাঁর মেয়ে মজিদুন্নেছার জন্য জামাই করে নেন সৈয়দ হাতেম আলীকে। ডি.এস.পি. আলী আজিম খাঁ ছিলেন নওয়াব আলী সর্দারের আরেক জামাই। এই বিয়ের মধ্য দিয়ে সৈয়দ হাতেম আলী বরিশালে বুনিয়াদি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যান। নওয়াব আলী সর্দার তাঁর পৈতৃক বাড়িটিই সৈয়দ হাতেম আলীকে দান করে দেন। অপর দিকে ব্যবসায়ও তাঁর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসতে থাকে। তাঁর প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় অবদান যে ব্যবসার সেটিও এ পর্যায়ে শুরু হয়। এটি ছিল ওষুধের ব্যবসা। কুমিল্লার মুরাদনগরের জনৈক কাজী সাহেবের ম্যানুফ্যাকর্চাড শূলসুধা নামে একটি গ্যাস্ট্রিক বা অম্লনাশক ওষুধ ছিল ঢাকায় যার অন্যতম এজেন্ট ছিলেন কাজী আলাউদ্দীন রোডের হাজী আহম্মদ আলী। সৈয়দ হাতেম আলী বরিশালে এই ওষুধের এজেন্ট হলেন। অম্লনাশক এ্যালোপ্যাথিক ওষুধের অবর্তমানে বা অপ্রতুলতায় ইহার বিক্রি ছিল তখন একচেটিয়া এবং অকল্পনীয় পরিমাণে। সৈয়দ হাতেম আলী ফন্দি করলেন তিনি এজেন্ট হিসেবে আর রয়াল্টি দিবেন না বরং নিজেই অন্য নামে এই ওষুধ ম্যানুফ্যাকচার করে বিক্রি করবেন। এই ভাবনা মতে তিনি ম্যানুফ্যাকচার করলেন শূলশেষ এবং এই নামে পেটেন্ট রেজিস্ট্রি করলেন। আহমদ আলী এর বি রুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় সৈয়দ হাতেম আলী জিতে যান। তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে বড় সাফল্য। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে তিনি পুনরায় বাকলা নামে এই ওষুধের আরেকটি নতুন রেজিস্ট্রেশন নিলেন। লতাপাতা গাছগাছড়া গাছের বাকল দিয়ে তৈরী বলেই এর নাম রাখা হয় বাকলা। এবার বাকলার অফিস খুললেন কোলকাতার লোয়ার চিৎপুর রোডে। বাকলার এই অফিসটি কোলকাতায় এখনো পুরনো হ্যারিসন রোড অর্থাৎ বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোডে অবস্থিত।

খ্যাতি ও কীর্তি

সৈয়দ হাতেম আলী বাকলা ওষুধ কারখানা ছাড়াও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের সফল স্বত্বাধিকারী ছিলেন, যেমন: বাকলা সিগারেট ম্যানুফ্যাকচারার স্টান্ডার্ড কোং, তিন তারা অয়েল মিল, মোস্তফা ব্রাদার্স ব্রিক ফিল্ড, রাবার ইন্ডাস্ট্রি (নাম অসংগৃহীত), স্পঞ্জ ইন্ডাস্ট্রি (নাম অসংগৃহীত), পানামা বরফ কল, মুরাদ বরফ কল, কোল্ড স্টোরেজ (নাম অসংগৃহীত), রংপুরে অবস্থিত তামাক ইন্ডাস্ট্রি ক্যাপিটাল কোং ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর অনেক ভূ-সম্পত্তি ছিল। সাহেবের চর, ডনেরকান্দি, সাদেকখার চর ইত্যাদি স্থানে তিনি জমিদারি এস্টেট ক্রয় করেছিলেন। ব্যবসার সাফল্যে তথা এই সকল প্রতিষ্ঠানার মালিকানায় তখনকার দিনে অর্থাৎ ষাট-সত্তুর দশকের মাঝামাঝি বরিশালে লোক মুখে এমন একটা প্রবাদ চলতো যে বরিশালে তিন আলী-- হাতেম আলী, আদম আলী আর ঈমান আলী। একই সাথে ধনাঢ্য, বিদ্যোৎসাহী ও দানশীল ছিলেন সৈয়দ হাতেম আলী। কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেনে যা তাঁর নামের কলেজ অর্থাৎ সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ রূপে সারা দেশে পরিচিত। এছাড়া বি. এম. কলেজের বায়োলজিকাল সায়েন্স ভবনটি তাঁর দানে প্রতিষ্ঠিত। শহরের আমানতগঞ্জে অবস্থিত বরিশাল ইমলামিয়া কলেজের জায়গাটি তাঁর স্ত্রীর নামে খরিদ করেন এবং স্ত্রী মজিদুন্নেছা খাতুন তা দান করেছেন। বরিশাল শহরের অতি পুরাতন ঐতিহ্যবাহী টাউন হাই স্কুল এর একটি অংশ তাঁর দানে প্রতিষ্ঠিত। বরিশাল পৌরসভাধীন আমানতগঞ্জ ইউনিয়নের তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি তৎকালীন মুসলিমলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন। পারিবারিক জীবনে তিনি তিন জন স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম স্ত্রী নওয়াব আলী সর্দারের মেয়ে মজিদুন্নেছা। দ্বিতীয় স্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর জ্ঞাতি। ওয়াজেদ আলী হাওলাদারের ভ্রাতুষ্পুত্রী। অনুমান করা হয় যে এই বিয়ে তিনি করেছিলেন মেহেন্দীগঞ্জের জমিদারি রক্ষার স্বার্থে। তৃতীয় স্ত্রী খান বাহাদুর সদরুদ্দীন সাহেবের (এম.এল.এ.) ভাগ্নী এবং আব্দুস সাত্তার খানের মেয়ে।

পারিবারিক জীবন ও বংশধর

সৈয়দ হাতেম আলীর নাতনী কাজী রুবীর প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক সৈয়দ হাতেম আলীর সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনীর সংখ্যা যথারীতি ঈর্ষণীয়। তাঁর প্রথম স্ত্রী মমতাজ মজিদুন্নেছার ছয় সন্তান যথাক্রমে: সৈয়দা আনোয়ারা হোসেন, সুলতানা, সৈয়দ মোস্তফা হোসেন, সৈয়দ কাওসার হোসেন, সৈয়দ তোফাজ্জেল হোসেন ও রওশন আরা বেগম। দ্বিতীয় স্ত্রী যার নাম জনাব কাজী রুবী মনে করে বলতে পারেন নি তাঁর দুই সন্তান লাল ও মিনারা বেগম। তৃতীয় স্ত্রী খান বাহাদুর সদ রুদ্দীন সাহেবের ভাগ্নী ফিরোজা বেগমের পাঁচ সন্তান যথাক্রমে: সৈয়দ আসাদ হোসেন, ইলা, মুনমুন, মুরাদ ও দীনা। জনাব সৈয়দ হাতেম আলীর প্রথম কন্যা সৈয়দা আনোয়ারা হোসেনের স্বামী ছিলেন হাতেম আলী কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যক্ষ জনাব কাজী মোতাহার হোসেন। জনাব কাজী মোতাহার হোসেন ও সৈয়দা আনোয়ারা হোসেনের সন্তানগণ যথাক্রমে: কাজী মোস্তাফিজুর রহমান পাশা, কাজী খালেদা বেগম নূপুর, কাজী রাশিদা বেগম রুবী, কাজী ফরিদা বেগম রেখা, কাজী নাসিমা বেগম রোজী, কাজী মুনী রুল হাসান, কাজী শফিকুল হাসান (উইং কমান্ডার) ও কাজী জাকিয়া বেগম রুমা। শেষোক্ত জন কাজী রুমা নামে অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতিমান। জনাব সৈয়দ হাতেম আলীর দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা সুলতানার স্বামী ছিলেন এডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন আহমেদ। তাঁদের তিন সন্তান: শাহীন (ইঞ্জিনিয়ার), শামীম ও মোর্শেদা বেগম লিপি। জনাব হাতেম আলীর তৃতীয় ছেলে সৈয়দ কাওসার হোসেনের তিন সন্তান: মেহেদী হাসান, খুশি ও ভুট্টো। তোফাজ্জেল হোসেনের দুই সন্তান: মুনা ও তানভীর (অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার)। দুজনই ইংল্যান্ডে বসবাসরত। জনাব রওশন আরার এক সন্তান নিপা। লাল যাঁর মূল নাম কাজী রুবী স্মরণ করে বলতে পারেন নি তাঁর দুই ছেলে। মিনারা বেগমের চার সন্তান: জুয়েল, ঝুমুর, সোহেল ও শিফা। (জনাব সৈয়দ হাতেম আলীর অন্যান্য নাতি-নাতনীদের নাম এখনো সংগ্রহ করা যায়নি) ২৮-৩-১৯৭৪ তারিখ সকাল ৮-৩০ ঘটিকায় জনাব সৈয়দ হাতেম আলী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।



তথ্যউৎস: মুহম্মদ মুহসিন। চরিতাভিধান: রাজাপুরের গুণী ও বিশিষ্টজন। নালন্দালোক, ঢাকা। ২০১০।