দনুজমর্দন দেব

Barisalpedia থেকে

দনুজমর্দন দেব ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মূল নাম রামনাথ দে। দনুজমর্দন তাঁর উপাধি। দনু অর্থ অসুর, আর সে মোতাবেক দনুজ অর্থ হলো অসুরজাত। মর্দন অর্থ ধ্বংস বা হত্যা। তিনি তৎকালীন গৌড় ও লক্ষ্ণৌয়ের মুসলমান রাজশক্তি অর্থাৎ অসুরজাত রাজশক্তির মোকাবিলায় চন্দ্রদ্বীপে স্বাধীন হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বলে দনুজমর্দন উপাধি ধারণ করেছিলেন। তিনি চন্দ্রদ্বীপের চারশো বছরের অধিককাল স্থায়ী হওয়া স্বাধীন রাজ্যের স্থপতি ছিলেন। তিনি দুর্জয় সাহসী ও তৎকালীন ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন। সুলতানী আমলে হিন্দু রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে দনুজমর্দন মৃতপ্রায় হিন্দু সমাজে পুনর্জাগরন সৃষ্টি করেন। দনুজমর্দনের পূর্ব পরিচয়, তার রাজত্বকাল ও বংশধরদের ইতিহাস কুয়াশাচ্ছন্ন। দনুজমর্দন বিভিন্ন নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদ স্টুয়ার্ট তাকে দনুজ, দিনুজ রায়; আবুল ফজল তাকে নোজা ও নৌজা বলেছেন। ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারাণী তাকে দনুজ রায় বলেছেন।


ব্যক্তিপরিচয়

ঐতিহাসিক নগেন্দ্রনাথ রায়, দুর্গাচরণ সান্যাল, নিখিলনাথ রায়, ড. কে. আর. কানুনগো, ড. ওয়াইজ, মি. বেভারিজ, সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরী, ব্রজসুন্দর মিত্র, সতীশ চন্দ্র মিত্র ও ঘটক কারিকাগণের মতে, দনুজমর্দন দেব ছিলেন সেন বংশোদ্ভূত। ঐতিহাসিক দুর্গাচরণ সান্ন্যাল বলেন যে, বল্লাল সেনের উপ-পতœীর গর্ভে কালু রায় নামে এক পুত্র ছিল। বল্লাল সেন কালু রায়কে চন্দ্রদ্বীপের সামন্ত রাজা নিযুক্ত করেন। দনুজমর্দন দেব কালু রায়ের বংশধর। গৈলা-ফুল্লশ্রীতে কালুপাড়া নামে একটি গ্রাম আছে। হয়ত কালু রায়ের নামে এ গ্রামের নামকরণ হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, দনুজমর্দন লক্ষ্মণ সেনের পৌত্র। বখতিয়ার খলজীর নিকট পরাজিত হয়ে লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গে পালিয়ে আসেন এবং বিক্রমপুরে ১২০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন ১২২৫ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। অনেকের মতে বিশ্বরূপ সেনের মৃত্যুর পর তার পুত্র দনুজমর্দন সিংহাসনে আরোহণ করেন। ‘চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ’ গ্রন্থের প্রণেতা ব্রজসুন্দর মিত্র বলেছেন মহারাজ লক্ষ্মণ সেনের পরে দনুজমর্দন সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং স্বীয় গুরু চন্দ্রশেখরের নামে রাজ্যের নামকরণ করেন চন্দ্রদ্বীপ। ব্রজসুন্দর মিত্র দনুজমর্দনকে ভরদ্বাজ গোত্র কায়স্থ বলে উল্লেখ করেছেন। দনুজমর্দনের জীবনকালের সঠিক তারিখ আমরা আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি। তবে দেখা যায় চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের সপ্তম রাজা পরমানন্দ কোটালীপাড়ায় শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ইতিহাসবিদদের মতে তিন রাজার রাজত্বকালকে এক শ’ বছর ধরা হয়। আমরা যদি পরমানন্দের সিংহাসনের আরোহণের তারিখ ১৫০০ খ্রিঃ ধরি তাহলে তার পূর্বে ৬ জন রাজার রাজত্বকাল দাঁড়ায় দু’শ বছর। সুতরাং দেখা যায় দনুজমর্দন ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁর জীবনকাল আশি বছরের হলে তার জন্ম ১২৪০ বলে ধরা যায়। আবার রোহিণী রায় চৌধুরী আমাদের দেশে ৩০ বৎসরে এক পুরুষ গণনা করা যায়, এবং ইহাই ঐতিহাসিকদিগের মত। রাজা জগদানন্দ, দনুজমর্দনের সাত পুরুষ অধস্তন, সুতরাং অনুমান ২০০ বৎসর পরবর্তী। তিনি স¤্রাট আকবরের সমকালীন; উক্ত স¤্রাট ১৫৪২ খ্রিঃ অব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এই ১৫৪২ হইতে ২০০ বৎসর বাদ দিলে ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দ দনুজমর্দনের রাজত্বের সূচনাকাল বলা যেতে পারে।

কিংবদন্তীগত পরিচয়

ব্রজসুন্দর মিত্র তার পুস্তকে দনুজমর্দনের পরিচয়ে একটি কিংবদন্তীর কাহিনি বর্ণনা করেছেন। চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী নামে এক ব্রাহ্মণ তার শিষ্যদের নিয়ে সুগন্ধা নদীতে তীর্থ ভ্রমণে আসেন। রামনাথ দনুজমর্দন নামে তার এক শিষ্য ছিল। চন্দ্রশেখর রাতে স্বপ্নে দেখলেন জগদম্বা কালীদেবী তাকে বললেন, তাদের নৌকার অনতিদূরে সুগন্ধার বুকে তিনটি পাষাণ মূর্তি নিমজ্জিত আছে, তার শিষ্য দনুজমর্দন যেন মূর্তিগুলো তোলেন। গুরুর আদেশে দনুজমর্দন নদীতে ডুব দিয়ে প্রথমে কাত্যায়নী ও পরে মদন গোপালের পাষাণ মূর্তি উঠালেন। তিনি তৃতীয় ডুব দিতে সাহস করলেন না। তৃতীয় ডুব দিলে তিনি মহালক্ষ্মীর মূর্তি উঠাতে পারতেন। নিকটেই তারা একটি দ্বীপ দেখতে পেলেন এবং দ্বীপের কচু বনে (বর্তমান কচুয়া) মূর্তিগুলো স্থাপন করলেন। দনুজমর্দন বিক্রমপুর থেকে লোক নিয়ে এলেন এবং দ্বীপে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন। গুরুর নামে রাজ্যের নামকরন করলেন চন্দ্রদ্বীপ।

সোনারগাঁওয়ের দনুজমাধব ও চন্দ্রদ্বীপের দনুজমর্দন

ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারাণীর তারিখ-ই ফীরূজ শাহীতে বর্ণিত তুঘরল খার বিদ্রোহ বিষয়ক ঘটনার সংশ্লেষে অনেক ঐতিহাসিক সোনারগাঁওয়ের দনুজমাধব ও চন্দ্রদ্বীপের দনুজমর্দনকে অভিন্ন মনে করেন। তুঘরল খাঁর বিদ্রোহ সম্পর্কে বারাণী বলেন যে, গিয়াসউদ্দীন বলবন ১২৮১ খ্রি. নিজে তুঘরল খাঁকে দমন করার জন্য লক্ষ্ণৌ রওনা দেন। মুগীসউদ্দীন তুঘরল পূর্ববঙ্গের সোনারগাঁওয়ের নিকট নারকিলার দুর্গে আশ্রয় নেন। তখন সোনারগাঁওয়ের রাজা ছিলেন দনুজ রায়। বলবন তার সাক্ষাত কামনা করলেন। দনুজ এক শর্তে বলবনের সাথে দেখা করতে রাজি হলেন যে, বলবন তাকে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাবেন। শেষ পর্যন্ত কবুতর ওড়াবার ভান করে বলবন সিংহাসন থেকে উঠে দনুজমর্দনকে অভ্যর্থনা জানালেন। উভয়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত হলো যে, তুঘরল জলপথে পলায়ন করলে দনুজ রায় তুঘরলকে বাধা প্রদান করবেন। এ সংবাদ শুনে তুঘরল প্রিয়জনদের নিয়ে উড়িষ্যার জজনগরের দিকে পালিয়ে যান। অনেকে অনুমান করেন যে দনুজমর্দন গিয়াসউদ্দীন বলবনের এই অভিযানে সাহায্য করেছিলেন এবং খুব সম্ভব তার পুরস্কারস্বরূপ তিনি চন্দ্রদ্বীপ লাভ করেছিলেন। অবশ্য এ মত পরবর্তী অনেক ঐতিহসিক পরিত্যাগ করেছেন।

দনুজমর্দনের বাকলা সমাজ

দনুজমর্দন বল্লাল সেনের মতো বঙ্গজ কায়স্থদের সমাজ সমীকরণ করেন। বিক্রমপুর হতে সেন রাজদের পতনের পর তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘বিক্রমপুর সামাজ’ ভেঙ্গে পড়ে। বাংলার উচ্চকোটি হিন্দুদের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপে সমাজ সমীকরণ করে বঙ্গজ কায়স্থ সমাজ পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। এ সমাজের জনপ্রিয় নাম ছিল ‘বাকলা সমাজ’। চন্দ্রদ্বীপে রাজা হইয়া দনুজমর্দন দেব প্রদেশে কায়স্থ সমাজে গোষ্ঠী পতিত্ব লাভ করেন। দনুজমর্দন নিজ রাজধানীতে কুলীন কায়স্থগণের সমীকরণ করেন। ফলশ্রুতিতে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ একটি প্রসিদ্ধ সমাজ স্থান হয়। দনুজমর্দন বঙ্গজ কুলীন সমাজের গোষ্ঠীপতি ছিলেন। দনুজমর্দন বঙ্গীয় কায়স্থদের অস্তিত্ব রক্ষা করে হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি নিজে ভরদ্বাজ গোত্র দেববংশীয় মৌলিক কায়স্থ শাখাভুক্ত ছিলেন। তিনি প্রথমে বঙ্গীয় কায়স্থ সমাজ গঠন করেন। তারপর তিনি বাকলা সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বঙ্গজ কুলীনদের ৫/৬/৭ পর্যায় নিয়ে প্রথম সমাজ সমীকরণ বা সংস্কার করেন। তার নেতৃত্বে বাকলা সমাজ বাংলাদেশে শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে- “চন্দ্রদ্বীপং শিরস্থান যত্র কুলীনমন্ডলং”।

এই সমাজে চন্দ্রদ্বীপের কুলীন হিন্দুরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপ স্বাধীন রাজ্য। তাই উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ তাদের অস্তিত্ব, বর্ণ ও ধর্মকে টিকিয়ে রেখে কৌলীণত্বের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। বাকলা সমাজ উত্তরে ঢাকার বিক্রমপুর, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভুলুয়া, সন্ধীপ ও পশ্চিমে যশোর-খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সীমার বাইরে কেউ বাস করলে তার কৌলীন্য নষ্ট হতো। কুলীন কায়স্থরা স্বদেশী ব্যতীত যাতে বিবাহ কার্য না করেন সে জন্য দনুজমর্দন বিশেষ নিয়ম বিধিবদ্ধ করেন। তিনি ইদিলপুরের কায়স্থদের কুলাচার্যগণকে ব্রহ্মোত্তর প্রদান করেন। ইদিলপুরের ভূমিদান গ্রহণ করে অনেক ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ বসতি স্থাপন করেন। ‏তারা ও তাদের বংশধররা ঘটক সর্নামত্য ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ সমাজে বিশেষ পূজ্য। দনুজমর্দন কুলীনদের বিশুদ্ধি রক্ষা করার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে কুলাচার্য বা ঘটক এবং সর্নামত্য নামক দু’টি পদ সৃষ্টি করেন। রাজার নিমন্ত্রিত কুলীন কায়স্থরা ভোজনের সময় কে রাজার দক্ষিণে বা কে বামে বসবেন কুলগ্রন্থ দেখে তার নির্দেশ করতে দিতেন। তদনুসারে কুলীনরা ভোজন সারিতে মর্যাদা অনুসারে বসতেন। কায়স্থরা রাজপুরীতে যে অংশে ভোজন করতেন তার নাম ছিল ‘চিত্রছত্র’। মাঝখানে সমাজপতি রাজার আসন ছিল। রাজার স্থাপিত কায়স্থ সমাজের মধ্যে পুত্র-কন্যা বিবাহের পূর্বে রাজার অনুমতি নিতে হতো এবং রাজাকে রাজমধ্যস্থ নামে কর দিতে হতো। রাজার বিনানুমতিতে বিবাহ হলে দন্ডিত হতো। ব্রাহ্মণদিগকে রাজা ‘নমস্কারা নিবেদনঞ্চ বিশেষ’ পাঠে পত্র লিখতেন এবং কুলীনদের ‘সানুগ্রহ পত্রমিদং’ ইত্যাদি লিখতেন। কোন ব্রাহ্মণ বা কুলীন রাজাকে ‘আর্দ্দান শ্রী’ এভাবে লিখতে হতো। কায়স্থরা রাজসভায় উপস্থিত হলে রাজাকে কুর্নিশ করতে হতো। এ প্রথা চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের মধ্যে বহুদিন প্রচলিত ছিল।

দনুজর্মনের আগমনের পূর্বে চন্দ্রদ্বীপে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের সংখ্যা বেশি ছিল না। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও বাকলা সমাজ গঠনের ফলে চন্দ্রদ্বীপে অনেক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, ঘটককারিকা ও সংস্কৃত পন্ডিত চন্দ্রদ্বীপে আগমন করেন। গৌড় ও সোনারগাঁও মুসলমান সুলতানদের অধীনে থাকায় হিন্দু কুলীনরা চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয় নেয়। চন্দ্রদ্বীপ একমাত্র হিন্দুরাজ্য বিধায় এখানে হিন্দু সাহিত্য সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে। সমাজে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা প্রধান ছিলেন। চন্দ্রদ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসী ছিল কৃষক-শ্রমিক। তারা চন্ডাল, জেলে ও তাঁতী সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। সমাজে দনুজমর্দন সৃষ্ট কৌলীন্যের প্রভাব থাকায় সংখ্যাগুরু কৃষক সমাজ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভবে নিপীড়ত হতো। সমাজের এই বৈষম্য শত শত বছর ধরে চলতে থাকে।

দনুজমর্দনের শাসন ও রাজ্যপ্রসার

চন্দ্রদ্বীপের প্রথম রাজধানী ছিল গোবিন্দপুর (বর্তমান বাকেরগঞ্জে?)। গোবিন্দপুরে কিছুদিন রাজকার্য পরিচালনা করে সোনারগাঁওয়ের সুলতানদের ভয়ে দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী সুগন্ধার শাখা নদী তেঁতুলিয়ার তীরে বর্তমান বাউফল থানার কচুয়াতে স্থানান্তরিত করেন। তিনি রাজধানীর নামকরন করেন বাঙ্গালা। বাঙ্গালা শহরকে স্থানীয় লোকেরা বাকলা বলত। বাকলা ও বাঙ্গালা অভিন্ন। বাকলা বাঙ্গালার পরিবর্তিত রূপ। নতুন রাজধানী বাঙ্গালাতে তিনি যথাশাস্ত্রমতে অভিষিক্ত হন। তিনি মন্দির নির্মাণ করে তার ইস্টদেবী কত্যায়নী ও ইস্টদেবতা মদন গোপালের মূতি স্থাপন করেন। খুব সম্ভব তিনি মূর্তি দুটো গোবিন্দপুরের নিকটবর্তী নদী থেকে উদ্ধার করেন। এ মূর্তি চন্দ্রদ্বীপ রাজবাড়ীতে শত শত বছর ধরে পূজিত হয়।

ঘটক কারিকাগণের বিবরণে দেখা যায় দনুজমর্দন রাজ্য মধ্যে দুর্গ তৈরি, অশ্বারোহী, হস্তী ও নৌ-সৈন্য বৃদ্ধি করে বাইরের আক্রমণ থেকে চন্দ্রদ্বীপকে রক্ষ করেন। গৌড়ের সুলতানদের চেয়ে তার নৌবাহিনী শক্তিশালী ছিল। রাজধানীর চারদিকে তিনি পরিখা খনন করেন। রাজধানী বাকলা শহরের সুরম্য দালান, মন্দির ও রাস্তা নির্মাণ করেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজধানী তেঁতুলিয়া নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বাঙ্গালা বা বাকলা শহর একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। দনুজমর্দন শুধু চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাঙ্গালা বন্দর নির্মাণ করেন। বাঙ্গালা একটি সামুদ্রিক বন্দর ছিল। এ বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকেরা বাণিজ্য করতে আসত।

দনুজমর্দন একজন বীরযোদ্ধা ছিলেন। তিনি রাজ্য সীমা সম্প্রসারণে প্রভূত সাফল্য অর্জন করেন। বর্তমান খুলনা জেলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভুলুয়া (নোয়াখালী), মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও কোটালীপাড়া দখল করে, চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যভুক্ত করেন। তার রাজ্য বিজয় সম্পর্কে সতীশচন্দ্র মিত্র বলেন যে, পাঠানদের আগমনের পূর্বে খুলনার অধিকাংশ চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যাধীন ছিল। দনুজমর্দন কত বছর রাজত্ব করেন তার কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু তার কার্যাবলী দেখে মনে হয় তিনি ১৩৩৯ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।


দনুজমর্দনের মুদ্রা

১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর সতীশ মিত্র খুলনা জেলার আশাশুনি থানার বাসুদেবপুর গ্রামে দু’টি মুদ্রা পান। বাসুদেবপুরে একজন মুসলমান কবর খনন করার সময় এ মুদ্রা পান। বাসুদেবপুরের জ্ঞানেন্দ্র বাবু মুদ্রা দু’টি সতীশ মিত্রকে দেন। মুদ্রার বিশেষত্ব হলো- এর বাংলা অক্ষর। বাংলা অক্ষরে প্রাচীন মুদ্রা ইতিপূর্বে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। মুদ্রাতত্ত্ববিদ বিখ্যাত ঐতিহাসিক রাখাল দাশ বন্দ্যোপাধ্যায় মুদ্রার অকৃত্রিমতা প্রামাণ করেছেন। মুদ্রা দুটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মুদ্রা বিভগে রক্ষিত আছে। মুদ্রা দুটিতে বাংলায় ‘শ্রী শ্রী দনুজমর্দন দেব, শ্রী চন্ডীচরণ-পারায়ণ, শকাব্দ ১৩৩৯, চন্দ্রদ্বীপ’ লেখা আছে। ১৩৩৯ শকাব্দ হলো ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দ। স্বাধীন রাজা না হলে কেহ মুদ্রা প্রচার করে না। প্রাপ্ত মুদ্রা হতে প্রমাণিত হয় যে, দনুজমর্দন দেব স্বাধীন রাজা ছিলেন। তবে মুদ্রাটি দনুজমর্দনকে চতুর্দশ শতক থেকে থেকে সরিয়ে পঞ্চদশ শতকে স্থাপন করে যা স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকালের পূর্ববর্তী মতগুলোকে সংকটাপন্ন করে তোলে।

দনুজমর্দনের মুদ্রা.jpg

দনুজমর্দনের উত্তরধিকারী রাজাগণ

১. রাজা রামনাথ দনুজমর্দন দেব, ২. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা রমাবল্লভ, ৩. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কৃষ্ণ বল্লভ, ৪. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা হরিবল্লভ, ৫. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা জয়দেব, ৬. তদীয় উত্তরাধিকারী রাণী কমলা-স্বামী বলভদ্র বসু, ৭. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা পরমানন্দ বসু, ৮. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা জগদানন্দ বসু (মৃত্যু ১৫৮৪ খ্রি.), ৯. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কন্দর্প নারায়ণ বসু (১৫৮৪ - ১৫৯৮খ্রি.), ১০. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা রামচন্দ্র বসু (১৫৯৮ খৃ:-১৬৬৮ খ্রি.), ১১. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কীর্তি নারায়ণ বসু- রাজা বাসুদেব নারায়ণ বসু (১৬৬৮-১৬৬৮ খ্রি.), ১২. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা প্রতাপ নারায়ণ বসু (১৬৮৮-১৭২৩ খ্রি.), ১৩. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা প্রেমনারায়ণ, বিমলা, স্বামী গৌরীচরণ মিত্র, ১৪. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা উদয়নারায়ণ মিত্র (১৭২৩-১৭৬৮ খ্রি.), ১৫. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা শিবনারায়ণ মিত্র, স্ত্রী রাণী দুর্গাবতী (১৭৬৯ - ১৭৭৭খ্রি.), ১৬. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা লক্ষ্মনারায়ণ, রাজা জযনারায়ণ- (১৭৭৮-১৮১৩খ্রি.), ১৭. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা নৃসিংহ নারায়ণ, ১৮. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা দেবেন্দ্র নারায়ণ (দত্তক), রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ (দত্তক), রাজা বীরসিংহ নারায়ণ (দত্তক), ১৯. তদীয় উত্তরাধিকারী উপেন্দ্র নারায়ণ, ভুপাল নারায়ণ (গোপাল রাজা), ২০. তদীয় উত্তরাধিকারী সতীন্দ্র নারায়ণ (মাখন রাজা)।

বাংলাদেশের মধ্যযুুগের ইতহাসে চন্দ্রদ্বীপের রাজা দনুজমর্দনের নাম চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। রাজা দনুজমর্দন দেব ছয় শ’ বছরের ইতহিসে একটি ছেদ টেনেছিলেন। তিনি একটি হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বাংলার হিন্দুদের ইতিহাসের দুর্যোগময় সময়ে তাদের সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ দীর্ঘদিন চন্দ্রদ্বীপ শাসন করে। একক কৃতিত্বের দিক দিয়ে সুলতানী আমলে তার সাথে খুব কম লোকের তুলনা করা যেতে পারে।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।