বরিশালে ইংরেজ বিরোধী সংগ্রাম (প্রাথমিক পর্ব)

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১১:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭ শতকের শেষভাগে সুবাদার শায়েস্তা খানের সময় প্রথম বাকলায় বাণিজ্য শুরু করে। তারা বরিশালের গিরদে বন্দর, বাকেরগঞ্জ ও সুতালরী বন্দরে ব্যবসা করত। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ বণিকরা বাকেরগঞ্জের বন্দরগুলো দখল করে নেয়। এরপর থেকে ইংরেজ বণিকরা দেশীয় বণিকদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। এই অত্যাচারে দিশাহারা হয়ে একসময় বরিশালের বণিকরা ও সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ শুরু করে।


ইংরেজ বণিকদের অত্যাচারের প্রথম ধাপ

ইংরেজরা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার জন্য ছাড়পত্র বা দস্তক ব্যবহার কত। অথচ দেশীয় বণিকদের শুল্ক দিতে হতো। কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের অত্যাচারে বাকেরগঞ্জ, সুতালরী ও বারৈকরণ বন্দর পূর্ব গৌরব হারিয়ে ফেলে এবং দেশীয় বণিকরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরুদ্ধে বাংলার নবাব মীর কাশিম প্রতিবাদ জানান এবং এ নিয়ে তার ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ হয়। বাকেরগঞ্জ বন্দরে ইংরেজ বণিক ও তাদের গোমস্তাদের অত্যাচার এত তীব্র ছিল যে, ১৭৬২ খৃৃস্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলার গভর্নর ভেন্সিটারট এ অত্যাচার বন্ধ করার জন্য সার্জেন্ট ব্রেগোকে প্রেরণ করেন।

নবাব মীর কাশিমের হস্তক্ষেপ

আগাবাকের খান কর্তৃক ১৭৪০ খৃৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বাকেরগঞ্জ, বর্তমান বরিশাল শহরের গিরদে বন্দর, ঝালকাঠির সুতালরী ও বারৈকরণ প্রভৃতি বন্দর ইংরেজ বণিকদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়। নবাবের বাণিজ্য খাতের আয় হ্রাস পায় এবং দেশীয় ব্যবসা ধ্বংস হতে থাকে। নবাব মীর কাশিম গভর্নর ভেন্সিটারটকে বাকেরগঞ্জের ইউরোপীয় বণিকদের অত্যাচার বন্ধের নির্দেশ দেন। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে নবাব মীর কাশিমের নির্দেশে ভেন্সিটারট সার্জেন্ট ব্রেগো ও মাত্র ৬ জন সিপাহীকে বাকেরগঞ্জ বন্দরে প্রেরণ করেন। বরিশাল বন্দরে ইংরেজ বণিকদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার প্রতিবাদ জানিয়ে নবাব মীর কাশিম ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ২৬ ডিসেম্বর গভনর ভেন্সিটারটের নিকট এক পত্র লেখেন:

The following extract from a leter of the Nawab (Mir Kassim) to Mr. Vansittart gives another picture of the state of matters. It appears to have been written on 26th December 1762, and is printed at P. 167 of the 20 volume of Vansittart’s Narrative:

“As the Company’s gomastahs make salt at Sundeep, & c., I desire you will write to them not to make any more there, but, like other merchants, to purchase it from the molunghies at the market price.”

“In the Parganas of Gopalpur and Dakhanbarpur [Dakhin Shahbapur], and other districts where salt is made, the people of the Company’s factory work the saltpans; and they take possession of all the salt which the molunghies of other parganas have made, by which means I suffer a very great loss. Moreover, they oblige the ryots to receive money from them for purchasing rice, and by force and violence they take more than the market price affords, and the ryots all run away on account of these oppressions. For many years it has been customary for the Cashmere merchants to advance money at Sunderbund, and provide molunghies to work the salt-pans there: they paid the rents for the salt-pans at the several parganas; and the duties on the slat, which were paid at Burry-saul Chokey, belonging to the Shahbunder, amounted to near Rs. 30,000. At present the people of the factory have dispossessed the Cashmere merchants, and have appropriated all the salt to themselves.”


নবাব মীর কাশিমের উপরোক্ত পত্রখানা বরিশালের ইতহাসে গুরুত্বপূর্ণ। তার পত্রে আমরা প্রথম বরিশালের নাম জানতে পারি। এ অঞ্চলের জনগণকে তিনি কোম্পানির শোষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য পত্র লিখে ক্ষান্ত হননি। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধও করেন তবে যুদ্ধে তিনি পরাজয় বরণ করেন।


বিদ্রোহের শুরু

প্রথম কৃষক বিদ্রোহ- কোম্পানির বণিক ও তাদের কর্মচারীরা যখন শোষণ ও অত্যাচারের শেষ সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন বরিশালের বিভিন্ন স্থানে বণিক ও কৃষকরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাংলাদেশের মধ্যে বরিশালে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পরপরই একদল কৃষক রাজবল্লভকে রাজস্ব প্রদানে অস্বীকার করে। তাদের দমন করার জন্য রাজবল্লভ সশ্রস্ত্র পর্তুগীজদের নিয়োগ করে। এ জেলার বিদ্রোহী কৃষকরা ইংরেজদের বাণিজ্য জাহাজ ও কুঠি আক্রমণ করে এবং অনেক ইউরোপীয়কে হত্যা করে। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেষ্টিংসের এক বিবরণে দেখা যায় ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে একদল ফকির বরিশালের ইংরেজ রেসিডেন্টের কুঠি আক্রমণ করে। কিন্তু বিদ্রোহীরাা ইংরেজ, কুঠি দখল করতে ব্যর্থ হয়। ১৭৬৪ খৃৃস্টাব্দে বিদ্রোহীরা বাকেরগঞ্জ বন্দরের নিকট ইংরেজ বণিক ক্যাপ্টেন রোজের বাণিজ্যতরী আক্রমণ করে এবং তাকে হত্যা করে। গভর্নর ভেন্সিটারট নবাব মীর জাফর আলী খানকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর এক পত্র লেখেন।

গভর্নর ভেন্সিটারটের পত্র পেয়ে নবাব মীর জাফর ঢাকার নায়েব আজিম জেসারত খানকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন। জেসারত খান একদল সিপাহীকে বাকেরগঞ্জে প্রেরণ করেন। তারা স্থানীয় জনগণের ওপর অত্যাচার করে এবং কোম্পানির সন্তুষ্টি লাভের জন্য অনেক বিদ্রোহীকে গ্রেফতার করে।


মি. উইলিসের ওপর আক্রমণ

সিলেট জেলার ইংরেজ কালেক্টর মিঃ উইলিস যখন বাকেরগঞ্জ নদীপথ অতিক্রম করেন, তখন বিদ্রোহীরা তাকে আক্রমণ করে। তিনি তাড়াতাড়ি নৌকা তীরে রেখে পালাতে সক্ষম হন। ঢাকার কালেক্টর মিঃ ডে (১৭৮৫-৯০) বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য সিপাহী প্রেরণ করেন। তারা মিঃ উইলিসের আক্রমণকারীদের অনেককে গ্রেফতার করে। আক্রমণকারীরা ১৮ মাস ধরে সুন্দরবনাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। মিঃ ডের প্রেরিত সশস্ত্র নৌকাগুলো তাদের সন্দ্বীপ ও সমুদ্রোপকূল পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তারা সমুদ্রের জলোচ্ছাসে প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। দেড় দিন পর্যন্ত উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তারা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে এবং তাদের কঠোর শাস্তির জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়।


সৈয়দ ইমামউদ্দিনের বিদ্রোহ

১৭৭৯ খৃৃস্টাব্দে নলচিড়ার জমিদার সৈয়দ ইমামউদ্দিন ও পলাশী থেকে আগত নবাব সিরাজউদ্দৌলার একদল সৈন্যের সাথে ইংরেজদের শরিকলের নিকট যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বিদ্রোহীরা পরাজয় বরণ করে। রাজস্ব দিতে অস্বীকার করলে ওয়ারেন হেষ্টিংস ১৭৭৭ খৃৃস্টাব্দে উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার লালরাম ও নলচিড়ার জমিদার সৈয়দ ইমামউদ্দিনকে গ্রেফতার করে কলিকাতায় নিয়ে যায়। ইদিলপুরের জমিদার রামকান্ত ঢাকার সোনারগাঁওয়ের ইংরেজ ফ্যাক্টরি আক্রমণ করেছিল। পরে রামকান্তকে বন্দী করে বাকেরগঞ্জ, ঢাকা ও মুর্শিদাবাদ জেলখানায় আটক করে রাখা হয়। খৃৃস্টাব্দে


আইন উদ্দিন সিকদারের বিদ্রোহ

বুজুর্গ উমেদপুরের তালুকদার কড়াপুরের মোহাম্মদ হায়াত ও নিয়ামতির আইন উদ্দিন সিকদার কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ঢাকার নায়েব নাজিব ও কোম্পানির সিপাহীরা ১৭৮৫ খৃৃস্টাব্দে আইনউদ্দিন সিকদারের বাড়ি আক্রমণ করে তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং বিষখালী নদীর মধ্যে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মোহাম্মদ হায়াতকে গ্রেফতার করে কারাদ- দেয়া হয়।


বলখী শাহের বিদ্রোহ

১৭৮৭ খৃৃস্টাব্দে বন্যার ফলে বরিশালে এক ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয় এবং হাজার হাজার লোক প্রাণত্যাগ করে। এ সত্ত্বেও ইংরেজদের শোষণ ও অত্যাচার চলতে থাকে। সুগন্ধিয়ার ফকির বলখী শাহ তথা বুলাকী শাহ একদল বিদ্রোহী নিয়ে ইংরেজদের রাজস্ব দেয়া বন্ধ করে দেয় এবং ঘোষণা করে ইংরেজ রাজত্ব শেষ। ১৭৯১ খৃৃস্টাব্দে একদল সিপাহী বলখী শাহের দুর্গ আক্রমণ করে। তিনি পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান।

এমনিভাবে বরিশালের তথাকথিত ডাকাত, যারা ছিল দেশপ্রেমিক এবং বিদ্রোহী তারা পলাশীর পর ইংরেজ শাসন বীরবে মেনে নেয়নি। এই বিদ্রোহীদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য কোম্পানি সরকার বাকেরগঞ্জে সিভিল জজ ও সুন্দরবন কমিশনার নিয়োগ করে। পরিশেষে তারা বাকেরগঞ্জকে ১৭৯৭ খৃৃস্টাব্দে জেলায় পরিণত করতে বাধ্য হয়। ১৭৫৭ খৃৃস্টাব্দে হতে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বরিশালের ইতিহাস এ জেলার জনগণের ইংরেজদের বিরুদ্ধে সগ্রামের ইতিহাস। দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বরিশালকে দখলে নিতে তীব্র বাধার সম্মুখীন হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এর মাধ্যমে এ জেলায় একদল অনুগত জমিদার সৃষ্টির ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ হ্রাস পেতে থাকে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।