হুমায়ূন কবির

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:২৬, ৩০ মার্চ ২০১৬ পর্যন্ত সংস্করণে ("হুমায়ূন কবির। রাজাপুরের মাটিতে এযাবৎকালে জন্ম নেয়া কব..." দিয়ে পাতা তৈরি)

হুমায়ূন কবির। রাজাপুরের মাটিতে এযাবৎকালে জন্ম নেয়া কবি ও সাহিত্যিকগণের মাঝে সর্বোচ্চ আসনে আসীন কবি এবং রাজাপুর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যাপক। খ্যাতিমান কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার ভাষায়- ষাটের দশকের মাঝামাঝি যে ক’জন অমিত-সম্ভাবনাময় প্রতিবাদী তরুণের দর্পিত পদপাতে বাংলা সাহিত্য উচ্চকিত হয়েছিলো, হুমায়ূন কবির তাঁদের অন্যতম। গ্রাম: সাকরাইল। জন্ম: ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮। পিতা: হাবিবুর রহমান হাওলাদার। মাতা: জাহানারা বেগম। পিতামহ: আব্দুল গনি হাওলাদার। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হুমায়ূন কবির ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান। জনাব হুমায়ূন কবিরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বরিশাল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। ১৯৬৩ সালে এই বিদ্যালয় থেকেই তিনি দ্বিতীয় বিভাগে এস.এস.সি পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে ব্রজমোহন মহাবিদ্যালয় থেকে তিনি এইচ.এস.সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এবারো তিনি দ্বিতীয় বিভাগ পেলেন। হুমায়ূনের জীবনে ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের প্রভাব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এই ব্রজমোহন শিক্ষানিকেতন অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিকেই হাতে খড়ি দিয়েছে। এঁদের মধ্যে আচার্য জগদীশ চন্দ্র, অশ্বিনী দত্ত ও জীবনানন্দ দাশের নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। কলেজ জীবন শেষ করে জনাব হুমায়ূন ১৯৬৫ সালে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি ঢাকার বিভিন্ন সাহিত্য আন্দোলন, বিশেষতঃ ‘স্বাক্ষর’ ও ‘কণ্ঠস্বর’ গোষ্ঠির সঙ্গে জড়িত হন। তিনি দু’হাতে কবিতা লিখতে থাকেন। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার বর্ণনামতে জনাব হুমায়ুন এসময়ে দিনে ৭/৮ খানা কবিতাও রচনা করেছেন। ঢাকার বিভিন্ন দৈনিকের রবিবাসরীয় সাহিত্যের পাতায় প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। তিনি নিজেও এ সময়ে ‘নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ’ নামে একটি অনিয়মিত কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন। ছন্দের উপর সহজাত দখল ও নিসর্গপ্রীতি তাঁর এ সময়কার কবিতার প্রধান অবলম্বন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘পার্শ্ববতিনী সহপাঠিনীকে’ এ সময় রচিত হয়। নাটকীয় স্বগতোক্তির ঢঙে রচিত এ কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় প্রেম। হুমায়ুনের কবিতায় শেষাবধি প্রেম ও প্রকৃতির প্রাধান্য খুব একটা ক্ষুণœ হয়নি। ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা সাহিত্যে অনার্স পাশ করেন। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরবর্তী বছর, ১৯৬৯ সালে, তিনি হুবহু একই ফলাফলসহ বাংলায় এম.এ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তিনি সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি প্রগতিশীল ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। এ কারণে এ সময়ে তাঁর রচনায় রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করে। ষাটের দশকের নব্য-কবিসমাজের প্রধানাংশের মানসিকতা ছিল অবক্ষয়ের বৃত্তে আবর্তিত। হুমায়ুন সর্বপ্রকার অবক্ষয়ের বিরোধী ছিলেন। কবিতা রচনার পাশাপাশি সক্ষম হাতে প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখে তিনি এই মানসিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। এ সময়ে লিখিত তাঁর ‘মেরুদণ্ড ও কবিতা’ শীর্ষক নিবন্ধটি তরুণ কবি মহলে বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নিজে একজন প্রেমিক কবি হওয়া সত্বেও তিনি সমকালীন কাব্যচর্চায় আবেগের বাড়াবাড়ি তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তাই তিনি ‘নষ্ট বিশ্বাসের’ পাশাপাশি ক্লাসিক চর্চার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এসবই ছিল তাঁর ধনাত্মক জীবন-বীপ্সার পরিচায়ক মাত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রী লাভের পর জনাব হুমায়ুনের কর্মজীবন শুরু হয় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ১৯৭০ সালের জানুয়ারী মাসে তিনি কক্সবাজার কলেজের বাংলার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। মাত্র ছ’ মাস তিনি কক্সবাজার কলেজে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৬ই জুলাই তিনি বাংলা একাডেমির বৃত্তি গবেষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করে পুনরায় ঢাকা ফিরে আসেন। বাংলা একাডেমিতে হুমায়ুনের গবেষণার বিষয় ও ছিল জীবননান্দ দাশ ও তাঁর কবিতা। রাজাপুরের ছেলে হুমায়ুন আজীবন জীবননান্দের অনুরাগী ছিলেন। যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তাঁর গবেষণা শুরু করেন এবং অত্যল্প কালের মধ্যে জীবনানন্দ সম্পর্কে জানা-অজানা বিস্তর তথ্য সংগ্রহ করেন। ১৯৭২ সালের ১১ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমিতে গবেষণার কাজে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত থাকেন। হুমায়ুন জীবননান্দ সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু সেগুলোকে প্রবন্ধাকারে সাজিয়ে যাওয়ার সময় পান নি। কিছু তথ্য তিনি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ আকারে বাংলা একাডেমির গবেষণা বিভাগে উপস্থাপন করেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২। এই তিনটি বছর হুমায়ুনের জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বলা চলে, এটিই তাঁর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক’টি ঘটনা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তুরের মহাপ্লাবন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ইত্যাদি এসবেরই অন্যতম। একজন সমাজচেতন ও রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে হুমায়ুন এ সময়কার ঘটনাস্রোতের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। ফলে প্রেমিক কবি ক্রমে ক্রমে প্রতিবাদী কবিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করলেন। কুসুমের পাশাপাশি বারুদ, বন্দুক ও ইস্পাতের নল তাঁর কবিতায় অনায়াসে স্থান করে নিতে শুরু করলো। গণ অভ্যুত্থানের প্রচণ্ডতা, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালীর বীর্যবত্তা, স্বজন হারানোর বেদনা, আবার তারই পাশাপাশি স্বাধীন বাংলাদেশের একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন তাঁর রচনায় উচ্চকিত হয়ে উঠলো। ‘কুসুমিত ইস্পাত’ এর কবিতাগুলোর অধিকাংশ এ সময়েই লিখিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্ব-মুহূর্তে বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার পাশাপাশি বাংলার প্রগতিশীল লেখক-সমাজও কলম ছেড়ে সরাসরি রাস্তায় নেমে আসেন। এই সংগ্রামী তরুণ লেখক গোষ্ঠির উদ্যোগে এ সময়ে সংগঠিত হয় ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’। বাংলাদেশের ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরপরই এই তরুণ লেখক গোষ্ঠির উদ্যোগে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ । শুরুতেই একটি ‘আন্দোলন’ হিসেবে লেখক শিবিরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ পর্যায়ে হুমায়ুন কবির ও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ এর আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের তৎকালীন তরুণ কর্মীদের মধ্যে সর্বজনাব আহম্মদ ছফা, ফরহাদ মাজহার, রফিক কায়সার, মুনতাসীর মামুন, হেলাল হাফিজ, রফিক নওশাদ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘বাংলাদেশ লেখক শিবিরের’ অন্যতম আহ্বায়ক থাকাকালেই ১৯৭২ সালের ৬ই জুন অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে হুমায়ুন কবির নিহত হন। এ সময়ে তিনি ইন্দিরা রোডে একটি ভাড়া বাসায় বাস করতেন। জীবদ্দশায় জনাব হুমায়ুনের কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে তিনি গ্রন্থ প্রকাশের কথা সক্রিয়ভাবে ভাবতে শুরু করেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর অন্যতম শুভানুধ্যায়ী ও বন্ধু জনাব আহমদ ছফার মাধ্যমে তিনি তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থের জন্য একজন প্রকাশকও পেয়ে যান। কাব্যগ্রন্থের প্রকাশক পাওয়া কঠিন। তাই তিনি তাঁর প্রথম পাণ্ডুলিপিতে যথাসম্ভব বেশি কবিতা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তৈরি হয় ৭৪টি কবিতা সম্বলিত পাণ্ডুলিপি ‘কুসুমিত ইস্পাত’। গ্রন্থটি যখন ছাপাখানায় পুরোপুরি কম্পোজ হয়ে গেছে তখনই হুমায়ুন লোকান্তরিত হলেন। নিজের মুদ্রিতগ্রন্থের প্রথম কপিটি দেখার সৌভাগ্য তাঁর হলো না। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলছেন যে যতদূর মনে পড়ে, হুমায়ুন সবগুলো কবিতার প্রথম প্র“ফ দেথে যেতে পেরেছিলেন। মৃত্যুর মাস খানেকের মধ্যে ঢাকার বাংলা বাজারস্থ ‘খান ব্রাদার্স এ্যাণ্ড কোম্পানী’ থেকে ‘কুসুমিত ইস্পাত’ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এটিই কবির প্রকাশিত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ। হুমায়ুনের কবিজীবনের দ্রুততম বিকাশও এ গ্রন্থে লক্ষণীয়। বিষয়ে ও আঙ্গিকে এ গ্রন্থটি সমকালীন কাব্যগুলোর মধ্যে বিশিষ্ট। সবচেয়ে বড় কথা, এ গ্রন্থে হুমায়ুন কবির এমন একটি স্ববিরোধহীন প্রত্যয় হিসেবে ধ্বনিত হয়েছেন, যে প্রত্যয় একটি ঐতিহাসিক বিবর্তনে ইস্পাতকে কুসুমে পরিণত করার স্পর্ধা রাখে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘হুমায়ুন কবির রচনাবলী’তে ‘রক্তের ঋণ’ নামে কবি হুমায়ুন কবিরের আরেকটি কাব্যগ্রন্থ সংকলিত হয়েছে। এই পাণ্ডুলিপিটি হুমায়ুন নিজ হাতে তৈরী করে যান নি। তাঁর মৃত্যুর পর ঢাকার একটি বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অনুরোধে জনাব আলী মনোয়ার, মিসেস সুলতানা রেবু ও কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা এ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। এই পাণ্ডুলিপিতে হুমায়ুনের গণ-জাগরণ-মূলক কবিতাগুলোর প্রাধান্য রয়েছে। ‘রক্তের ঋণে’র বাইরে প্রাপ্ত হুমায়ুনের অন্যান্য কবিতাবলী ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ শিরোনামে উক্ত রচনাবলীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। হুমায়ুন কবিরের কবিতা প্রসঙ্গে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন যে কবিতার শরীর নির্মাণে, বিশেষতঃ উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও শব্দনির্মাণে হুমায়ুন বরাবরই জীবনানন্দীয় পরিমণ্ডলের অধিবাসী। ‘হুমায়ুন কবির রচনাবলী’ শীর্ষক উক্ত সংকলনে যে সব কবিতা অন্তর্ভূক্ত তার বাইরেও হুমায়ুনের কিছু কবিতা রয়েছে। তবে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলছেন যে এগুলোর প্রায় সব কটিই উক্ত সংকলনে উপস্থাপিত কোন না কোন কবিতার ভিন্নতর ভাষ্য মাত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হুমায়ুন কবির তাঁর প্রতিটি লেখারই বিস্তর পরিমার্জনা করেছেন। এক একটি কবিতা বা প্রবন্ধ তিনি একাধিকবার লিখেছেন, ছাপাও হয়েছে একাধিকবার একাধিক সংকলনে বা পত্রিকায়। তাই তাঁর রচনাগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত পূর্ণতার রচনাগুলোকেই এই সংকলনে নেয়া হয়েছে বলে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা উল্লেখ করেছেন। কবিতা ছাড়াও হুমায়ুন কবির কিছু প্রবন্ধ ও কিছু গল্পও লিখেছেন। জীবনানন্দ সম্পর্কিত প্রবন্ধাবলী ছাড়াও সাহিত্য, ও সমাজ, বিশেষতঃ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে হুমায়ুন কবির বেশ কিছু তীক্ষèধী প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধ তাঁর কবিতার মতোই কাব্যগন্ধী ও সংক্ষিপ্ত। যুক্তির চেয়ে বক্তব্যের সরাসরি উপস্থাপনই তাঁর অন্বিষ্ট ছিল মনে হয়। তবে জীবনানন্দ সম্পর্কিত প্রবন্ধাবলী বোধগম্য কারণেই একটু ব্যতিক্রম। এখানে হুমায়ুন অনেক বেশী তথ্য-নিষ্ঠ। হুমায়ুন বাক্যবিন্যাসে বরাবরই পরোক্ষতার পক্ষপাতী। ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকে যে কৃত্রিম গদ্যচর্চার আবহ সৃষ্টি হয়েছিলেণা, হুমায়ুনের বাক্যবিন্যাস সেই আবহেরই অনুবর্তী বলে অনুমিত হয়। হুমায়ুন কবির গল্প লিখেছেন অনেকটা খেয়ালের বশে। সত্তুরের দশকের শুরুতে রফিক নওশাদ সম্পাদিত গল্পপত্রিকা ‘সূচীপত্র’-ই ছিল তাঁর গল্পরচনার প্রধান প্রেরণা। তাঁর গল্পগুলোও কাব্যগন্ধী, সংক্ষিপ্ত ও প্রতীকী। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখছেন যে জনাব হুমায়ুনের বন্ধু-ভাগ্য ছিলো সুপ্রসন্ন। তাঁর মৃত্যুর পর একথা বিশেষভাবে প্রমাণিত। অসংখ্য তরুণ কবি তার সম্পর্কে কবিতা লিখেছেন। ফরহাদ মাজহার লিখেছেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আমি ডেকে বলতে পারতুম হুমায়ুন’। তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মুহম্মদ নূরুল হুদা নিজেও রফিক নওশাদ সম্পাদিত কবিতা পত্রিকা ‘কালপুরুষ’-এ (আগস্ট, ১৯৭২) স্পন্দিত গদ্যে লিখলেনঃ ‘আরেক লোরকা তিনি, বঙ্গ দেশীয় লোরকা, রক্তাক্ত হয়েছেন জীবনে, মৃত্যুতে এবং কবিতায়। তাঁর শিরায় যে স্রোত প্রবহমান, কবিতায় তাকে অবলীলায় ধারণ করেছেন। হাতের বেয়নেট দিয়ে কখনও তার রঙকে পরখ করতে করতে স্মরণ করেছেন ক্রিষ্টোফার কড-ওয়েলকে। জরামৃত্যুমারীভরা নীরব নিখিলে লোকোত্তর বাগানের স্বপ্নে বাঁচতে চেয়েছিলেন একজন নিসর্গলীন জীবনানন্দের মতো। অথচ তিনি নিহত হলেন, সুহৃদ প্রকৃতি আততায়ী বুলেট হয়ে ভেদ করলো তাঁর করোটি; আর তিনি, আমাদের ধনাত্মক জীবন-চর্চার অন্যতম বীর্যবান পুরুষ। হুমায়ুন কবির আমাদের স্বপ্ন, জাগরণ ও শহরের প্রতিটি সড়ক একাকার করে নিঃশব্দে অবগাহন করতে থাকলেন একটি সম্ভব লোহিত ঝর্ণায়।’ কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখছেন যে হুমায়ুন সম্পর্কে তাঁর বন্ধুবান্ধবদের আবেগ যে থিতিয়ে এসেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার সম্পর্কে যতো কথা হয়েছে, ততো তাঁর সাহিত্যালোচনায় হয়নি। হয়তো হাতের কাছে তার রচনা না পাওয়াটাই এর অন্যতম কারণ। বিলম্বে হলেও বাংলা একাডেমির এই অভাবটি বহুলাংশে পূরণ করছে। আশা করা যায়, এখন হুমায়ুনের রচনাসমূহ আলোচিত হবে। জনাব হুমায়ুনের স্ত্রী ছিলেন তাঁরই সহপাঠিনী সুলতানা রেবু। মৃত্যুকালে হুমায়ুন এক পুত্র (আদিত্য কবির, ডাক নাম ‘সেতু’) ও এক কন্যার (অদিতি কবীর, ডাক নাম ‘খেয়া’) জনক ছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন পর জন্মগ্রহণ করে তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অনিন্দ্য কবির, ডাক নাম ‘অভীক’। (তথ্যউৎস: বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘হুমায়ুন কবির রচনাবলী’ গ্রন্থে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা কর্তৃক লিখিত ভূমিকা)