মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল (তৎকালীন বরিশাল মহকুমা)

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৪৫, ১৪ জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত সংস্করণে

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

পাকিস্তান বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বরিশাল এবং ২৬ এপ্রিল পটুয়াখালী দখল করে। পাকবাহিনীর আক্রমণের ফলে বরিশালবাসীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।


পাকবাহিনীর আক্রমণে বরিশালের প্রাথমিক প্রতিরোধের পতন

২৪ এপ্রিল ফরিদপুর পতনের সংবাদ বরিশাল পৌঁছে। যে কোন মুহূর্তে পাকবাহিনী বরিশাল আক্রমণ করতে পারে মর্মে বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা তখন সচেতন। তাই তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেই প্রতিরোধের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে দুটো যুদ্ধ হয়। এ দুটি ‘জুনাহার যুদ্ধ’ ও ‘চরবাড়িয়া যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

জুনাহার যুদ্ধ: ২৫ এপ্রিল পাকবাহিনী জলে-স্থলে ও আকাশ পথে বরিশালের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর ধারণা ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। তাই তারা শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে বরিশালে আক্রমণ চালায়। ২৫ এপ্রিল সকাল ১১ টা ৪৫ মিনিটে পাকিস্তান নৌবাহিনী জুনাহার আক্রমণ করে। সায়েস্তাবাদ নদী হতে জুনাহার হয়ে কীর্তনখোলা নদীতে যেতে হয়। জুনাহারের পশ্চিমে সায়েস্তাবাদ এবং পূর্ব দিকে চরমোনাই ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন ও তালতলী। জুনাহারের পশ্চিম পাড়ে হবিনগরে, পূর্ব পাড়ে রাজাপুরে এবং দক্ষিণ পাড়ে ফোটকার চরে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়। জুনাহার নদীর দু’পারে ইরানী ও মাজভী স্টীমার। একদল মুক্তিযোদ্ধা হবিনগরে ওয়াজেদ হাওলাদারের বাড়ি, একদল তালতলীর কাছে নাজিরবাড়ির স্কুল এবং একদল বেলতলায় ছিল। লে. ইমাম আলী মেহেদী, লেঃ নাসির, ফ্লাইট সার্জেন্ট মুহাম্মদ ফজলুল হক মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনা করেন। সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন নূরুল ইসলাম মঞ্জুর। তিনি তালতলী অবস্থান করছিলেন। প্রথমে গানবোট হতে সায়েস্তাবাদ ইউনিয়নের হবিনগর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ৩০৩ রাইফেল দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। গানবোট ঘায়েল করার জন্য তাদের কোন অস্ত্র ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলার আঘাতে স্টীমার ইরানী ও মাজভী ডুবে যায়। আজও স্টীমার দুটো জুনাহারের দু’পারে ডুবে আছে। নৌবাহিনীর ভারী অস্ত্রের আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর বাংকার ধ্বংস হয়ে যায় এবং অনেকে নিহত ও আহত হয়। জুনাহারে ইছাকাটির আবদুল মোতালেব আকন্দ, গৌরনদী থানার স্যারালের সিপাহী সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের সাথে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর জুনাহারে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির পতন হয়। মুক্তিবাহিনী জুনাহার ত্যাগ করার পরও পাকিস্তানী নৌবাহিনী জুনাহার অতিক্রম করার সাহস পায়নি। ২৬ এপ্রিল ভোরে তারা বরিশাল আইডব্লিউটি ঘাটে পৌঁছে।


চরবাড়িয়ার যুদ্ধ: চরবাড়িয়া বরিশাল সদর থানার একটি ইউনিয়ন। ইউনিয়নটি বরিশাল পৌরসভা সংলগ্ন। লামচরী, তালতলী, চরবাড়িয়া, মহাবাজ, উলানঘুনী, মতাসার, কাগাশুরা, বাটনা, আমীরগঞ্জ, প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে চরবাড়িয়া ইউনিয়ন। ইউনিয়নের উত্তরে তালতলী ও জুনাহার নদী। উভয় নদী আড়িয়াল খা ও কীর্ত্তনখোলা নদীর শাখা। পূর্বে ঢাকা থেকে লঞ্চ-স্টীমার মেঘনা নদী হয়ে নয়াভাঙ্গলী, ছবিপুর, নন্দীর বাজার, সায়েস্তবাদ হয়ে বরিশাল যেত। জুনাহার নদী হয়ে লঞ্চ-স্টীমার হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ ও খুলনা যাতায়াত করত। পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে মেজর জলিলের রণকৌশল অনুযায়ী বরিশাল শহরতলিতে অবস্থিত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের মহাবাজ বিদ্যালয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রায় ২৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পে অবস্থান করে। ক্যাম্প পরিচালনায় ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক এমপিএ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, সুবেদার পঞ্চম আলী। সায়েস্তাবাদ হাইস্কুলে ট্রেনিংয়োর দায়িত্বে ছিলেন আনসার কমান্ডার আবদুল ওয়াজেদ হাওলাদার। আক্রমণ প্রতিরোধে আরও ছিল ৫ মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে জুনাহার ঘাঁটি। ২৫ এপ্রিল দুপুরে জুনাহার ঘাঁটি আক্রমণের অল্প সময়ের মধ্যে পাকবাহিনী চরবাড়িয়া আক্রমণের জন্য দুটি হেলিকপ্টারে ছত্রী সেনা আনয়ন করে। জুনাহারে আক্রমণের আধঘন্টার মধ্যে তালতলীর পূর্ব পাশে মাঠে ছত্রী সেনা নামানো হয়। এবার পাকবাহিনী নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনীর সমন্বয়ে বরিশাল আক্রমণ করতে থাকে। তালতলীর পশ্চিমে গানবোট নোঙর করা হয়। তারা গানবোট থেকে ভারী অস্ত্র নামিয়ে আনে। তারা প্রচন্ডভাবে গুলিবর্ষণ করে। কামানের গুলি ৫/৬ মাইল দূরে পড়তে থাকে। সমগ্র এলাকায় ভয়ঙ্কর ভীতি ও আতঙ্ক চলছে। পাকসেনারা যাকে সামনে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। পাকবাহিনী মহাবাজে নাজিরবাড়ির মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। ৩ ঘন্টা যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যায়। পাকসেনারা চরবাড়িয়া, কাগাশুরা, সাপানিয়া, পুরানপাড়ায় গণহত্যা, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চরবাড়িয়া ইউনিয়ন জনশূন্য হয়ে পরে। বরিশাল শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেয়।

২৫ এপ্রিল ১৯৭১ চরবাড়িয়ার ভয়ঙ্কর দিন। এদিনের বর্বরতা ও জঘন্য হত্যাকান্ড ইতিহাসে বিরল। সারাদিন চরবাড়িয়ার হত্যাকান্ড চলে। বর্বর পাক বাহিনী বাড়ি বাড়ি ঢুকে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে হত্যা করে। ৯০ বছরের বৃদ্ধাকেও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। ট্রেঞ্চ ও সদ্য খনন করা পুকুরে যারা আশ্রয় নেয় তাদেরকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করা হয়। এডভোকেট আবদুর রশীদ ও তার স্ত্রী শিশুপত্রসহ পুকুরে পালিয়েছিল। পাকসেনারা তাদের গুলি করে গুরুতর আহত করে। তাদের শিশুপুত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে মায়ের কোলে মৃত্যুবরণ করে। মা-বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছে, ৮ মাসের শিশু মায়ের কোলে নিহত হয়েছে। ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে মা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। অসুস্থ ৯০ বছরের ইমামউদ্দিন হাওলাদার নিজ ঘরে শুয়ে ছিল। নরপশুরা ঘরে ঢুকে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। চরবাড়িয়ার আবদুর রহমান খানের বাড়ির একটি পুকুর পুর্নখনন করা ছিল। গানবোটের গোলাগুলির শব্দ শুনে পুকুরে আশ্রয় নেয় সলিমুদ্দিন, আবদুর রহমান, আলী আকবর এবং জাবেদ আলী। পাকবাহিনী গানবোট থেকে উঠেই তাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে হত্যা করে। সামসুদ্দিন বেঁচে যায়। আবদুর রহমান খানকে নিজ হাতে খননকৃত ট্রেঞ্চে মাটি দেয়া হয়। তালতলী মসজিদের ইমাম মুন্সী আলী আজিম খান পাকবাহিনীর সামনে পড়ে যান। পাকবাহিনী তাকে গুলি করে। স্ত্রী আমেনা দূর থেকে এ দৃশ্য দেখেন। পাকসেনারা চলে গেলে স্বামীকে কোলে তুলে নেন এবং কোলেই স্বামীর মৃত্যু হয়। সেতারা ও সুফিয়া দুই বোনকে পাকবাহিনী গুলি করে হত্যা করে, তাদের কোলে ছিল বড় বোনের ২ বছরের ছেলে। ২৫-২৬ এপ্রিল রাতে মৃতদেহ ব্যতীত কেউ ছিল না চরবাড়িয়া ইউনিয়নে। সকলে পাশের গ্রামে আশ্রয় নেয়।

ভারত থেকে বরিশাল-পটুয়াখালীর জন্য অস্ত্র নিয়ে আসার প্রথম উদ্যোগ

২৫ এপ্রিল নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, মহিউদ্দীন আহমেদ, ডা. শাহজাহান, বাদল, সুরুজ, ফিরু, ফরিদ প্রমুখ লাখুটিয়া মাধবপাশা হয়ে সমুদয়কাঠি যান। তারা পিএলডি-৪ লঞ্চ ও পাতারহাট হতে আর একটি লঞ্চ সংগ্রহ করে সুন্দরবন হয়ে ২ মে ২৪ পরগনা জেলার হাসনাবাদ বিএসএফএর সহায়তায় পৌঁছেন। বরিশাল পতনের পূর্বে ১৮ এপ্রিল মেজর জলিল আনোয়ারা লঞ্চে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সুন্দরবন হয়ে হাসনাবাদ গমন করেন। তিনি লঞ্চে অস্ত্র ভর্তি করে ভারতের হাসনাবাদ থেকে বরিশাল যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন এমন সময় নুরুল ইসলাম মঞ্জুর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হাসনাবাদ পৌঁছেন। তারা দুটি লঞ্চে অস্ত্র বোঝাই করে সুন্দরবন হয়ে বরিশাল যাবেন এমন তাদের পরিকল্পনা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁরা পুনরায় যুদ্ধ করে বরিশাল-পটুয়াখালী দখল করবেন। আনোয়ারা লঞ্চে ছিলেন মেজর জলিল, ওবায়দুর রহমান মোস্তফা, হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমান, কালু, প্রবাল প্রমুখ এবং সোহাগদল লঞ্চে ছিলেন নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, মহিউদ্দীন আহমেদ, সর্দার জালাল উদ্দীন, লে. নাসির ফিরোজ, কামরুল, কুতুব, সুরুজ, কাক্কা প্রমুখ। ভারতীয় বিএসএফএর পেট্রোলবোট চিত্রাঙ্গদা লঞ্চ দুটো শমশের নগর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। তারপর বাংলাদেশ। রাতের অন্ধকারে লঞ্চ দুটো সুন্দরবনের গাবুয়া নদী হয়ে চলছে। পাক-বাহিনী এ সংবাদ জানতে পারে। তারা 'Birds are flying, cage them',-এ সংবাদ নিয়ে একদল সৈন্য পাঠিয়ে দেয়। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী ওয়ারলেসে এ সংবাদ ধরে ফেললেও তখন লঞ্চ দুটো বাংলাদেশের ভেতরে। হঠাৎ পাক-বাহিনী সার্চলাইট মেরে লঞ্চ আক্রমণ করে। মেজর জলিল, হাবিলদার সিদ্দিক এলএমজি ও এনারগা দ্বারা পাক সেনাদের গানবোট পাল্টা আক্রমণ করে। একটি গানবোট ঘায়েল হয়। তাদের গতি কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। এ সুযোগে লঞ্চ দুটো তীরে ভিড়ে।

লঞ্চ দুটো তীরে এলে সকলে নেমে পড়ে। মেজর জলিল বেড়িবাঁধে অবস্থান নিয়ে আক্রমণ করার নির্দেশ দেন। মেজর জলিল, সিদ্দিক, আবদুল হক এলএমজি দিয়ে পাকবাহিনীর গানবোটে গুলিবর্ষণ করেন। কিছুক্ষণ পর গানবোট চলে যায়। বৃষ্টি থেমে যায়। বেড়িবাঁধ দিয়ে গাবুয়া দ্বীপের অন্ধকারে মহিউদ্দিন আহমদসহ ১৭ জন পথ হারিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। তাদের না পেয়ে এম এ জলিল, নূরুল ইসলাম মঞ্জুরসহ ১৩ জনের একটি দল হাঁটতে থাকে। গাবুয়া দ্বীপে তারা একটি বাড়িতে সন্ধ্যা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যার পর সীমান্তের পথ জেনে হাঁটতে থাকে। রাতে কালিন্দী নদী নৌকায় পার হয়ে তাঁরা বিএসএফ বিওপিতে পৌঁছেন। সেখান থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চে হাসনাবাদ পৌঁছেন।

অন্যদিকে ভোরে মহিউদ্দীন এমপিএ, লে. নাসির, সর্দার জালাল উদ্দীন, বাদল, মোস্তফা, কাক্কা, এনামুল কবীর, কামরুজ্জামান, আবদুস ছত্তার কালু, সরুজ, আ স ম ফিরোজ, কালাম জহির প্রমুখ ১৭ জন একত্রিত হন এবং বরিশালে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ সীমান্তে পাক-বাহিনী ছিল। তাঁরা পাইকগাছার কয়রা গ্রামে পৌঁছলে শান্তি কমিটির লোকেরা তাদের গ্রেফতার করে। ৮ মে তাঁদের একটি স্কুলে বদ্ধ করে রাখে এবং যাবতীয় মালামাল লুট করে নেয়। বাদলের নিকট নূরুল ইসলাম মঞ্জুর সংগ্রাম পরিষদের ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা রেখেছিলেন। বাদলের নিকট হতে তারা সব টাকা নিয়ে যায়। কামাল চেয়ারম্যানের বাড়িতে তাঁদের রাখা হয়। শান্তি কমিটির মাওলানা ছালাম খুলনায় আর্মিদের সংবাদ দেয়। সুরুজ ও ফিরোজ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং অন্য সকলকে খালিশপুর নেভী ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সকলের উপর পাক-সেনাদের চরম অত্যাচার চলে। ১০ মে লে. নাসিরকে দিয়ে খুলনা বেতার হতে ভাষণ দেওয়ানো হয়। ১০ তারিখে চোখ বেঁধে ১৪ জনকে বিমানে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। তাদের উপর দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচার চলে। লঞ্চের কর্মচারী কালাম, সালাম ও জহিরকে ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর তাঁরা ঢাকা জেল হতে মুক্তি লাভ করেন। সুন্দরবনের গাবুয়ায় লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য ভারতীয় বাহিনী মেজর জলিলকে ফোর্ড উইলিয়ামে ব্যাপক সিজ্ঞাসাবাদ করে মুক্তি দেয়।

হাসনাবাদে এসে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও মেজর জলিল পুনরায় অস্ত্র সংগ্রহ করে সীমান্তে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এপ্রিলে মেজর জলিলকে নবম সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জের একাংশ নবম সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কমান্ডার মেজর এম এ জলিল হাসনাবাদ থানার টাকিতে নবম সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। খুব কাছেই টাকী বাজার ও ইছামতি নদী (কালিন্দী)। বশিরহাট হতে হাসনাবাদ পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি উদ্বাস্তু ক্যাম্প ছিল। কাছেই তকিপুর হাইস্কুল মাঠে স্থাপিত হলো ট্রেনিং ক্যাম্প। নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ছিলেন তকিপুর ক্যাম্পের দায়িত্বে। যুব ক্যাম্প থেকে বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ে পাঠান হতো।

বরিশাল অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের জয়যাত্রা

জুলাই মাস হতে ভারত হতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা বাহিনী অস্ত্র নিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। নিয়মিত বাহিনী সীমান্তে যুদ্ধ করে এবং অনিয়মিত বা গেরিলা বাহিনী অভ্যন্তরে যুদ্ধ করে। ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বাকেরগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ছিলেন চাঁদপাশার আবদুর রহমান। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সাথে সমন্বয় সাধন করতেন এবং হাজার হাজার ছাত্র-যুবক সংগ্রহ করে ভারতে পাঠাতেন। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে তিনি মুক্তিবাহিনীর প্রধান সমন্বয়কারী ছিলন। সেপ্টেম্বর মাসের ২ তারিখে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে উজিপুর থানার বরাকোটায় পৌঁছেন। গৌরনদীর কসবার বিচ্ছু আলম শাহজাহান ওমরের হাসনাবাদ হতে পথ প্রদর্শক ছিলেন।

শাহজাহান ওমরকে বাংলাদেশ সরকার বাকেরগঞ্জ জেলার সাব সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করে। ক্যাপ্টেন শাহজাহানের ছদ্মনাম ছিল ওমর সিং। পিরোজপুর মহকুমার ভান্ডারিয়া, পিরোজপুর, কাঠালিয়া ও খুলনা জেলার সুন্দরবনের সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দীন আহমেদ। পটুয়াখালী জেলার সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম। ক্যাপ্টেন শাহজাহান আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে মেজর জলিলের নির্দেশ নিয়ে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ বরিশাল রওয়ানা দেন। সাথে ছিলেন কমান্ডার অদুদ ও নুর হোসেন। তিনি বরিশাল ও পটুয়াখালীর সামরিক অবস্থান পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। সমগ্র জেলা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব দিতে হবে। বরিশাল-ফরিদপুর রাস্তা দখল, গাবখান খাল দখল, বরিশাল-পটুয়াখালীর জলপথ দখল, শত্রু সেনাদের যাতায়াত পথ নষ্ট, গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল এবং মুক্ত এলাকার শাসন চালাতে হবে। তখন বরিশালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল কর্নেল বশির, লে. কর্নেল আতিক মালিক, মেজর নাদের পারভেজ, ক্যাপ্টেন কাহার, ক্যাপ্টেন আজমত, ক্যাপ্টেন কায়ানী, ক্যাপ্টেন ইয়াহিয়া হামিদ প্রমুখ। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য ক্যাপ্টেন ওমর সকল দল ও উপদলগুলোকে তাঁর ক্যাম্পে আসার জন্য নির্দেশ দেন। এ সময় প্রত্যেক থানায়, ইউনিয়ন এমনকি গ্রামেও মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। ভারত থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করে শত শত গেরিলা বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যাম্প গঠন করেন। ক্যাপ্টেন শাহজাহান তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও দায়িত্ব প্রদান করলেন। তার সহ-অধিনায়ক ছিলেন ইপিআর সুবেদার আবদুল হক। আবুদল হকের জন্ম গৌরনদী থানার রাজিহার ইউনিয়নের সাজুরিয়া গ্রামে। ক্যাপ্টেন শাহজাহান প্রত্যেক থানায় একজন বেজ কমান্ডার, সহ-অধিনায়ক ও ফিল্ড কমান্ডার নিয়োগ করেন।


বরিশাল মহকুমার বিভিন্নস্থানে সংঘটিত যুদ্ধসমূহ

হেমায়েত বাহিনীর যুদ্ধ: ১৯৭১ সালে হেমায়েত উদ্দিন গোপালগঞ্জ ও বরিশালের গৌরনদী নিয়ে গঠিত সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের এবোটাবাদ থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসেন এবং জয়দেবপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তার কয়েকজন সৈন্য নিয়ে কোটালিপাড়ায় এসে নিজস্ব হেমায়েত বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন।

৯ জন সৈন্য নিয়ে হেমায়েত বাহিনীর শুরু। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী তার পিতা ও স্ত্রী হাজেরা বেগমকে গুলি করে হত্যা করে। গোপালগঞ্জ-গৌরনদীতে হেমায়েত বাহিনীর ৪২টি ক্যাম্প ছিল। তার সহ-অধিনায়ক ছিলেন রকিব সেরনিয়াবাদ। রকিব গৌরনদী কলেজের ছাত্র ছিল। তার দলে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬ হাজার। যুদ্ধকালে তার উপদেষ্টা ছিলেন মাদারীপুরের এমপিএ আছমত আলী খান এবং উজিরপুরের এমপিএ হরনাথ বাইন, লক্ষণ দাস সার্কোসের মালিক বাবু লক্ষীকান্ত । পাকবাহিনীর সাথে হেমায়েত বাহিনীর অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধগুলো হলো-বাঁশবাড়িয়া, ঘাঘর, কালাবাড়ী, হরিণাহাট, পয়সারহাট, রাজাপুর, সাতলা, বাগদা, বাকলা-রামশীল। রামশীল যুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিন গুরুতর আহত হন। ১৪ জুলাই রামশীল যুদ্ধ হয়। ১৪ জুন হরিণাহাট যুদ্ধে পাকবাহিনীর ৩০ জন নিহত হয়। ১৫ মে হেমায়েত বাহিনী পাকসেনাদের পর্যুদন্ত করে। বাংলাদেশে একমাত্র হেমায়েত বাহিনীতে মহিলা মুক্তিযোদ্ধ বাহিনী ছিল। মহিলা বাহিনীতে ৩৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল।

বড়াকোটা-হারতা যুদ্ধ: শাহজাহান ওমর দায়িত্ব গ্রহণের পরই পাক বাহিনী ৫ সেপ্টেম্বর উজিরপুরে হারতা গ্রাম আক্রমণ করে এবং ১৯ জনকে হত্যা করে। ফেরার পথে মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাদের লঞ্চ ও গানবোট আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন ভুতেরদিয়ার নুর হোসেন কমান্ডার ও উজিরপুরের আবদুল অদুদ ও আরো অনেকে। শত্রুপক্ষের একটি লঞ্চ ঘায়েল হয় ও অনেকে হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ হন। হারতা সংঘর্ষের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প বরাকোটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেখানে সাব-সেক্টরের হেড অফিস ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত অবস্থিত ছিল। সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ হতে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধারা নবম সেক্টরের অধীনে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে অনেক পাকসেনা, রাজাকার ও দালাল খতম করেন এবং গ্রাম এলাকা মুক্ত রাখেন।

দোয়ারিকা ও জয়শ্রীর যুদ্ধ: ঢাকা-বরিশালের পথে শিকারপুর খেয়ার গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। খেয়া বন্ধ করতে পারলে পাক-বাহিনীর ঢাকার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। তাই উজিরপুর ও বাবুগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা বার বার শিকারপুর ও দোয়ারিকায় অবস্থনরত পাকসেনাদের আক্রমণ করে। জুন মাস হতে আগস্ট পর্যন্ত আবুল কাসেম, মজিদ খাঁ, রত্তন শরীফ, এম এ অদুদ, মজিদ খাঁ প্রমুখের নেতৃত্বে কয়েকবার আক্রমণ রচিত হয় এবং ফেরি ডুবিয়ে দেয়া হয়। ৩ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় করপোরাল রত্তন শরীফ দোয়ারিকা আক্রমণ করেন এবং দুপুর ১টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এ সংঘর্ষে অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নায়েক আবদুর রব, হাবিলদার আবুল হোসেন, রসিদ, রাজ্জাক, সিপাহী ওহাব প্রমুখ। এ যুদ্ধে হাবিলদার আবুল হোসেন ও রাকুদিয়া কলেজের ছাত্র রশীদ শহীদ হন। যুদ্ধে কৃতিত্বের জন্য রত্তন শরীফ বীরপ্রতীক উপাধি লাভ করেন এবং স্বাধীনতার পর ফ্লাইট সার্জেন্ট পদে উন্নীত হন। চাখার কলেজের ভিপি হাবিবুর রহমান প্রথমে উজিরপুর থানা কমান্ডার ছিলেন। পরে এম এ অদুদ এ থানার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অদুদের নেতৃত্বে শিকারপুর ফেরি ডুবিয়ে দেয়া হয়। তারপর তিনি উজিরপুর থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে নেন। জয়শ্রীর পুলটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং সে কারণে পাক-বাহিনী পুলটি পাহারা দিত। ক্যাপ্টেন কাহারের নেতৃত্বে ২৮ নভেম্বর গৌরনদী হতে পাক সেনারা জিপে আটিপাড়া অপারেশনে যায়। তারা জিপগুলো জয়শ্রীর পুলের নিকট রেখে যায়। তাদের ফেরার পথে অদুদ, রত্তন শরীফ, নুরু, শাহজাহান, আবদুর রব, মতিন, মোতালেব, আউয়াল প্রমুুখ মুক্তিযোদ্ধা পাক সেনাদের আক্রমণ করেন। যুদ্ধে জিপগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেকে নিহত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান শহীদ হন। আবদুল অদুদ সর্দার ও নুরু কমান্ডার বাটাজোর আক্রমণ করে পশ্চিমা পুলিশ ও রাজাকারদের নিকট হতে অস্ত্র উদ্ধার করেন। আগরপুর, বামরাইল, হাবিবপুর ও কালিজিরায় মুক্তিযোদ্ধদের ক্যাম্প ছিল।

গৌরনদীর যুদ্ধ: কোটালীপাড়ার হেমায়েত উদ্দীন গৌরনদী অঞ্চলে কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করে অনেক পাকসেনা হত্যা করেন। তিনি গৌরনদী উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মুক্ত রাখেন। এ সময় হোসেন মিলিটারি তার দল নিয়ে দালাল, রাজাকার ও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। গৌরনদী থানার দায়িত্বে ছিলেন হোসনাবাদের নিজামউদ্দীন এবং সহধিনায়ক ছিলেন মুলাদীর কুতুবউদ্দীন। ভারতে ট্রেনিং নিয়ে নিজামউদ্দীন ও কুতুবউদ্দীন গৌরনদী থানার নলচিড়া ও হোসনাবাদে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরামর্শদাতা ছিলেন আবদুর রহমান ও এডভোকেট কেশব দাস। অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে নিজামউদ্দীন গৌরনদী থানা আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে বাসাইল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আজিজ সিকদার বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ২৮ নভেম্বর নিজামউদ্দীনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কসবার পাক-বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে রাজিহারের আবদুল হক, কাসেমাবাদের আবুল বাসার খান, কালনার আবদুস ছত্তার প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। স্বাধীনতার পর নিজামউদ্দীন ১৯৮৪ সালে গৌরনদী বন্দরে আততায়ীর হাতে নিহত হন।

শ্যামপুর সংঘর্ষ, বাকেরগঞ্জ: এমপি মোজাম্মেল হক সিকদার, বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক ভিপি খান আলতাফ হোসেন ভুলু, নৌ-বাহিনীর নাসিরউদ্দিন, সেনাবাহিনীর বজলুর রহমান, লাল মজুমদার, বাবু মিয়া, প্রমুখের নেতৃত্বে বাকেরগঞ্জ থানার মুক্তিযোদ্ধাগণ সংগঠিত হন। তাঁরা শ্যামপুরের জমিদার নাঠু বাবুর বাড়িতে ও স্কুলে ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫ নভেম্বর ভারত থেকে বিমানবাহিনীর জহিরুদ্দীন একটি দল নিয়ে শ্যামপুর পৌঁছেন। ১৬ নভেম্বর ৬ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্ট হঠাৎ শ্যামপুর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। তুমুল যুদ্ধ চলে। মন্টু তার এলএমজি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটতে সাহায্য করে। সেদিন এলএমজি না থাকলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হতেন। শ্যামপুর যুদ্ধে মঙ্গলসির শাহজাহান ও কর্ণকাঠির আর্মি মোতালেব, কাদের ও রশীদ শহীদ হন। মোতালেব মুক্তিযুদ্ধকালে পুত্রসন্তান লাভ করেন। কিন্তু তিনি তার সন্তানকে দেখে যেতে পারেননি।

বাকেরগঞ্জ যুদ্ধ:পাক বাহিনী যশোর থেকে পালিয়েছে। বরিশাল থেকেও তারা ৮ ডিসেম্বর চলে যায়। কিন্তু তখনও বাকেরগঞ্জ থানা ও বাজার পুলিশের দখলে। ৬ ডিসেম্বর ভোরে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে কমান্ডার নাসিরউদ্দীন, বজলুর রহমান প্রমুখ বাকেরগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। ৩২ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। হাজার হাজার জনতা জয় বাংলা, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব স্লোগান দিচ্ছে। বিচ্ছু বাহিনী ভিতরে প্রবেশ করে হাত বোমা মেরে পুলিশ ও রাজাকাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। এ যুদ্ধে ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। বরিশাল শহরের পেসকার বাড়ির মীর মোয়াজ্জেম হোসেনের পুত্র মীর মোস্তাক হোসেন ছিন্টু গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ছিন্টু এ কে স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। রাজাপুরের চন্দ্রশেখর ও বাবুগঞ্জ থানার চর আলগীর শাহজাহান এ যুদ্ধে শহীদ হন। থানায় ১২৫ জন রাজাকার ছিল।

নৌকমান্ডো অপারেশন

নবম সেক্টর বরিশাল অঞ্চলে পাকিস্তান সরকারের নৌচলাচল বন্ধ করার জন্য সৈয়দ আবুল বাশারের নেতৃত্বে একটি নৌ-কমান্ডো প্রেরণ করে। সৈয়দ আবদুল বাশারের জন্ম রাজাপুরের গালুয়া গ্রামে। তিনি ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। তিনি পলাশীর ভাগীরথী নদীর তীরে মে হতে আগস্ট পর্যন্ত নৌকমান্ডো হামলার ওপর ট্রেনিং নেন। ২৮ আগস্ট ১২ জনের দলপতি হয়ে বাশার প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, লিমপেট, মাইন প্রভৃতি নিয়ে বরিশাল আসেন। তিনি কর্ণকাঠির শাহ আলম খাঁর বাড়িতে ক্যাম্প করেন। ১৪ নভেম্বর আবুল বাশারের নেতৃত্বে নৌকমান্ডোরা বরিশাল আইডব্লিউটি ঘাটে একটি জাহাজ ও দুটি অয়েল ট্যাংকার ধ্বংস করেন। চট্টগ্রাম থেকে আরও ১৭ জন নৌকমান্ডো কর্ণকাঠি এসে পৌঁছেন। তাঁদের নিয়ে বাশার ১৭ নভেম্বর বরিশাল লঞ্চঘাটে দুটি জাহাজ ঘায়েল করেন। বরিশালে নৌকমান্ডো হামলার ফলে পাক সেনাদের রসদ ও অস্ত্র সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তাঁরা গ্রামাঞ্চলে লঞ্চ ও গানবোটে হত্যা ও লুট করতে যাওয়া বন্ধ করে দেন।


মুলাদী, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জে যুদ্ধ কার্যক্রম

সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুর রহমানের নেতৃত্বে উত্তর বরিশালে মুক্তিযোদ্ধারা সুসংগঠিত হন। কমিশনার করিম হাওলাদার, সিংহেরকাটির আলতাফ হোসেন খান অরুণ ও ঠাকুর মল্লিক ডাক্তার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। আবদুর রহমান উল্কার বেগে মুক্তিবাহিনীর এক ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে ছুটে গেছেন। নিজের সঞ্চিত লক্ষাধিক টাকা মুক্তিযুদ্ধে ব্যয় করেছেন। মুক্তিযোদ্ধরা কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, এ ছিল তার সার্বক্ষণিক চিন্তা। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তিনি থানা ইউনিয়নে এবং গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক সমিতি গঠন করেন। সদর উত্তর মহকুমার মুক্তিযোদ্ধা সাহয়ক সমিতিতে যারা নিবেদিত কর্মী ছিলেন তারা হলেন আবুল খায়ের মাস্টার এমপিএ, এডভোকেট কেশব দাস, আতাহার উদ্দীন সিকদার, এডভোকেট হেমায়েত হোসেন, হিজলার মহম্মদ হোসেন, হাবিবুর রহমান, এডভোকেট নজরুল ইসলাম, ভুলু ডাক্তার, কমিশনার আবদুল করিম হাওলাদার, মেহেন্দিগঞ্জের তোফালুর রহমান, বাহাউদ্দীন খান প্রমুখ। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি মুলাদী থানার খাসেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা ও সহায়ক সমিতির সম্মেলন আহ্বান করেন। প্রায় ১০০০ মুক্তিযোদ্ধা এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় অরুণ ও শহীদ আলমগীর বক্তৃতা দেন। উত্তর বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারা আবদুর রহমানের নির্দেশে কমান্ডার নিজাম উদ্দীন, কুতুব, আনোয়ার, কুদ্দুস মোল্লা, মজিদ খান, আবদুল ওহাব খান প্রমুখ পাকবাহিনী রাজাকার ও দালালদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালান। নিজাম উদ্দীন ও কুতুব উদ্দীন মুলাদী থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে নেন। ছবিপুরে এক সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা হালিম শহীদ হন। কুদ্দুস মোল্লা, ওহাব খান, মজিদ খান প্রমুখ হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ থানা আক্রমণ করে অস্ত্র উদ্ধার করেন। ১৩ নভেম্বর কুদ্দুস মোল্লা পাতারহাট থানা আক্রমণ করেন। এ সংঘর্ষে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

বাবুগঞ্জে মুক্তিযুুদ্ধের কার্যক্রম

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাবুগঞ্জ থানা বিশেষ আবদান রেখেছে। বাকেরগঞ্জ জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের জন্ম হয়েছিল বাবুগঞ্জের ধুমচর গ্রামে; বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম বাবুগঞ্জের রহিমগঞ্জ গ্রামে; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আতাহার উদ্দিন সিকদার (দারোগা)’র জনাম বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুল ওহাব খানের বাড়ি দরিয়াবাদ, চাঁদপাশা; আবুল কাশেমের বাড়ি, রাজগুরু, বাবুগঞ্জ; আবদুল মজিদ খানের বাড়ি ক্ষুদ্রকাঠি; বিমান বাহিনীর রত্তন আলী শরীফের বাড়ি রাকুদিয়া; সামরিক বাহিনীর নূর হোসেনের বাড়ি কেদারপুর; সুলতান মাস্টারের বাড়ি মাধবপাশা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে এঁরা সকলেই বরিশালের উত্তরাঞ্চলে যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পর ১০ মার্চ বাবুগঞ্জ হাইস্কুলে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত বাবুগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আতাহার উদ্দিন সিকদার, আবুল কাশেম, আবদুল ওহাব খান, আবদুল মজিদ খান, রত্তন শরীফ, নূর হোসেন, সুলতান মাস্টার পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত অনুসারে বাবুগঞ্জ স্কুল মাঠে মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ চলে। প্রথমে ৩০ জন দিয়ে শুরু, পরে ট্রেনিংপ্রার্থীরা ১০০ জনে উন্নীত হয়। প্রাক্তন সামরিক ব্যক্তিরা প্রশিক্ষল দেয়। পুলিশ, আনসার, আর্মি সকলে একত্রিত হয়। ট্রেনিংদাতাদের মধ্যে ছিলেন আতাহার দারোগা, আবদুল মোল্লা, সুলতান আহমেদ মিয়া, নাজেম জমাদ্দার, আয়নাল খাঁ, আবদুর মালেক সর্দার, মন্নান খান, হাবিলদার সুলতান আহমেদ, আমির হোসেন মাস্টার, নায়েক আতাহার হোসেন প্রমুখ।

অক্টোবর মাসের ৩ তারিখে ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর বাবুগঞ্জ থানা আক্রমণ করেন। কিন্তু আবদুল ওহাব খান ও আবুল কাশেম ঠিক সময় আসার পূর্বে ক্যাপ্টেন শাহজাহান তার দল নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। পাক সেনাদের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে তিনজন আহত হন এবং উজিরপুর থানার ভবানীপুরের আলতাফ বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তাঁকে ভবানীপুরে দাফন করা হয়। বরিশাল- রহমতপুর রাস্তার ৭ মাইলের পুলটি আবদুল ওহাব খানের দলের কালু প্যাদা মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেন। পাক বাহিনী এ পুল অতিক্রম করার সময় ওহাব খানের দল তাদের আক্রমণ করেন। জিপ নিয়ে পাক সেনারা ৭ মাইলে ভাঙ্গাপুলের নিচে পড়ে যায়। অফিসারসহ কয়েকজন নিহত এবং কয়েকজন রাজাকার বন্দি হয়। ১৫ও ১৬ অক্টোবর পাকসেনারা ১৬ পাঞ্জাব ব্রিগেডের অধিনায়ক লে. কর্নেল নাদের পারভেজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি চাঁদপাশা চারদিক দিয়ে আক্রমণ করে।

সুইসাইডাল স্কোয়াড, বরিশাল শহর

বরিশাল অঞ্চলে সুইসাইডাল বাহিনীর গ্রুপ লিডার ছিলেন রেজায়ে সাত্তার ফারুক। আটঘর কুড়িখানায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ফারুক সাহসিকতা ও নৈপুণ্যের পরিচয় দেয়। তিনি ছিলেন সিরাজ শিকদার বাহিনীর একজন কমান্ডার। পাক বাহিনীর আটঘর অপারেশনের পর সিরাজ শিকদারের পার্টি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের সাথে মতবিরোধ থাকায় সিরাজ শিকদার বরিশাল অঞ্চল ছেড়ে যান। রেজায়ে সাত্তার ফারুক পেয়ারাবাগান হতে চলে আসার পর নবম সেক্টর তাঁকে বরিশালের সুইসাইডাল স্কোয়াডের কমান্ডার নিয়োগ করে। স্কুলের অনেক ছাত্র ভারতে ট্রেনিং নিয়ে বিচ্ছু বাহিনীতে যোগ দেয়। বিচ্ছু বাহিনীর আলম ও গিয়াসউদ্দীন হাত বোমা নিক্ষেপ করে বরিশাল শহরে পাক বাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। সুইসাইডাল স্কোয়াডে ছিলেন ফারুক, আবদুস ছাত্তার, সুলতান আলম মজনু, সিরাজুল আলম জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, মোফাজ্জেল, তোফাজ্জেল হোসেন খোকা, কুমুদরঞ্জন, বাবুল। সিদ্ধান্ত হলো তারা একই সময় বরিশাল শহরের প্রধান স্থানে বোমা নিক্ষেপ করবে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা পাকসেনা ও রাজাকারদের দখলকৃত শহরে হামলা চালাবে। স্কোয়াড বরিশালে আক্রমণ চালায়। ফারুক বিএম স্কুলের মাঠ থেকে রিভলবারের গুলি ছুড়ে সংকেত দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বরিশাল শহরে বোমা বিস্ফোরিত হতে থাকে। কুমুদরঞ্জন হসপিটালের নিকট, বাবুলচন্দ্র সেন ও রাখালচন্দ্র সেন বিসমিল্লাহ বর্ডিং ও সোনালী সিনেমা হলে বোমা নিক্ষেপ করে। মালেক মোসলেম রেস্টুরেন্ট, রবীন বটতলায়, ও ফারুক সিএসডিতে বোমা নিক্ষেপ করে। এরপরে প্রায় দিন শহরে আক্রমণ করা হয়। তাদের ক্যাম্প ছিল মাধবপাশা। ভারতের বিরুদ্ধে ৩০ নভেম্বর শান্তি কমিটির নেতৃত্বে বরিশালে শোভাযাত্রা বের করা হয়। জনগণকে জোর করে শোভাযাত্রায় যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। শান্তি কমিটির সাজাহান চৌধুরী, এডভোকেট আবদুর রব, এডভোকেট শমশের আলী প্রমুখ শোভযাত্রার নেতৃত্ব দেয়। সাথে বদর বাহিনী অস্ত্র নিয়ে যোগ দেয়। রেজায়ে সাত্তার ফারুকের নেতৃত্বে সুইসাইডাল স্কোয়াড শোভা যাত্রার উপর ঝটিকা আক্রমণ চালায়। বাজার রোডে মিছিলের উপর হাত বোমা নিক্ষেপ করে ১৩ বছরের ছাত্র রকেট, জেলখানার নিকট আক্রমণ চালায় বিচ্ছু গিয়াসউদ্দীন। হাসপাতাল রোডে আওয়ামী লীগের কাজেম মিয়ার বাসা হতে কুমুদরঞ্জন তার সহযোদ্ধাকে নিয়ে চাইনিজ রাইফেল দিয়ে শোভাযাত্রার উপর গুলিবর্ষণ করে। কয়েজন নিহত ও আহত হয়। শোভাযাত্রা ভেঙ্গে যায়। পাক বাহিনী ও রাজাকারেরা কাজেম মিয়া ও ছাত্রনেতা আলতাফ হোসেন অরুণের বাসা ও পাড়া জ্বালিয়ে দেয়। ঘটনার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে ঝাউতলা থেকে মতি সেন, ক্যাপ্টেন ইউএন গুহ ও মোজাম্মেলকে গ্রেফতার করা হয়। ঘোষণা করা হয় পরের দিন মতিসেন ও ইউএন গুহকে টাউন হলে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়া হবে। কিন্তু ফাঁসি দেয়া হলো না। ৩০ শে নভেম্বর শোভা যাত্রার উপর আক্রমণ পাক বাহিনীকে ভীত করে দেয়। শহরে প্রকাশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। বরিশাল শহরের চারদিকে তখন মুক্তিবাহিনী অবস্থান নিয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা বরিশাল আক্রমণ করতে পারে।


বরিশালের মুক্তি অর্জন (৮ ডিসেম্বর)

নভেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধারা বরিশাল, পটুয়াখালী রিভিন্ন রণাঙ্গণে সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত পাক সেনাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে তাদের শক্তি ও বীরত্বের পরিচয় দেয়। এ মাসে অধিক সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগর থেকে বরিশাল আগমন করে। মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকশ’ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। নভেম্বর মাসের পূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল না। পাক সেনাদের আক্রমণের ভয়ে তারা এক জায়গায় বেশি দিন থাকতো না। কিন্তু নভেম্বর মাস হতে তারা অনেকগুলো স্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ছিল বরাকোটা, বিন্না, শরিকল, পাদ্রীশিপপুর, কেউন্দিয়া, শ্যামপুর, দুধাল, চরামন্দি, কামারখালী, বিনয়কাটি, চাঁদপাশা, আগরপুর, ঠাকুর মল্লিক, বদরটুনী, পয়সারহাট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একমাত্র ভোলয় ৪৮টি ক্যাম্প ছিল। সুন্দরবনে ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দিনের অধীনে অনেক ক্যাম্প ছিল। তারা প্রধান ক্যাম্প ছিল বগী। বরাকোটা যুদ্ধের পর ক্যাপ্টেন ওমর তার ক্যাম্প স্বরূপকাঠি থানার বিন্না গ্রামে স্থানান্তর করেন। নভেম্বর মাসে তিনি তাঁর ক্যাম্প পাদ্রীশিবপুরে নিয়ে আসেন। পাদ্রীশিবপুরের ফাদার জার্মান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপুরুষ। তার সেবায় সকল মুক্তিযোদ্ধা ছিল মুগ্ধ।

৪ অক্টোবর ২০০ মুজিববাহিনী যশোর হয়ে বরিশাল ও ফরিদপুরে আসছিল। কিন্তু পাক বাহিনীর বিমান হামলায় অনেকে নিহত হয়। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ একদল মুজিব বাহিনী নিয়ে গোপালগঞ্জ হয়ে গৌরনদী আসেন। কোতোয়ালির মনসুরুল আলম মন্টু, ঝালকাঠির সঞ্জীব, গৌরনদীর ফজলুর রহমান, বাকেরগঞ্জের এনায়েত, স্বরূপকাঠির মহসীন, পটুয়াখালী শহরের মোশারেফ, সর্দার রশীদ, আমতলীর গাজী আনোয়ার, গলাচিপার বারেক ঢালী প্রমুখ মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। তাদের সাথে পয়সারহাটে পাক বাহিনীর যুদ্ধ হয়। আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ গৌরনদী অঞ্চলে কয়েকটি আক্রমণ পরিচাণনা করেন। কমান্ডার নিজামুদ্দীন ও হাসনাত গৌরনদী থানা আক্রমণ করেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন কাহার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ১৮ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন কাহার নুরুল ইসলাম মঞ্জুর নিকট আত্মসমর্পণ করেন।

১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিত্রবাহিনী গঠন করে। তারা একযোগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পাক সেনারা ১৬ নভেম্বর হতে বরিশাল, পটুয়াখালীর ক্যান্টনমেন্টে সীমাবদ্ধ থাকে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় সকল থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। ৩ ডিসেম্বর পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর বরিশাল ও রহমতপুর বিমান ঘাঁটিতে মিত্র বাহিনী বোমা বর্ষণ করে। ৮ ডিসেম্বর সকাল ১০ টায় বরিশালে পাক সেনারা কার্ফু দেয়। যশোর ও খুলনা থেকে পাক সেনারা পালিয়ে আসে এবং তারা কয়েকটি লঞ্চে ঢাকা অভিমুখে যাবে। বরিশাল ওয়াপদা অফিসের পাকসেনা বেলা ১১টার মধ্যে লঞ্চে আরোহণ করে। তারা ১২টার মধ্যে লঞ্চ ও স্টিমারযোগে বরিশাল ত্যাগ করে। তাদের মধ্যে বরিশাল শান্তি কমিটির সম্পাদক সাজাহান চৌধুরী চলে যান। এদিকে সঙ্গে সঙ্গে মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা চলতে থাকে। সাজাহান চৌধুরীর লঞ্চটি চাঁদপুরের পশ্চিম তীরে ফরিদপুরের চরে ৯ ডিসেম্বর বিমানের হামলায় ধ্বংস হয়। তিনি সেখানে মারা যান। গ্রামবাসীরা পরে তাকে নদীর তীরে কবর দেয়। পাক সেনাদের কয়েকটি লঞ্চ বরিশাল শহর থেকে ১৫ দূরে নন্দীবাজারের নিকট বিমান হামলায় আক্রান্ত হয়। লঞ্চ ডুবে গেলে পাক সেনারা পশ্চিম পারে ঠাকুর মল্লিক ও পূর্ব পারে নন্দীরবাজারে ওঠে। সংবাদ পেয়ে আগরপুর হতে নূর হোসেন কমান্ডার ও হাজার হাজার গ্রামবাসী ছুটে আসে। নূর হোসেন অনেক পাক সেনা হত্যা করে। গ্রামবাসীরা তাদের দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এমনকি মেয়েরা ঝাড়ু দিয়ে তাদের পিটায়।

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বরিশাল স্বাধীন হয়। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত দিবস। বেলা ১১টার পরই জনগণ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটির দালালেরা দ্রুত পালাতে থাকে। সকল বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বিকালে সুলতান মাস্টার তার বাহিনী নিয়ে শহর উঠে পড়ে। ১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর শহরে আসে। তারপর সকল মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার তাদের দল নিয়ে শহরে আসতে থাকে। চারদিকে বিজয় উল্লাস। আবার অনেকে প্রিয়জনদের হারানো ব্যথায় আনন্দাশ্রু ফেলছে। মুক্তিযোদ্ধারা দালালির অভিযোগে শর্ষিনার পীর মওলানা আবু জাফর মুহম্মদ সালেহ, মুসলিম লীগনেতা সৈয়দ মুহম্মদ আফজাল, আবদুর রব, শমসের আলী, সুলতান সর্দার, ইলিয়াস মাস্টারকে গ্রেফতার করে। অনেক দালালকে মৃত্যুদ- দেয়া হয়। তখন জেলার শাসন নিয়ে সমস্যা হয়। সংগ্রাম কমিটির সভাপতি আবদুর রহমান বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তার দপ্তর ছিল পেশকার বাড়িতে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের বাসায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর দাবি করলেন সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি জেলায় প্রধান। ১৭ ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাসহ বরিশাল শহরে পৌঁছেন এবং তিনি সাময়িকভাবে জেলার প্রশাসন পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।

১৮ ডিসেম্বর মেজর এম এ জলিল বরিশাল পৌঁছলে তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে যেমন বরিশালের কাজী বাহাউদ্দীন ও মহিউদ্দীনের নাম সুপরিচিত ছিল তেমনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মেজর এমএ জলিল খ্যাতি লাভ করেন। ২১ ডিসেম্বর হেমায়েত উদ্দীন খেলার মাঠে বিজয় উপলক্ষে বিরাট জনসভা হয়। নুরুল ইসলাম মঞ্জু ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ বক্তৃতা দেন।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫