সুগন্ধা

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:৩৬, ৩ জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

মিশরকে যেমন নীলনদের দান বলা হয় তেমনি বরিশালকে সুগন্ধার দান বলা যেতে পারে। রামায়ণে গঙ্গার পূর্বগামী তিনটি শাখার নাম রয়েছে। তারা হলো হলদিনী, পাবনী ও নলিনী। গঙ্গার পূর্বগামী এ তিন ধারার মোহনার নাম ছিল সুগন্ধা। এই মোহনায় ধীরে ধীরে উদ্ভূত স্থলভাগই চন্দ্রদ্বীপ। প্রাগৈতিহাসিক সেই সুগন্ধার ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় প্রায় অসম্ভব।

প্রাচীন সুগন্ধা

বরিশালের প্রাচীনতম নদী সুগন্ধা মূলত গঙ্গার তিনটি শাখা নদীর সঙ্গমস্থল। শাখা তিনটি হলো হলদিনী, পাবনী ও নলিনী। রামায়ণে বর্ণিত হলদিনী হলো টলেমির বর্ণনায় কামবেরিখন যা বর্তমানে পরিচিত কুমার নদী নামে। টলেমির কামবেরিখন বর্তমান কুমার বা কপোতাক্ষ নদ প্রথমে মাথাভাঙ্গা ও পরে গড়াই নামে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর হয়ে প্রথমে মধুমতি নামে ও পরে বলেশ্বর নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। হলদিনীর শাখা ভৈরব ও কপোতাক্ষ যশোর ও খুলনার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। রামায়ণে যার নাম নলিনী টলেমির বর্ণনায় তার নাম এন্টিবল। সম্ভবত এটি মধ্যযুগের বুড়িগঙ্গা নদীর ভিন্ন নাম। নলিনী বা বুড়িগঙ্গা রাজশাহী, পাবনা, ঢাকা হয়ে নোয়াখালীর পাশ দিয়ে চট্টগ্রামের নিকট সাগরে মিলিত হয়েছে। রামায়ণের পাবনী তথা টলেমীর সিওডোস্টমন র্বতমান আড়িয়ালখাঁর সাথে অভিন্ন বলে মনে হয়। টলেমির মানচিত্রে দেখা যায় সিওডোস্টমন বা শতমুখা ফরিদপুর-বাকেরগঞ্জের মধ্য দিয়ে অগণিত দ্বীপ সৃষ্টি করে শতাধিক শাখায় বিভক্ত হয়ে সাগরে পতিত হয়েছে। পাবনী বা সিওডোস্টমন মধ্যযুগে আন্দাল খাল নামে পরিচিত ছিল। আন্দাল খালই র্বতমানে আড়িয়ালখাঁ হতে পারে। নলিনী বা এন্টিবল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের পূর্ব পাশ দিয়ে, হলদিনী বা কামবেরিখন পশ্চিম পাশ দিয়ে এবং পাবনী বা সিওডোস্টমন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ভিতর দিয়ে সাগরে প্রবাহিত হয়েছে। প্রাচীনকালে নলিনী, পাবনী ও হলদিনী চন্দ্রদ্বীপের নিকট একত্রিত হয়ে সাগরে মিলিত হয়। গঙ্গার পূর্বগামী এ তিন ধারার মোহনার নাম ছিল সুগন্ধা। গঙ্গা নদীর প্রধান স্রোত এক সময় তিন শাখা দিয়ে প্রবাহিত হতো। পরে দ্বীপ সৃষ্টি হয়ে নদী তিনটি অনেক শাখায় বিভক্ত হয়। টলেমির মানচিত্রে দেখা যায় চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন নদী সুগন্ধার প্রমত্ত রূপ নেই। তখন সুগন্ধা স্থলভাগ সৃষ্টি করে অনেক শাখার প্রবাহিত। তাহলে দেখা যায় টলেমির ১৫০ খ্রিস্টাব্দে বর্ণিত সিওডোস্টমন বা শতমুখার চেয়ে সুগন্ধা নদী ও চন্দ্রদ্বীপ অনেক প্রাচীন।

চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন নদী সুগন্ধার সাথে কালী ও শিবের উপাখ্যানের সংযোগ আছে। কথিত আছে কালী বা তারা পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের পর তার পিতা স্বামী শিবকে নিন্দা করে। এ সংবাদে শিব বা মহাদেব শোকোন্মাদ হয়ে যায় এবং স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নৃত্য করতে থাকে। এ নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এ দেখে মহাভাগ বিষ্ণুর চক্র দ্বারা তারার দেহ একান্ন খণ্ডে বিভক্ত করে এবং সে খণ্ডগুলো যে যে স্থানে পতিত হয়েছে সে স্থানগুলো তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। পাবনী, হলদিনী ও নলিনীর মিলিত মোহনায় তারা দেবীর নাসিকা পড়েছিল। সেজন্য ত্রিধারার মোহনার নাম সুগন্ধা হয়েছে। নাসিকা দিয়ে সুঘ্রাণ নেয়া হয়, তাই সুগন্ধা নাম। কালিকা পুরাণে সুগন্ধার উল্লেখ আছে। “সুগন্ধায়াং নাসিকা মেদেব স্ত্র্যম্বক ভৈরব। সুন্দরীসা মহাদেবী সুনন্দাতত্রৎ দেবতা” -কালিকাপুরাণ

সুগন্ধা নদী সম্পর্কে রোহিণী রায় চৌধুরী একটি প্রবাদ উল্লেখ করেছেন, “সুগন্ধা নদী সম্বন্ধে এদেশে একটি জনপ্রবাদ প্রচলিত আছে। স্বনামখ্যাত মহাপুরুষ ত্রৈলঙ্গ স্বামীর নাম বোধ হয় প্রত্যেক হিন্দু মাত্রেই জানেন। কতিপয় বৎসর হইল এই মহাপুরুষের তিরোধান হইয়াছে। এই দেশের জনৈক ত্যাগী পুরুষ, স্বামীজির শিষ্যত্ব স্বীকার করিয়া, বহুদিন তাঁহার চরণ সেবা করিয়াছিলেন; এক দিন কথা প্রসঙ্গে মহাপুরুষ শিষ্যের বাসস্থান জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রথমত তিনি নিজ গ্রামের নাম বলিলেন। মহাপুরুষ তাহাতে চিনিতে না পারায় শিষ্য ‘সোন্দার কূল’ বলিলেন। মহাপুরুষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন, ‘সুগন্ধা কি এই সময়ের মধ্যেই লুপ্তা হইয়াছেন?’ শিষ্য গুরুদেবের কথায় সমাধিক আশ্চর্যান্বিত হইলেন; স্বামীজি পোনাবালিয়ার শিবলিঙ্গ এবং শিকারপুরের দেবীমূর্তির কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন।”


বর্তমান সুগন্ধা

সুগন্ধা নদীর পলিমাটি থেকে জেলার ভূগঠন হয়েছে। সুগন্ধার পূর্ব পারে ছিল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ এবং পশ্চিম পারে ছিল সেলিমাবাদ। সুগন্ধার সংক্ষিপ্ত নাম সন্ধ্যা। সুগন্ধা নামের উত্তরাধিকারী রূপে নলছিটি থানার নিকটে সুন্দরকুল নামে একটি গ্রাম এখনও রয়েছে। বর্তমানে বরিশালের কালিজিরা নদীটিকে সুগন্ধার উত্তরাধিকারী নদী বিবেচনা করা হয় এবং সে মোতাবেক কালিজিরা যেখানে কীর্তনখোলার সাথে মিলিত হয়েছে সেখান থেকে শুরু করে বিষখালী পর্যন্ত জলধারাটি সুগন্ধা নদীরূপে বিবেচনা করা হয়। মূলত সুগন্ধা হলো ভূগোল থেকে হারিয়ে গিয়ে ইতিহাসের পাতায় অবস্থান নেয়া একটি নদী।



তথ্যসূত্র: সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।