চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১১:৩১, ২২ মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে ("== আদি ইতিহাস == বর্তমান বরিশালের প্রাচীন নাম চন্দ্রদ্বীপ..." দিয়ে পাতা তৈরি)

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

আদি ইতিহাস

বর্তমান বরিশালের প্রাচীন নাম চন্দ্রদ্বীপ। এটি বাংলার আদি জনপদের একটি। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে টলেমি যে মানচিত্র তৈরি করেন তাতে চন্দ্রদ্বীপের স্থলভাগ দেখা যায়। তখন গঙ্গা নদীর শাখা সিওডোস্টমনের মোহনায় কতকগুলো দ্বীপের সমাহার ছিল চন্দ্রদ্বীপ। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রীক বিবরণে দেখা যায় গঙ্গার মোহনায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্র। মি. ওয়াটার্স ও ড. ওয়াইজের মতে, এ গঙ্গা নদীর মোহনায় কুমারতালক তথা কোটালীপাড়ায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল। উল্লেখ্য যে কোটালীপাড়া প্রাচীনকাল হতে চন্দ্রদ্বীপ বা বর্তমান বরিশালের অন্তর্গত ছিল। মেগাস্থিনিসের বিবরণে দেখা যায় গঙ্গার মোহনায় মোদকলিঙ্গ নামে একটি দ্বীপ ছিল এবং সেখানে মোলঙ্গীদের আবাস ছিল। গৌরনদী থানার মেদাকুল গ্রাম প্রাচীনকালের মোদকলিঙ্গ এর পরিবর্তিত নাম বলে অনুমিত হয়। তাহলে দেখা যায় আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে চন্দ্রদ্বীপ একটি জনপদ ছিল। সুতরাং চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস খুবই প্রাচীন এবং এর ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগে হয়েছে।


পৌরাণিক ইতিহাস

হিন্দু ধর্মের উপাখ্যানগুলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের বলে মনে হয়। মহাভারতের বয়স প্রায় ৩৫০০ বছর এবং তারও পূর্বে শিব ও কালী বা তারা দেবীর আবির্ভাব ঘটেছিল। চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন নদী সুগন্ধার সাথে কালী ও শিবের উপাখ্যানের সংযোগ আছে। কথিত আছে কালী বা তারা পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তনের পর তার পিতা স্বামী শিবকে নিন্দা করে। এ সংবাদে শিব বা মহাদেব শোকোন্মাদ হয়ে যায় এবং স্ত্রীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নৃত্য করতে থাকে। এ নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। এ দেখে মহাভাগ বিষ্ণুর চক্র দ্বারা তারার দেহ একান্ন খন্ডে বিভক্ত করে এবং সে খন্ডগুলো যে যে স্থানে পতিত হয়েছে সে স্থানগুলো তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। পাবনী, হলদিনী ও নলিনীর মিলিত মোহনায় তারা দেবীর নাসিকা পড়েছিল। সেজন্য ত্রিধারার মোহনার নাম সুগন্ধা হয়েছে। নাসিকা দিয়ে সুঘ্রাণ নেয়া হয়, তাই সুগন্ধা নাম। কালিকা পুরাণে সুগন্ধার উল্লেখ আছে- “সুগন্ধায়াং নাসিকা মেদেব স্ত্র্যম্বক ভৈরব।/ সুন্দরীসা মহাদেবী সুনন্দাতত্রৎ দেবতা”। এডুমিশ্র ও ভবিষ্যপুরাণে চন্দ্রদ্বীপের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেখা যায় চন্দ্রদ্বীপ পূর্বে জলমগ্ন ছিল। পরে মহাদেবের ললাটে অগ্নিতে জল শুকিয়ে দ্বীপের সৃষ্টি হয়। ললাট অগ্নির অর্থ ভূমিকম্প বলে মনে হয়। ভূমিকম্পের ফলে দ্বীপের সৃষ্টি হতে পারে এবং জল শুকিয়ে গাছপালা ও জলপথের সৃষ্টি হয়- “মেঘনাদ পূর্বভাগে পশ্চিমে চ বলেশ্বরী।/ ইন্দিলপুরী যক্ষ সীমা দক্ষিণে সুন্দর বনম্।।” [ভবিষ্য ব্রহ্মখন্ড] প্রাচীনকালে চন্দ্রদ্বীপ কয়েকবার উঠেছে আবার পড়েছে। এডুমিশ্রের কারিকায় উল্লেখ আছে যে, চন্দ্রকলার মতো এ দ্বীপের হ্রাসবৃদ্ধি হয়েছে বলে চন্দ্রদ্বীপ নামকরণ হয়েছে।- “চন্দ্রদ্বীপস্য সীমায়াং রতœাকারো বিরাজতে।/ চন্দ্রবৎ ক্ষীয়তে অস্য চন্দ্রবদ্বর্দ্ধতে বপুঃ।/ তস্য তদ্গুণযোগেন চন্দ্রদ্বীপ ইতিস্মৃতঃ।”


প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের সীমা

এডুমিশ্রের কারিকা ষোল শতকে রচিত। এ সকল পুরাণ গ্রন্থে চন্দ্রদ্বীপের সীমানা সম্পর্কে বর্ণনা আছে। “দিগি¦জয় প্রকাশ বিবৃতি” নামক গ্রন্থে লিখিত আছে- “পূর্বে ইছামতি সীমা পশ্চিমে চ মধুমতি/ বাদাভূমি দক্ষিণে চ কুশ দ্বীপোহিচোত্তরে”। এ গ্রন্থে আর এক স্থানে বর্ণিত আছে- “মেঘনা নদী পূর্বভাগে পশ্চিমে চ বলেশ্বরী/ ইন্দিলপুরি যক্ষ সীমা দক্ষিণে সুন্দরবনম্।/ ত্রিংশৎ যোজন বিমিতো সোমকান্তাদ্রি বর্জ্জিত।/ সোমকান্তে চ দ্বৌদেশৌ বিখ্যাতৌ নৃপ শেখর/ জম্বুবুদ্বীপ পশ্চিমে চ স্ত্রীকারোহি তথৌত্তরে,/ বাকলাখ্যো মধ্যভাগে রাজধানী সীমপতঃ।” মোগল যুগে দিগি¦জয় গ্রন্থে যে সীমার নির্দেশ আছে তাতে দেখা যায় চন্দ্রদ্বীপের পশ্চিমে মধুমতি ও বলেশ্বর নদী, পূর্বে নোয়াখালীর ইছামতি নদী, দক্ষিণে সুন্দরবন, উত্তরে ফরিদপুর জেলার কুশদ্বীপ বা বর্তমান কুশন্দিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রাচীনকাল হতে ইংরেজ আমল পর্যন্ত বাকলা চন্দ্রদ্বীপের রাজনৈতিক সীমা অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন গ্রন্থে উত্তরে শঙ্খকোট বা বর্তমান বিক্রমপুর পর্যন্ত সীমানা দেখা যায়। পূর্বে চন্দ্রদ্বীপের আয়তন বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল। বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরের যে পর্যন্ত বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা প্রচলিত সে অঞ্চল পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপ বিস্তৃত ছিল।


চন্দ্রদ্বীপের উদ্ভব

চন্দ্রদ্বীপের ভূগঠন সম্পর্কে শ্রী রোহিণী রায় চৌধুরী তার গ্রন্থে যে বর্ণনা দিয়েছেন তা নিম্নে উদ্ধৃত হলো : “আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে চন্দ্রদ্বীপের উল্লেখ দেখিতে পাই। প্রাচীন ভৌগোলিকগণ রাঢ় এবং বঙ্গ দেশকে দ্বাদশ ভাগে বিভক্ত করিয়া তাহাদের স্থিতি নির্ণয় করিয়াছেন; চন্দ্রদ্বীপ তন্মধ্যে অন্যতম। ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থ সমাজপতিগণ ইহাকে পাশ্চাত্য বৈদিকগণের প্রধান সমাজ স্থান এবং বহু সৎক্রিয়ান্বিত ব্রাহ্মণগণের বাসস্থান বলিয়া নির্দেশ করেন। ইহার অন্যতম নাম যে বাকলা তাহারও পরিচয় পাওয়া যায়। ইহার অন্তর্গত প্রদেশগুলি সমুদ্রতীরবর্তী; সময়ে সময়ে জলমগ্ন হইত, আবার উত্থিত হইত। মিশ্রী গ্রন্থে ইহার পরিচয় পাওয়া যায়; যথা:Ñ রতœাকরো মহাতীথদক্ষিণস্যাং দিশিস্থিতঃ।/ মুক্তবেণী মধ্যদেশে পদ্মাযস্যোত্তরা সদা।/ বলেশ্বর পূর্ব্বভাগে চন্দ্রদ্বীপ সমন্বিতঃ।/ দেশোহয়ং পুণ্যতীর্থস্তু ব্রাহ্মাণ্য ইতিকথ্যতে।” “ভবিষ্য পুরাণে চন্দ্রদ্বীপের উৎপত্তি সম্বন্ধে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই ভূখন্ড সর্বদা জলসিক্ত এবং আর্দ্র থাকিত; ভগবান ভবানীপতির ললাটস্থ অগ্নির উত্তাপে শুষ্ক হইয়া ত্বরায় প্রবীণ জনপদে পরিণত হওয়ায় শৈবদিগের আবাস নিকেতন হইল। অপিচ মহাদেবের ভালস্থিত শশীকলা ভূখন্ডকে অগ্ন্যুত্তাপ হইতে পুনরায় শীতল করিল।” বর্তমানে বাকেরগঞ্জের অধিকাংশ সুগন্ধা নদী হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, সেই নদীর অস্তিত্ব এখন নাই, তবে ঝালকাঠি থানার অন্তর্গত পঞ্চকরণের সম্মুখবর্তী ক্ষুদ্র খালকে অনেকে সুগন্ধা নদীর একটি বেনী বলিয়া উল্লেখ করেন। আবার কেহ কেহ কালীজিরা নদীর অংশবিশেষকেও সুগন্ধা বলিয়া নির্দেশ করেন। মিঃ রেনেলকৃত মানচিত্রেও সুগন্ধার উল্লেখ আছে। বর্তমান ঝালকাঠি নদী এবং কালীজিরার কোন কোন অংশকে তিনি সুগন্ধা নদী বলিয়াছেন; কিন্তু মানচিত্র দেখিলে বোধ হয় যে তৎকালে ঐ নদীর অনেক স্থান সস্কীর্ন হইয়া গিয়াছিল।


চন্দ্রদ্বীপের উৎপত্তি বিষয়ক কিংবদন্তী

চন্দ্রদ্বীপের উৎপত্তি সম্বন্ধে এদেশে দুইটি কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। মহাত্মা বিভারিজ্, ডাক্তার ওয়াইজ এবং বাবু ব্রজসুন্দর মিত্র প্রভৃতি ঐতিহাসিকগণ স্বীয় স্বীয় গ্রন্থ মধ্যে তাহা উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন।

কিংবদন্তী ১. যখন এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের প্রায় অধিকাংশস্থল সুগন্ধার গর্ভে বিলীন ছিল, তখন বিক্রমপুর পরগণায় চন্দ্রশেখর নামে একজন ধার্মিক, শুদ্ধাচার এবং তপানুশীল ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তাঁহাকে সুপাত্র দেখিয়া জনৈক ব্রাহ্মণ তাঁহার সহিত স্বীয় সর্বগুণসম্পন্না সর্বাঙ্গ সুন্দরী কন্যাকে বিবাহ দিলেন। সম্প্রদানের সময়ে চন্দ্রশেখর সভয়ে শুনিলেন যে তাঁহার নবোঢ়া পতœীর যে নাম, তাঁহার উপাস্যা দেবীরও সেই নাম; ব্রাহ্মণের মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হইল। যে উপাস্যাদেবীকে তিনি ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে শয়নে স্বপনে সর্বদা আরাধনা করিয়া থাকেন, আজ সেই উপাস্যদেবীকে চিন্তা করিলে স্ত্রীর নাম স্মৃতিপথে উদয় হইবে, যাহাকে মা বলিয়া ডাকিলে স্ত্রীর নাম মুখে আসিবে, আজ তিনি কেমন করিয়া সেই স্ত্রীসহবাসে মহাঘোর পাপপস্কে নিমগ্ন হইবেন? অকস্মাৎ ব্রাহ্মণের হৃদয়ে এই সকল চিন্তা উপস্থিত হইলে, তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন; তাঁহার হৃদয় দুরুদুরু করিতে লাগিল অনেক চিন্তা করিয়া স্থির করিলেন যে, নিশ্চয়ই তাঁহার পূর্বজন্মার্জিত মহাপাপে এই প্রকার সংঘটিত হইয়োছে। এখন প্রাণত্যাগ ব্যতীত কিছুতেই ইহার প্রায়শ্চিত্ত নাই। ব্রাহ্মণ আত্মহত্যা করিতে স্থির সংকল্প করিলেন।

ধীরে ধীরে বিবহকার্য সম্পন্ন হইল, স্ত্রী-আচার পর্যন্ত নির্বাহ হইয়া গেল; বর-কন্যা বাসরঘরে যাইবার পূর্বে চন্দ্রশেখর কৌশলে পলায়ন করিলেন। বরবেশেই সেই গভীর নিশীথ সময়ে ধার্মিক ব্রাহ্মণ একাকী স্বগৃহে আসিয়া, একখানি ক্ষুদ্র তরণী আরোহণপূর্বক একমাত্র ক্ষুদ্র ক্ষেপণি সহযোগে উত্তালতরঙ্গ সমাকুল সমুদ্রতুল্য নদীবক্ষে ভাসমান হইলেন। রাত্রি প্রভাত হইল; চতুর্দিকে অনন্ত জলরাশি, স্ফীতবক্ষে দিগ্দিগন্তপানে ছুটিয়া চলিয়াছে, কোথায়ও উদ্বেলিত তরঙ্গগুলি ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া সহিত মিশিতেছে, আবার কোথাও উচ্ছৃঙ্খল গতিতে পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত হইতেছে। এই ভীষণ তরঙ্গাভিঘাতের শ্রবণভীতিকর শব্দেও কিঞ্চিৎমাত্র ভীত না হইয়া, ব্রাহ্মণ ত্রকাকী সেই ক্ষুদ্র তরণী লইয়া স্রোতে ভাসিতে লাগিলেন। জনমানব দূরে থাকুক, এমনকি আকাশে কোন উড্ডীয়মান পক্ষী পর্যন্ত তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল না। এইরূপ দুইদিন গত হইল, তৃতীয় দিনে সূর্যোদয়ের পর ব্রাহ্মণ অনতিদূরে ক্ষুদ্র তরণী আরূঢ়া অসামান্য রূপবতী এক কিশোরীকে দেখিতে পাইলেন। এই সমুদ্রতুল্য ভীষণ নদীগর্ভে একাকিনী এই রমণীকে দেখিয়া চন্দ্রশেখর অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন এবং কৌতূহলী হইলেন। দেখিতে দেখিতে তাঁহান তরণী উক্ত রমণীর টিকটবর্তী হইল, চন্দ্রশেখর জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কোন্ সাহসে একাকিনী এই সমুদ্র মধ্যে আসিয়াছ? তোমার কি প্রাণের ভয় নাই?’ ব্রাহ্ম কথা শেষ হইলে কিশোরী বলিল ‘আমি ধীবরকন্যা, নদীতে বাস করাই আমার ব্যবসা; আমি ইহাতে কোন প্রকার ভীতা বা সস্কুচিতা হই নাই। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যান্বিতা হইলাম যে আপনি একাকী এই ভয়স্কর নদীতে আসিয়াছেন; আপনারও কি প্রাণের ভয় নাই?’

রমণীর এই কথা শুনিয়া চন্দ্রশেখর অত্যন্ত বিস্ময়বিষ্ট হইলেন। ক্ষণকাল চিন্তাপূর্বক তাঁহার মনোগত সকল কথা ব্যক্ত করিলেন। ধীবরকন্যা তাঁহার কথায় হাস্য করিয়া বলিল ‘ঠাকুর, দেখিতেছি আপনি ব্রাহ্মণ পন্ডিত, শাস্ত্রতন্ত্র প্রভৃতি অনেক অধ্যয়ন করিয়াছেন; এই সামান্য রহস্য ভেদ করিতে না পারিয়া আত্মহত্যারূপ মহাপাপে লিপ্ত হইতেছেন? আপনি কি জানেন না যে জগন্মাতা ভগবতী প্রত্যেক নারীদেহে অংশরূপে অধিষ্ঠিত। আপনার মাতা, পিতামহী, মাতামহী, স্ত্রী, কন্যা প্রভৃতি যাবতীয় নারীতেই তিনি সমভাবে বিরাজ করেন, ইহা কি বুঝিতে পারেন না? আবার যে প্রত্যেক পুরুষদেহে ভগবান মহাদেব অংশরূপে বিরাজিত, তাহাও কি ভুলিয়া গিয়ছেন? ইহাতে যদি পাপ হইতে তবে বিধাতা কিছুই সৃষ্টি করিতেন না। যান ঠাকুর! বাড়ি গিয়া স্ত্রীর সহিত স্বধর্ম পালন করুন। ধীবরকন্যার বাক্য শেষ হইলে ব্রাহ্মণের ভ্রমান্ধকার কাটিয়া গেল। অল্প বয়স্কা, অশিক্ষিতা, ধীবরকন্যার মুখ হইতে এইপ্রকার সারগর্ভ উপদেশ শ্রবণ করিয়া চন্দ্রশেখর অত্যন্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার দিব্যজ্ঞান উদয় হইল। তিনি ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া একলস্ফে ধীবরকন্যার নৌকায় গিয়া দুই হস্তে তাঁহার পদযুগল বেষ্টন করিয়া বলিলেন, ‘মা, তোমার কথায় আমার মোহ ঘুচিয়াছে। ধীবরকন্যার মুখ হইতে এই প্রকার সারগর্ভ কথা কিছুতেই বাহির হইতে পারে না, তুমি নিশ্চয়ই কোন দেবী, ছল করিয়া আমাকে ভুলাইতে আসিয়াছ; তোমার সত্য পরিচয় প্রদান করিয়াআমাকে কৃতার্থ কর।’ এই বলিয়া চন্দ্রশেখর তাঁহার চরণদ্বয়ের উপর স্বীয় মস্তক স্থাপনপূর্বক পুনঃ পুনঃ প্রণাম করিতে লাগিলেন।

ধীবরকন্যা ব্রাহ্মণের এবম্বিধ আচরণে ক্রুদ্ধা হইয়া বলিল ‘আমি অস্পৃশ্যা ধীবরকন্যা, আপনি ব্রাহ্মণ হইয়া কেন আমার অকল্যাণ করিতেছেন? শীঘ্র আমার পদদ্বয় পরিত্যাগ করুন।’ চন্দ্রশেখর কিছুতেই পদত্যাগ না করিয়া ভক্তিগদগদ কণ্ঠে বলিলেন, ‘মা, আমার বিশ্বাস হইতেছে তুমি নিশ্চয়ই দেবী; অভাগাকে ভুলাইতে আসিয়াছ। তোমার প্রকৃতি পরিচয় না পাইলে পদযুগল পরিত্যাগ করিব না। এখনই তোমার পায়ে মাথা রাখিয়া প্রাণত্যাগ করিব। তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ ঘটিবে।’ রমণী তথাপিও আত্মপরিচয় দিতে স্বীকৃত হইল না। এইপ্রকার অনেকক্ষণ গত হইলে যখন চন্দ্রশেখর দেখিলেন যে ইনি কিছুতেই আত্মপরিচয় দিবেন না, তখন আত্মত্যাগ করবার জন্য নদীতে ঝম্প প্রদান করিলেন। তখন সেই রমণী ‘বৎস চন্দ্রশেখর! আমি এতক্ষণ তোমার ভক্তি ও দৃঢ়তা পরীক্ষা করিতেছিলাম। তুমি যাঁহাকে দিবানিশি ভক্তিসহকারে আরাধনা করিয়া থাক, আমিই তোমার সেই উপাস্য দেবী। বৎস, আত্মহত্যা মহাপাপ, তুমি নৌকায় আরোহণ কর।’ চন্দ্রশেখর অতীব আহ্লাদের সহিত দেবীর আদেশ অনুসারে নৌকায় উঠিলেন ও ভক্তিভরে উপাস্যা দেবীর স্তব করিতে লাগিলেন। যাঁহাকে মনে মনে অহোরাত্রাবচ্ছিন্ন চিন্তা করিয়া থাকেন, যাঁহার শ্রীপদ পাইবার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ দিবানিশি আরাধনা করেন, ব্রাহ্মণ আজ সেই দেবদুর্লভ চরণ দর্শন পাইয়া পুনঃ পুনঃ সেই চরণে প্রণতিপূর্বক স্তব করিতে লাগিলেন। তাঁহার মন ভক্তিরসে ভিজিয়া উঠিল। দেবী স্তবে তুষ্টা হইয়া তাঁহাকে বর দিতে চাহিলেন। প্রণতি শিরোধরাংসা চন্দ্রশেখর ভক্তিগদগদকণ্ঠে বলিলেন, ‘মা, যাঁহার স্বরূপ হৃৎপদ্মে বিকশিত হইলে সর্ববিধ বাসনা পরিপূর্ণ হয়, আজ তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিয়া আমার সকল আশা পূর্ণ হইয়াছে। মাগো, কৃপা করিয়া এ দাসকে একবার স্বরূপে দেখা দাও।’

ভক্তবৎসলা দয়াময়ী তৎক্ষণাৎ স্বরূপ ধারণ করিয়া ভক্ত মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতঃ বলিলেন ‘বৎস, আজ যে স্থানে তুমি আমার দর্শন পাইলে আমার বরে অতি সত্বরই এই বিপুল জলরাশি সর্বশস্যময়ী মেদিনীতে পরিণত হইবে, এবং এই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে তুমিই রাজত্ব করিবে।’ চন্দ্রশেখর পুনঃ প্রণত হইয়া বলিলেন ‘মাতাঃ! যখন পূর্বপুণ্যফলে এ পবিত্র চরণ দর্শন পাইয়াছি তখন রাজ্যভোগে আর আমার স্পৃহা নাই কেবল এই বর দাও যেন বারংবার আর এই পাপময়ী পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া পুনঃ পুনঃ জন্ম মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করিতে না হয়। রাজ্যভোগে বিন্দু মাত্র স্পৃহা নাই, তবে এই কর মা যেন এই ভূখন্ড তোমার এই দীন সন্তানের নামে প্রসিদ্ধ হয়।’ দেবী ‘তথাস্তু’ বলিয়া অন্তর্হিতা হইলেন এবং চন্দ্রশেখরও হৃষ্টমনে দেশে প্রত্যাগমন করিলেন। দেবীর আশীর্বাদে অতি শীঘ্র সেই বিশাল জলরাশি অপসারিত হইল। সেই নবাবিষ্কৃত ভূমি চন্দ্রদ্বীপ বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিল।”

কিংবদন্তী ২. চন্দ্রশেখর চক্রবর্তী নামক একজন সুপ্রসিদ্ধ ব্রহ্মচারী কতিপয় শিষ্য সমভিব্যাহারে তীর্থ পর্যটনে বহির্গত হইয়াছিলেন। রামনাথ দনুজমর্দন দে নামে তাঁহার একজন প্রিয় শিষ্যও সঙ্গে ছিলেন। একদা এই সুগন্ধা বক্ষে সকলেই রাত্রিযোগে নৌকামধ্যে সুষুপ্ত আছেন, এমন সময়ে ব্রহ্মচারী স্বপ্নে দেখিলেন যেন জগদম্বা কালিকাদেবী, তাঁহার সম্মুখে আবির্ভূতা হইয়া বলিতেছেন যে, যেস্থানে চন্দ্রশেখরের নৌকা রহিয়াছে তাহার অনতিদূরে তিনটি পাষাণময়ী দেবমূর্তি জলনিমগ্ন অবস্থায় আছে; ব্রহ্মচারীর প্রিয় শিষ্য দনুজমর্দন কর্তৃক ঐ মূর্তিত্রয় উদ্ধৃত হইলে, এই বিশাল নদী সত্বরই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে পরিণত হইবে। স্বপ্নান্তে চন্দ্রশেখর জাগ্রত হইলেন, অবশিষ্ট রাত্রি আর নিদ্রা গেলেন না। রাত্রি প্রভাত হইলে, তিনি প্রিয় শিষ্য দনুজমর্দনকে গোপনে স্বপ্ন-বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করিয়া তদনুযায়ী কার্য করিতে আদেশ প্রদান করিলেন। দনুজমর্দন গুরুর আজ্ঞানুসারে স্বপ্নকথিত স্থানে ডুব দিলেন। প্রথমবার দেবী কাত্যায়নীর পাষাণময়ী মূর্তি উঠাইলেন। গুরুদেব পুনরায় ডুব দিতে আদেশ করায় শিষ্য তদনুসারে দ্বিতীয়বার মদনগোপালের পাষাণময়ী মূর্তি উঠাইলেন। গুরুদেব আবার ডুব দিতে বলিলেন, কিন্তু দনুজমর্দন আর ডুব দিতে সাহসী হইলেন না। চন্দ্রশেখর বলিলেন,- ‘ভগবতী কালিকার প্রসাদে এই বিশাল জলরাশি অতি সত্বর সর্বশস্যময়ী মেদিনীতে পরিণত হইবে এবং তাঁহার আদেশে তুমিই এই দেশের রাজা হইবে। তৃতীয়বার ডুব দিলে মহলক্ষ্মীর পাষাণময়ী মূর্তি পাওয়া যাইত, তুমি ডুব না দিয়া অতিশয় অবিমৃষ্যকারিতার কার্য করিয়াছ।’ এখানে বলা প্রয়োজন যে, রোহিনী রায় চৌধুরী দনুজমর্দন দেবকে ঘিরে যে উপাখ্যানের অবতারণা করেছেন তা ঐতিহাসিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। দনুজমর্দনের আবির্ভাবকাল চতুর্দশ শতকে। কিন্তু চন্দ্রদ্বীপ জনপদের উল্লেখ দশম, এগারো ও বারো শতকের তাম্র শাসনে দেখা যায়।”


চন্দ্রদ্বীপের অন্তর্গত বিভিন্ন স্থলের উৎপত্তি

চন্দ্রদ্বীপ বাকলা এক সময়ে পূর্ব সাগর বা লবণ সাগরে নিমজ্জিত ছিল। কোন এক অজানাকালে গঙ্গা নদীর পলি জমে জমে সুগন্ধা নদীর বুকে সৃষ্টি হলো একটি ত্রিকোনাকার ব-দ্বীপ। এ দ্বীপের নাম স্ত্রীকর দ্বীপ। স্ত্রীকর দ্বীপ বর্তমানে শিকারপুর নামে পরিচিত। স্ত্রীকর দ্বীপ শিকারপুর থেকে গোপালগঞ্জ মহকুমার কোটালীপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শ্রীকরের এক অংমের নাম মোদকলিঙ্গ বা মেদাকুল ছিল। গুপ্ত আমলে এ দ্বীপের প্রশাসনিক নাম ছিল নাব্যাবকাশিক বা মধ্যবর্তী নতুন ভূমি। সেন আমলেও এ অঞ্চলকে নাব্যমন্ডল বলা হয়েছে। তাহলে দেখা যায় ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতকে এ অঞ্চলের ভূমি নাব্য বলে অভিহিত ছিল। তেরো শতকে বা প্রায় সাত শ’ বছর পর এ ভূমি নাব্যই রয়ে গেল। মূলত এ অঞ্চলের ভূমি অনেক পুরনো কিন্তু ভাঙ্গাগড়া চলেছে সর্বযুগে। আজও চন্দ্রদ্বীপ বা বর্তমান বাকেরগঞ্জ পটুয়াখালীর দক্ষিণে নতুন নতুন স্থলভাগ সৃষ্টি হচ্ছে। মিঃ এফসি হারসটের মতে, বাকেরগঞ্জের দক্ষিণভাগ এক সময় স্থলভাগ ছিল এবং পরে নিমজ্জিত হয়ে যায়। সুগন্ধার বুকে চর পড়ে বর্তমান স্থলভাগ সৃষ্টি হয়েছে। স্ত্রীকর দ্বীপ বা বর্তমান উজিরপুর, গৌরনদী থানা এ জেলার প্রাচীনতম স্থলভাগ। স্ত্রীকর দ্বীপের পরেই সুগন্ধা নদীর পূর্বাংশে শঙ্খকোটি দ্বীপ সৃষ্টি হয়। এ দ্বীপ দেখতে শঙ্খ বা শামুকের মতো ছিল। শঙ্খদ্বীপ হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, মুলাদি হতে বিক্রমপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইদিলপুর পরগণা এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

শঙ্খকোট দ্বীপের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে নলিনী প্রবাহিত হয়ে পূর্ব সাগরে পতিত হয়। মেঘনা নদী তখন খুব ছোট ছিল। সুগন্ধাই তখন দক্ষিণ অঞ্চলের বৃহত্তম নদী। স্ত্রীকর ও শঙ্খকোট দ্বীপ সৃষ্টির পরে দক্ষিণ-পূর্বে আর একটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। নলছিটি, বাকেরগঞ্জ, বাউফল, মির্জাগঞ্জ, বোরহানউদ্দিন, বেতাগী প্রভৃতি এই দ্বীপের স্থলভাগ। এই দ্বীপের পশ্চিম পাশে বর্তমান ঝালকাঠী, রাজাপুর, কাউখালী, ভান্ডাারিয়া নিয়ে আর একটি দ্বীপ সৃষ্টি হয়। পাবনী ও হলদিনীর প্রবাহিত পলল দ্বারা পিরোজপুর, নাজিরপুর, স্বরূপকাঠী, বানারীপাড়া সৃষ্টি হয়েছে। বাগেরহাটের কচুয়া, মোরেলগঞ্জ এ ভূখন্ডের অধীন ছিল। সুগন্ধার পশ্চিম তীরে এ দ্বীপের ভূ-গঠন অন্যান্য দ্বীপের তুলনায় নতুন। মৌর্য আমলে সুগন্ধার মোহনায় কাঁঠালিয়া, গলাচিপা, আমতলী এবং গুপ্ত আমলে বরগুনা, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা নিয়ে কয়েকটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। স্ত্রীকর, শঙ্খকোট, পিরোজপুর প্রভৃতি দ্বীপ প্রাগৈতিহাসিক যুগে সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দ্বীপগুলো যেভাবে একই ভূখন্ডে দেখা যায়, প্রাচীনকালে তেমন ছিল না। তখন অসংখ্য শাখা নদী এ দ্বীপগুলোকে জালের মতো ঘিরে ছিল। আস্তে আস্তে শাখা নদীগুলো ভরে এক দ্বীপের সাথে আর এক দ্বীপের স্থলভাগ মিশে গেছে। এ দ্বীপগুলোর মিলিত নাম ছিল বাঙ্গালা। পাল ও সেন আমলে এ দ্বীপগুলো বাঙ্গালা ও চন্দ্রদ্বীপের নামে পরিচিত ছিল। এ আমলে এর প্রশাসনিক নাম দেয়া হয় নাব্য বা বাগড়ী মন্ডল।


ভূ-গঠন

বরিশাল বিভাগের দক্ষিণ অঞ্চলের। ভূ-গঠন উত্তর ও মধ্য বরিশালের চেয়ে নতুন। কাঁঠালিয়া, আমতলী, গলাচিপা, দৌলতখাঁ, তজুমদ্দিন প্রভৃতি থানার ভূ-গঠন মৌর্য ও গুপ্ত যুগে হয়েছে বলে মনে হয়। তবে এসব থানার অনেক জায়গার ভূ-গঠন অনেক পরবর্তীকালেও হয়েছে। পাথরঘাটা, বরগুনা, খেপুপাড়া, চর কুকরিমুকরি ও মনপুরার ভূ-গঠন সুলতানী যুগে হয়েছে। লালমোহন, চরফ্যাশন এবং গলাচিপা, খেপুপাড়া, আমতলী ও পাথরঘাটার দক্ষিণাংশের ভূ-গঠন ইংরেজ আমলে (১৮ ও ১৯ শতকে) হয়েছে। ভোলা বা দক্ষিণ শাহবাজপুরের ভূ-গঠন স্বতন্ত্র। বরিশালে বিভিন্ন অঞ্চলে খাল, ডোবা ও নদী দেখা যায়। ভোলা মহকুমায় সে রকম খাল বা নদী নেই। একত্রে গঠিত এ ভূখন্ড সুগন্ধার পূর্ব পারের দ্বীপ প্রাচীন নলিনী, মেঘনা ও পাবনীর পলল দ্বারা গঠিত। দ্বীপের আকৃতি প্রাচীনকালে ছোট ছিল। বোরহানউদ্দিন বর্তমান ভোলা জেলার প্রাচীনতম স্থলভাগ। বাউফল থানার সংলগ্ন তেঁতুলিয়া নদী সেন আমলে ছোট ছিল। সুগন্ধার শাখা নদী বেতুয়া প্রমত্ত নদী ছিল। বেতুয়া নদীর পূর্ব পাড়ে দৌলতখাঁ, তজুমদ্দিন এবং পশ্চিম পাড়ে বোরহানউদ্দিন ও ভোলা ছিল। বেতুয়া নদী বর্তমানে ছোট খালে পরিণত হয়েছে। প্রাচীনকালে চন্দ্রদ্বীপ শতাধিক দ্বীপের সমাহার ছিল। এ দ্বীপের মৃত্তিকায় সুগন্ধা নদী তার নিজের অস্তিত্ব প্রায় হারিয়ে ফেলে বিভিন্ন শাখা নদীতে বিভক্ত হয়ে সাগরে পতিত হয়। বর্তমানে সুগন্ধার নাম প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ঝালকাঠী, কালীজিরা, বানারীপাড়া ও শিকারপুরের নদী সুগন্ধা নামে পরিচিত। আর কোথাও সুগন্ধা নদীর অস্তিত্ব নেই। সুগন্ধা যে একদিন প্রলয়ঙ্করী নদী ছিল তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। অথচ সুগন্ধার ইতিহাস আর প্রাচীন চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস অভিন্ন। সুগন্ধাই চন্দ্রদ্বীপকে সৃষ্টি করেছে। সুগন্ধার তীরে প্রাচীন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। সেই সুগন্ধার নাম আজ প্রায় বিস্মৃত।


চন্দ্রদ্বীপের রাজনৈতিক ইতিহাস

দশম শতকে চন্দ্র রাজবংশ চন্দ্রদ্বীপকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। ১২০৩ খ্রিঃ বখতিয়ার খলজীর গৌড় দখলের পর লক্ষ্মণ সেন পূর্ববঙ্গে চলে যান। এ সময় নদীয়া থেকে সেন রাজকুমার তরুণ সেন, অরুণ সেন, গোকুল সেন, বিজয় সেন, যব সেন প্রমুখ রাজকুমার চন্দ্রদ্বীপে আশ্রয় নেন। রাজকুমার ও তাদের বংশধর দু’শ বছর চন্দ্রদ্বীপ শাসন করেন। গৈলা-ফুল্লাশ্রী গ্রামে সেন রাজকুমারদের নামে ৭টি দীঘি আছে। অশোক, যব, অরুন ও কালু সেনের নামে গ্রাম ছিল। সেন রাজকুমাররা চন্দ্রদ্বীপ বা বাঙ্গালার অধিপতি ছিলেন। তাই চন্দ্রদ্বীপের উত্তর ভাগের নাম ছিল বাঙরোড়া। সেন রাজবংশের শেষ আশ্রয়স্থল ছিল চন্দ্রদ্বীপ। গৈলার অনতিদূরে কটকস্থল গ্রাম আছে। প্রবাদ আছে সেন রাজকুমাররা কটকস্থলে সেনানিবাস নির্মাণ করেছিলেন। তারা চন্দ্রদ্বীপের ওপর মুসলমানদের অভিযান প্রতিরোধ করে স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখেন। লক্ষ্মণ সেনের পুত্র বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন ১২০৬ খ্রিঃ হতে ১২২৫ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। গৌড় হারিয়ে তারা বিক্রমপুরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বিক্রমপুরে রাজধানী নিরাপদ ছিল না। তাই মুসলমানদের ভয়ে তারা রাজধানী মাঝে মাঝে চন্দ্রদ্বীপে স্থানান্তরিত করতেন। একবার কেশব সেন লক্ষ্ণৌর সুলতানের ভয়ে চন্দ্রদ্বীপে পালিয়ে ছিলেন। কেশব সেনের একখানা তাম্রশাসন চন্দ্রদ্বীপে উত্তর-পূর্বভাগে অবস্থিত ইদিলপুর বা উত্তর শাহবাজপুরে পাওয়া যায়। ইদিলপুর তাম্র শাসনে মেহেন্দিগঞ্জ থানার লতা ও ঘোড়াঘাট গ্রামের উল্লেখ আছে। ইদিলপুর তাম্র শাসন, মদনপাড়ার বিশ্বরূপ সেনের তাম্র শাসন এবং চন্দ্রদ্বীপে প্রাপ্ত পাল ও সেন আমলের দেব-দেবীর মূর্তি প্রমাণ করে যে, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে সেন রাজবংশের কয়েকজন রাজা চন্দ্রদ্বীপ শাসন করেন। চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে চন্দ্রদ্বীপ বিপর্যস্ত হয় এবং অনেক জনপদ বিলীন হয়ে যায়। পুনরায় জনবসতি গড়ে ওঠে এবং অনেক শ্রোত্রিয় সপ্তসতী ব্রাহ্মণ, মৌলিক ও বঙ্গজ কায়স্থ এবং বৈদ্যগণ চন্দ্রদ্বীপের গৈলা, ফুল্লশ্রী, রামসিদ্দি, বাটাজোড়, মাহিলারা, লক্ষ্মণকাঠী, শিকারপুর, গোবিন্দপুর, লতা প্রভৃতি গ্রামে বসতি স্থাপন করে। এই নতুন বসতিতে চতুর্দশ শতকের শেষ বা পঞ্চদশ শতকের শুরুতে দনুজমর্দন দেব চন্দ্রদ্বীপে পুনরায় এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সমগ্র বাংলাদেশ যখন মুসলমানদের অধীনে তখন দনুজমর্দন দেব বঙ্গোপসাগরের উপকূলে সুগন্ধা নদী ও সুন্দরবনবেষ্টিত এই স্বাধীন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেন। অনেক ইতিহাসবেত্তা দনুজমর্দন দেবকে লক্ষ্মণ সেনের বংশধর বলে আখ্যায়িত করেছেন। দনুজমর্দন দেব ও লক্ষ্মণ সেনের বংশধররা প্রায় দু’শ বছর স্বাধীনভাবে এবং দু’শ বছর সামন্ত রাজা হিসেবে চন্দ্রদ্বীপ শাসন করেন। দনুজমর্দন দেবের বংশের ইতিহাস এবং চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস প্রায় অভিন্ন। তাদের রাজত্বকালে চন্দ্রদ্বীপে এক উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।


চন্দ্রদ্বীপের রাজাগণ

১. রাজা রামনাথ দনুজমর্দন দেব, ২. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা রমাবল্লভ, ৩. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কৃষ্ণ বল্লভ, ৪. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা হরিবল্লভ, ৫. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা জয়দেব, ৬. তদীয় উত্তরাধিকারী রাণী কমলা-স্বামী বলভদ্র বসু, ৭. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা পরমানন্দ বসু, ৮. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা জগদানন্দ বসু (মৃত্যু ১৫৮৪ খ্রি.), ৯. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কন্দর্প নারায়ণ বসু (১৫৮৪ - ১৫৯৮খ্রি.), ১০. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা রামচন্দ্র বসু (১৫৯৮ খৃ:-১৬৬৮ খ্রি.), ১১. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা কীর্তি নারায়ণ বসু- রাজা বাসুদেব নারায়ণ বসু (১৬৬৮-১৬৬৮ খ্রি.), ১২. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা প্রতাপ নারায়ণ বসু (১৬৮৮-১৭২৩ খ্রি.), ১৩. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা প্রেমনারায়ণ, বিমলা, স্বামী গৌরীচরণ মিত্র, ১৪. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা উদয়নারায়ণ মিত্র (১৭২৩-১৭৬৮ খ্রি.), ১৫. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা শিবনারায়ণ মিত্র, স্ত্রী রাণী দুর্গাবতী (১৭৬৯ - ১৭৭৭খ্রি.), ১৬. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা লক্ষ্মনারায়ণ, রাজা জযনারায়ণ- (১৭৭৮-১৮১৩খ্রি.), ১৭. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা নৃসিংহ নারায়ণ, ১৮. তদীয় উত্তরাধিকারী রাজা দেবেন্দ্র নারায়ণ (দত্তক), রাজা নরেন্দ্র নারায়ণ (দত্তক), রাজা বীরসিংহ নারায়ণ (দত্তক), ১৯. তদীয় উত্তরাধিকারী উপেন্দ্র নারায়ণ, ভুপাল নারায়ণ (গোপাল রাজা), ২০. তদীয় উত্তরাধিকারী সতীন্দ্র নারায়ণ (মাখন রাজা)।


চন্দ্রদ্বীপের শেষ অধ্যায়

মুগল-পূর্ব যুগের ক্ষুদ্র রাজ্য চন্দ্রদ্বীপ মুগল যুগের শেষ দিকে সুবে বাংলার একটি বড় জমিদারিতে রূপান্তরিত হয়। মধ্যযুগের শেষ দিকে বাখরগঞ্জ জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ব্যাপী চন্দ্রদ্বীপ জমিদারি বিস্তৃত ছিল। পূর্ব বাংলার যে সকল জমিদার কিছু কালের জন্য মুগল প্রভুত্ব স্থাপনে প্রতিরোধ রচনা করেন, সে বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে পরমানন্দের পৌত্র কন্দর্পনারায়ণ রায় সবিশেষ প্রসিদ্ধ। কন্দর্পনারায়ণ চন্দ্রদ্বীপের সীমানা সম্ভবত পশ্চিমে যশোহর এবং উত্তরে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। বহিরাক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার জন্য তিনি রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে সমুদ্রোপকূলে এক সুদৃঢ় দুর্গ নির্মাণ করেন। কন্দর্পনারায়ণ রায় বরিশালের পশ্চিম-উত্তর কোণে ক্ষুদ্রকাঠিতে একটি দিঘি খনন করেন।

কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র যশোহরের প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিন্দুমতীকে বিবাহ করেন। অবশ্য এ ঘটনার মাধ্যমে যশোহর ও চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল বলে মনে হয়। রামচন্দ্র ১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দে হোসেনপুরে তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যকে তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেন।

রামচন্দ্র রায়ের পুত্র ও উত্তরাধিকারী কীর্তিনারায়ণ রায়ও পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন এবং সাফল্য লাভ করেন। তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই প্রতাপনারায়ণ রায় চন্দ্রদ্বীপের পরবর্তী নৃপতি হন। প্রতাপনারায়ণ রায়ের সময় বা তার স্বল্প পরে মুসলমানগণ বাকলা চন্দ্রদ্বীপ দখল করেন এবং চন্দদ্বীপ তখন সুবে বাংলার একটি জমিদারিতে পণত হয়।

কালক্রমে চন্দ্রদ্বীপের বসু বংশের বিলোপ ঘটলে ঢাকার নিকটবর্তী উলাইলের মিত্র মজুমদার বংশ চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি লাভ করেন। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পরপরই চন্দ্রদ্বীপ জমিদারির অধিকাংশ ক্রমে নিলামে বিক্রি হয়। যারা সেই জমিদারি ক্রয় করেন তাদের মধ্যে চন্দদ্বীপ রাজাদের মুদি দোকানের মালিক রামু মানিক অন্যতম ছিলেন।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০। ২। বাংলাপিডিয়া।