আজিজুল হক শাজাহান

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:৪০, ৯ জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

পূর্ণনাম: এস এম আজিজুল হক শাজাহান। ওরফে শাজাহান। লেখক, রাজনীতিক ও শেরে বাংলার সহকারী একান্ত সচিব। পৈতৃক নিবাস ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানাধীন গালুয়া গ্রাম। জন্ম: ১৯৩৩। পিতা: সৈয়দ আব্দুল মালেক। মাতা: বেগম হামিদুন্নেসা। পিতামহ: সৈয়দ আব্দুল হক ওরফে লাল মিয়া। ভাইবোন: আজিজুল হক শাজাহান, সুরাইয়া বেগম, মেরী বেগম ও শাহানা হক পরী।


শৈশব ও রাজনীতি

জনাব আজিজুল হক শাজাহানের পিতা জনাব সৈয়দ আব্দুল মালেক স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। উল্লেখ্য যে ১৯০৫ সালে মুসলমানদের দাবীতে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রিক একটি স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল গঠিত হলে বাংলা মায়ের এই বিভাজনের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি হয় তার নাম বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন বা অন্য নামে স্বদেশী আন্দোলন। অশ্বিনী কুমার দত্ত বরিশালে এ আন্দোলনের প্রধান পুরুষ ছিলেন। এই আন্দোলনের সাথে জনাব শাজাহানের পিতার সংযুক্তি প্রমাণ করে যে তাদের পরিবার দীর্ঘকাল ধরেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। জনাব শাজাহান বলেছেন যে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দল সমন্বিত বরিশাল পার্টির সাথেও জনাব আব্দুল মালেক যুক্ত ছিলেন। জনাব শাজাহান উল্লেখ করেছেন যে ১৯১৫ সালে বরিশাল দল থেকে নদীয়ায় অস্ত্র সংগ্রহ অপারেশনে ধরা-পড়া অন্যতম নেতা সতীন সেনের সাথে তার পিতা জনাব আব্দুল মালেকের ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রসঙ্গত তিনি আরো বলেন যে পরবর্তীতে তার বাবা মুর্শিদাবাদে নওয়াব এস্টেটে চাকুরি নিয়ে সাংসারিক জীবন যাপন করেন।

জনাব শাজাহানের জন্ম মাতুলালয়ে ফরিদপুরে। পীর দুদু মিয়ার পরিবারের সাথে তার মামার পরিবার আত্মীয়তায় সম্পর্কিত বলে জনাব শাজাহান উল্লেখ করেছেন। বাবার সাথে ছেলেবেলায় মুর্শিদাবাদে ছিলেন। কিশোর বয়সেই অনুশীলন সমিতিতে সম্পৃক্ত হন। ফলে প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ হয় নি। জেলে বসে একবার ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তবে কৃতকার্য হন নি। ফলে তিনি স্বশিক্ষিত হিসেবেই নিজেকে পরিচিত করেন। এম এন রায় পার্টি বিলোপ করে পার্টিহীন রাজনীতিতে প্রবেশ করলে জনাব শাজাহান এবং এমন অনেকে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগ দেন বলে জনাব শাজাহান উল্লেখ করেছেন। ১৯৮৬ সালে তিনি শেরে বাংলার সহকারী একান্ত সচিব নিযুক্ত হন। শেরে বাংলার মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।

সশস্ত্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ

‘বরিশাল দর্পন’ নামক গ্রন্থে লিখিত হয়েছে যে বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তি (মহারাজ)-এর নেতৃত্বে গঠিত অনুশীলন পার্টির বরিশালের সংগঠনের নাম ছিল ‘বান্ধব পার্টি’। এর পরিচালনার দায়িত্ব ছিলো বিপ্লবী দেবেন ঘোষের ওপর। কৈশোরের কোন এক শুভ প্রভাতে জনাব হক শ্রী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষের কাছে, শহীদ আফতাব মাহমুদের মামা মরহুম মোহম্মদ আলী খানের কাউনিয়ার বাড়ীর কাছে, ‘জোড়া মসজিদের’ সামনে দাঁড়িয়ে শপথ বাক্য ‘মন্ত্রগুপ্তি’ পাঠের মাধ্যমে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তখন থেকেই তিনি কিশোর সদস্য হিসেবে বিপ্লবীদের ভেতরে চিঠি পত্রের আদান প্রদান এবং গভীর রাতে সভাভংগ হলে মহিলা সদস্যাদের বাড়ী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করতেন। পরবর্তিকালে আন্তর্জাতিক চিন্তাবিদ কমরেড এম,এন রায়ের রচনাবলী দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে শ্রী অনিল সেনের নেতৃত্বে বরিশালেরর ‘র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি’তে যোগদান করেন। এম. এন. রায় তাঁর দলের বিলুপ্তি ঘটালে জনাব হক অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়া ‘নিখিল বঙ্গ কৃষক প্রজাপর্টিতে’ যোগদান করেন এবং শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৮ সনে ভাষা আন্দোলনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৫০ সালে বরিশালে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে পুনরায় কারাবরণ করেন। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং কারাবরণ করেন।

পাকিস্তান বিরোধী রাজনীতি

উক্ত গ্রন্থে আরো লিখিত হয়েছে যে ১৯৫৪ সালে সীমান্ত প্রদেশের লীগ নেতা ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান আব্দুল কাইউম খান ও পূর্ব-বাংলার মুখ্য মন্ত্রী জনাব নুরুল আমিনের বরিশাল সফর উপলক্ষে বিরোধীদলসমূহের প্রতিরোধে অংশগ্রহণ কালে স্টীমার ঘাটে ও সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গনে পুলিশের বেপরোয়া প্রহারে জনাব হকের বাম হাত ভেঙ্গে যায়। তাকে সেই অবস্থায় গ্রেপ্তার করে জেল হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এ খবর তৎকালীন প্রায় প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় ছবিসহ প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে শেরে বাংলা তাঁকে বরিশাল জেল হাসপাতালে দেখতে যান। ১৯৭১ সালে ৪ঠা মার্চ মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী কর্তৃক ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ ঘোষণার ৪ দলের অন্যতম দল কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি উক্ত ঘোষণার একজন অন্যতম অংশীদার ছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় তিনি মুজিবনগরে কোলকাতা মীরার রোডের বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম সহায়ক কমিটির অন্যতম কর্মকর্তা হিসেবে ভারতের আগরতলা, লামডিং, কামরূপ, দিল্লী, আগ্রা, এলাহাবাদ, বৃন্দাবন, মথুরা, গয়া, কাশী, বেনারশী, ফতেপুর সিক্রী, সেকেন্দ্রা, আলীগড়, কেরালা ও কাশ্মীর প্রভৃতি স্থানে স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং মুজিব নগরে পিন্স অব স্ট্রীটে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় দফতরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

‘বরিশাল দর্পন’ গ্রন্থ এই তথ্য প্রদান করে যে যে জনাব হক স্বাধীনতার পরে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর অনশনের সময় তাঁর দাবীর সাথে একাত্মত্তা ঘোষণা করেন এবং মাওলনার মৃত্যুর পরে রেসকোর্স ময়দানের শোক সভায় অন্যতম শরীক দলনেতা হিসাবে বক্তব্য রাখেন। বর্ষীয়ান নেতা জনাব আতাউর রহমান খানকে আহবায়ক করে ২২ দলের সমন্বয়ে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় তাতে জনাব আজিজুল হক শাহজাহান কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অন্যতম নেতা ছিলেন। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্ত্রের মুখে অপসারণ করে অবৈধ সেনাশাসন জারীর পরে জনাব হক তার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে অবৈধ সেনা সরকার কর্তৃক ঘোষিত অসাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন বয়কট করার ডাকে বক্তৃতারত অবস্থায় ব্যয়তুল মোকাররমের এক জনসভা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন এবং নির্বাচন পর্ব শেষ হলে মুক্তি লাভ করেন।

লেখক জীবন

বরিশাল দর্পণ গ্রন্থের তথ্য মোতাবেক জনাব শাজাহান এক সময় কোলকাতার ‘দৈনিক লোক সেবক’ ও ‘দৈনিক ইনসাফ’ ‘দৈনিক মিল্লাত’ ও ‘দৈনিক আজাদ’ এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন। ‘কষিাণ মজদুর’ নামে একটি সাপ্তাহকি পত্রকিা তিনি অনয়িমতিভাবে প্রকাশ করতেন। এ ছাড়া তিনি দেশের বিভিন্ন ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিভিন্ন সময় ধারাবাহিক ভাবে রাজনৈতিক প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং এখনও করছেন। এ দেশের কৃষক আন্দোলন ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠাব্যাপী তিনি ‘শতাব্দীর কণ্ঠস্বর’ নামক একখানা তথ্যপূর্ণ প্রামাণ্য পুস্তক রচনা করেন। এছাড়াও তিনি অনেক গ্রন্থের লেখক যেমন: ‘ইতিহাসে বাঙ্গালী’, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাঙ্গালী’, ‘কালস্রোত’, ‘ইতিহাসের শিলালিপি’, ‘পিতামহদের চরণরেখা’, ছবির হাজার পাতা ইত্যাদি।

পারিবারিক জীবন ও মৃত্যু

জনাব শাজাহান ১৯৬০ সালে বিবাহ করেন। স্ত্রীর নাম খোরশেদা হক কিরণ। স্ত্রী কমার্স ব্যাংক বাংলাদেশ এর মৌচাক শাখার ম্যানেজার। তাদের সন্তানগণ: সৈয়দা মোনালিসা হক, সৈয়দা জোসেফাইন হক, সৈয়দা সুমনা হক ও সৈয়দ ফজলুল হক। এস এম আজজিুল হক শাজাহানের জীবনাবসান হয়ছেে গত ১৫ নভম্বের ২০১৪, ঢাকায় নিজগৃহ অমরাবতীতে।


তথ্যসূত্র: মুহম্মদ মুহসিন। চরিতভিধান: রাজাপুরের গুণী ও বিশিষ্টজন। নালন্দালোক, ২০১০।