সুলতানী আমলে চন্দ্রদ্বীপ

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:৩২, ১১ জুন ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে (অর্থনৈতিক অবস্থা)

সুলতানী আমলে চন্দ্রদ্বীপ


শাসন ব্যবস্থা

১২০৩ হতে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ- এই ৩৭৩ বছর চন্দদ্বীপ গৌড়ের সুলতানী শাসন হতে বিচ্ছিন্ন ছিল। মাঝে মাঝে চন্দ্রদীপের উত্তরভাগ গৌড়ের সুলতানদের অধীনে ছিল। সেখানে তাদের কোন প্রতিনিধি ছির সা। চন্দ্রদ্বীপ রাজা কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে রাজ্য শাসন করতেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজা সেন ও সুলতানী উভয় শাসন ব্যবস্থা অনুসরণ করতেন। দেওয়ান, কোতোয়াল, আমির, মির, বকশী, পাইক প্রভৃতি কর্মচারী রাজ্যের শাসন পরিচালনা করত। হোসেনশাহী আমলে বাকলার উত্তরাংশ ফতেহাবাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কসবা নগরে প্রশাসনিক ও বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। কসবার শাসনকর্তাকে শারই লসকর বলা হতো। চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের সেনাবাহিনীতে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক ছিল। নেয়ামত খাঁ পরমানন্দ বসুর একজন উজির ছিলেন। শাসনক্ষেত্রে ধর্মের প্রভাব ছিল অত্যধিক। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য উচ্চ রাজপদে আসীন হতো।


ধর্ম ও সমাজ

চন্দ্রদ্বীপ সমাজ ব্যবস্থা ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। চন্দ্রদ্বীপের রাজা দনুজমর্দন ও তার বংশধররা বাকলা সমাজের অধিপতি ছিলেন। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা সমাজের নেতৃস্থানীয় ছিল। উৎপাদিত অর্থে তারা জীবনযাপন করত। সমাজের সকল সুযোগ-সুবিধা তারাই ভোগ করত। নি¤œশ্রেণীর নমঃশূদ্র, জেলে ও নাথ সমাজে নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত ছিল। বাকলা সমাজের প্রাধান্য থাকায় বৌদ্ধধর্ম আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়। নাথ, যোগী, নমঃশুদ্র ও জেলেরা বৌদ্ধ ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করে। ১৫ শতকে মুসলমানদের প্রভাবে সমাজে আরও পরিবর্তন আসে। গৌড়ের সুলতানরা এ দেশকে আপন বলে গ্রহণ করলেও সমাজে কিছু কিছু সাম্প্রদায়িকতা দৃষ্ট হয়। বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গল কাব্যে হিন্দুর প্রতি মুসলমান কাজীর অ্যাচারের বর্ণনা আছে:

“হারামজাত হিন্দুর এত বড় প্রাণ আমর গ্রামেতে বেটা করে হিন্দুয়ান গোটে গোটে ধরিব গিয়া সতেক ছেমরা। এড়ারুটি খাওয়াই কলিব জাতিমারা ॥

ঘোষ, বসু, মিত্র, গুহ বাকলার এই কুলীন পরিবারগুলো তৎকালীন সমাজে বিশেষ ভূমিকা পালন করত। তাদের সাথে হিন্দু বৈদ্য খুব প্রভাবশালী ছিল। গৈলা ও ফুল্লশ্রী বৈদ্যদের প্রধান বাসভূমি ছিল। কবি বিজয় গুপ্ত, ত্রিলোচন দাশ বৈদ্য সন্তান ছিলেন । গৈলা-ফুল্লশ্রীর বৈদ্য পরিবারগুলো সুলতানী আমলের রাঘবেন্দ্র ও ত্রিলোচন দাশের বংশধর। ১৫ শতকের প্রথম ভাগে তারা এ গ্রামে বসতি স্থাপন করে। নলচিড়া, চাঁদশী, বাটাজোড়, শিকারপুর, মাহিলারা, রামসিদ্ধি,বাউফন, কালাইয়া, ধূলিয়া, দেহেরগতি, ইদিলপুর, দেউলী প্রভৃতি গ্রামে কায়স্থদের বাস ছিল। সুলতানী আমলে বাকলায় মুসলমানদের সংখ্যা কম ছিল। নির্যাতিত জেলে ও কৃষকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেও সমাজে মর্যাদা পায়নি। আরব-পারস্য থেকে আগত পরিবারগুলো রাজানুগ্রহ লাভ করে মুসলমান সমাজে নেতৃস্থানীয় ছিল। সৈয়দ, কাজী, খোন্দকার ও সুলতানের কর্মচারীরা সমাজে প্রভাবশালী ছিল। মুসলমানদেরও ধর্মকেন্দ্রিক সমাজ ছিল। সুলতানী আমলে গাজীর গীত বা কাহিনী মুসলমান সমাজে জনপ্রিয় ছিল। স্থানীয় বিশ্বাস গাজী-কালু সুন্দরবন হয়ে চন্দ্রদ্বীপে আগমন করেন। আমতলী থানার পাটুয়া গ্রাম ও উজিরপুরের গাজীরপাড় গ্রামে গাজীর স্মৃতি আছে।


অর্থনৈতিক অবস্থা

বাকলা সমাজ কৃষিনির্ভর ছিল। অর্থনীতি ছিল গ্রামীণ। সমাজ জীবনে চেতনা ও সৃষ্টিশক্তি অবর্তমান ছিল। সমাজ পরিবর্তনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না। মুসলমানদের আগমন সমাজে কিছুটা মানবীয় মূল্যবোধের সৃষ্টি করছিল বটে কিন্তু পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের ভূমিকা ছিল গেওণ। বিজয় গুপ্তের লেখায় সমাজের জোলা, তাঁতী, জালো, মালো, পাইক, মালী ও সওদাগরের উল্লেখ আছে। সমাজে যারা উচ্চশ্রেণী ছিল তারা ধর্ম চর্চা, লেখাপড়া ও বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিল। নি¤œশ্রেণীর লোকেরা কৃষিকাজ করত, মাছ ধরত ও কাপড় বুনত। উচ্চশ্রেণী প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করত। বিজয় গুপ্তের কাব্যে চন্দ্রধর সওদাগরের সম্পদের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে মনে হয় সুলতানী আমলে চন্দ্রদ্বীপে বাণিজ্যের প্রসার ছিল। রাজা পরমানন্দ বসু ১৫৫৯ সালে পর্তুগীজদের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করেন। এ চুক্তিতে দেখা যায় বাকলা হতে চাল, লবণ, চিনি ও তুলা রফতানি হতো। বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গলে দেখা যায় চান্দ আদা, খেজুর, মুলা, সুপারি, নারিকেল, হলুদ, পান, চুন, কলাই, চট, পাটবস্ত্র, মুগ প্রভৃতি চৌদ্দডিঙ্গায় কওে সাগর পেরিয়ে অন্য রাজ্যে বিক্রি করতেন। সমাজের প্রাচুর্যেও পাশে সাধারণ লোকের দুঃখ-দুর্দশা ছিল। বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গলে সোমাই পন্ডিতের পাঠশালার ছাত্রদের একটি বিবরণে দেখা যায়-

“কেহ বলে খিধার টানে খাই চিড়া কলা কেহ বলে দুঃখে আমি ঠাঁই খুঁজি কেহ বলে প্রবাসী আমি এক সন্ধ্যা ভূঞ্জি॥ গোবর্ধন নামে শিষ্য অভয়া তার মাতা ঘাসিতে খুশিতে কহে আপনার কথা আমি অতি দরিদ্র মোর জীবন ধিক। ঘরে ভাত নাই মোর মায় মাগে ভিখ।” রাখাল বালকদের কথায় দারিদ্র্যের আর একটি করুণ চিত্র- “বাপ পিতামহের কি কহিব মহত্ত্ব দুর্ভিক্ষে বেচিয়া খাইল লিখিয়া লইল খত।”

জেলার মৃত্যুতে তার স্ত্রীর অবস্থা বর্ণনায় কবি বিজয় গুপ্ত লিখেছেন-

“বেশাতির সঞ্চয় তার কিছু নাহি ঘরে পোন চারি কড়ি দেও জোলাঝির তরে।”

দরিদ্র লোকের পান্তভাত ও কলা-চিড়া খাইত। মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ হতো। আকালের সময় বিত্তবানদের নিকট ভূমি বিক্রি করতে হতো। অনেকে ভিক্ষা করত।

পনেরো শতকে চন্দ্রদ্বীপের জনগণের আহার্য ভিল ভাত, মাছ, ডাল, ঘি, নিরামিষ, মসুরি, বেগুন, ধনিয়া পোলতার পাতা, কাঁচাকলা, গিমা, বাথুয়া, কুমড়া শাক, বেতাগ, ঝিঙ্গা, কাঁঠালের আঁটি, রাঙ্কুনী, কটু তেল, কলার থোড়, দৈ, পানিকচুর বৈ, বরবটি, লাউ, কলাইর ডাল, রুই, চিংড়ি, চিতল, কৈ, বাইন ইত্যাদি খাদ্য চন্দ্রদ্বীপে প্রচলিত ছিল।

পুরাকীর্তি

বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে সুলতানী আমলের অনেক কীর্তি বর্তমান আছে। প্রাচীন কীর্তিগুলোর মধ্যে মজিদ, মন্দির, দালান ও দীঘি প্রধান। সুলতান বরবক শাহের রাজত্বকালে ১৪৬৫ সালে পটুয়াখালী জেলার মসজিদবাড়ীর মসজিদ নির্মিত হয়। মসজিদটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট এবং বর্গাকার কোঠা। সামনে খিলানযুক্ত বারান্দা ও চারকোণে অষ্ট-ভুজাকৃতির চারটি মিনার আছে। পূর্ব দিকে ছোট আকারের বাঁকা তিনটি দরজা আছে। এর কারুকার্যবিহীন ছাদ খানজাহান আলীর স্থাপত্যের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। কিন্তু মসজিদের খিলান ও দরজার উপরিভাগের গঠন দিল্লীর ফিরোজ শাহী স্থাপত্যের সাদৃশ্য আছে। এর দৈর্ঘ্য ৪৯ ফুট ২ ইঞ্চি, প্রস্থ ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি এবং দেয়ালগুলো ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি পুরু।

পনেরো শতকের শেষভাগে নির্মিত গৌরনদী থানার কসবার আল্লারঘর বরিশালের বৃহত্তম মসজিদ। মসজিদটি নয় গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদরে চারদিকে গোলাকৃত মিনার আছে এবং দেয়ালগুলো ৬ ফুট পুরু। মসজিদের ভিতরে ৪ টি পাথরের স্তম্ভ আছে। দু’টি স্তম্ভ ভক্ত মানুষের স্পর্শে সরু হয়েছে। এই মসজিদের গঠনপ্রণালী খানজাহান আলী নির্মিত মসজিদের মতো। মসজিদের উত্তর দিকে হযরত দূত মল্লিকের মাজার আছে। মাজার প্রতিষ্ঠাকাল বাংলা ১লা জ্যৈষ্ঠ ৮৯০ সন (১৪৮৩ সাল)। মাজার সংরক্ষণের জন্য স¤্রাট জাহাঙ্গীর লাখেরাজ সম্পত্তি দান করেছেন। এ দানপত্রে স¤্রাজ্ঞী নূরজাহানের খোদিত পাঞ্জা কসবার কাজী গোলাম মাহবুবের কাছে রক্ষিত আছে।

বাকেরগঞ্জ থানার শিয়ালগুনী গ্রামে একটি মসজিদ আছে। কথিত আছে, সুলতান নসরত শাহ (১৫১৮-৩২) এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদেও শিলালিপি ঝড়ে ভেঙ্গে গেছে। মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। এখনও মসজিদে অনেক কারুকর্য আছে। ৬

সুলতানী আমলে নির্মিত কোন মন্দির বর্তমান নেই। বাকলা-কচুয়া রাজবাড়ির মন্দিরটি তেঁতুলিয়া নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ধূলিয়া, রাজাপুরের মঠবাড়িয়া, ক্ষুদ্রকাঠি, ফুল্লশ্রী, গোবিন্দপুর প্রভৃতি গ্রামে মন্দির ছিল। সে মন্দিরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে।

কচুয়ায় নির্মিত রাজপ্রাসাদগুলো ধ্বংস হয়েছে। রাজবাড়িতে এখন কোন চিহ্ন নেই। আছে শুধু প্রাচীনকালের স্মৃতি।

সুলতানী আমলে চন্দ্রদ্বীপে অনেক দীঘি খনন করা হয়েছে। কচুয়ার সন্নিকটে কালাইয়া গ্রামে অবস্থিত রাজকুমারী কমলার দীঘি ১৫ শতকের শেষ ভাগে খনন করা হয়েছে। দীঘিটি ভরে গেছে। মির্জাগঞ্জ থানার নতুন শ্রীপুর গ্রামের ছেরপালের দীঘিটি পনেরো শতকের মধ্যভাগে খনন করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। ঝাটিবুনিয়া, ফুল্লশ্রী, গাজীরপাড়ে, কসবা, ধূলিয়া প্রভৃতি গ্রামে কয়েকটি দীঘি আছে।


বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি

চর্যাপদ রচনাকাল ১২০০ সালে শেষ হয়। তারপর ১৪৫০ সাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। এ সময় তেমন সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মীননাথের পর বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম কবি হলেন কানাহরি দত্ত। কনাহরি দত্ত মঙ্গল কাব্যের আদি রচয়িতা। ড. শহীদুল্লাহ মনে করেন কানাহরি দত্ত পূর্ববঙ্গের অধিবাসী ছিলেন। তিনি খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকের কবি। বিজয় গুপ্ত তার পদ্মপুরাণে কানাহরি দত্ত সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন-

“মূর্খে রচিল গীত না জানে মাহাত্ম্য। প্রথমে রচিল গীত কানাহরি দত্ত॥”

বিজয় গুপ্তের সময় কানাহরির কাব্য লুপ্তপ্রায় ছিল। জোড়াগাঁথা দিয়ে পদ্মপুরাণ গীত হতো। বিজয় গুপ্তের প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে কানহরি দত্ত কাব্য লিখেছেন। তার কাব্যে বরিশালের সমাজ জীবনের ছাপ বেশি। কানাহরি দত্ত বরিশালের কবি। তার জন্ম ফুল্লশ্রীতে হতে পারে। তার কাব্য এ অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। মনসা আখ্যান ভাগ চম্পকনগরে সৃষ্টি। হয়ত কোন সংস্কৃত সাহিত্য অনুবাদ করে কানাহরি দত্ত চতুর্দশ শতকে মনসা কাব্য রচনা করেন। হরি দত্তের একটি গীত উদ্ধৃত হলো-

“চারি চতুর্বেদ নিশি জগরণ করে পূজা হইলে ছাগ বলিদান। কবি কহে হরি দত্ত যে জানে পরম তত্ত্ব মনসা দেখিলে বিদ্যামান।”

প্যারি মোহন দাশগুপ্ত প্রথম পদ্মপুরাণ সংগ্রহ করেছিলেন। বাংলা ১৩০৬ সন বা ১৮৯৯ সালে রামচরণ শিরোমণি বরিশাল আদর্শ প্রেস থেকে পদ্মপুরাণ প্রকাশ করেন। পূর্বে তুলট বা তালপত্রে পাঁচালী লিখিত ছিল। প্যারি মোহন দাসের পূর্বে গৈলার দেবী প্রসাদ সেন মজুমদার ১৭৭৪ সালে ও সরমহলের সলারাম গুপ্ত ১৭৯৮ সালে বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল গ্রন্থাকারে তুলট কাগজে লিপিবদ্ধ করেন। প্যারি মোহন দাশ তাদের গ্রন্থ থেকে যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছেন। ১৯৬২ সালে বি.এম. স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত কয়েকখানি হস্তলিখিত পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে কলকতা থেকে মঙ্গল কাব্য প্রকাশ করেন।৭

চাঁদের অনমনীয় পৌরুষ ও বেহুলার চরিত্রে বিদ্রোহের প্রকাশ এ কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। চাঁদ বাংলার বিদ্রোহী জনতার এবং বেহুলা বঙ্গলক্ষ্মী নারী সমাজের প্রতীক। বরিশাল বি.এম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল মাজেদ হাওলাদার বলেছেন,“ চাঁদ সদাগর ও বেহুলা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য যতই এ দেশ বহির্ভূত বলে অনুমান করা হোক না কেন এ জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করলে সহজেই বোঝা যায়। ..... বিজয় গুপ্তের কাব্যেও চরিত্র সৃষ্টিতে তাই একদিকে যেমন বরিশাল অঞ্চলে মনসাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলকাব্য রচিত হওয়ার বাংলা সহিত্যে এ জেলার অবদান বিশেষভাগে উল্লেখযোগ্য।

সৃজ্যমান বাংলা ভাষা জনসাধারণের মনকে মুক্তি দিয়েছে। বাকলা চন্দ্রদ্বীপে যে সংস্কৃতি ভাষার সুদৃঢ় প্রাচীর ছিল তা চতুর্দশ শতক হতে শিথিল হয়ে পড়ে। জনগণ আপন ভাষার মাধ্যমে আপন চিন্তাভাবনা আপন ভাষায় রূপ দেয়। সর্বপ্রথম একজন বাঙালী দেশী বাংলা ভাষায় আপন প্রকাশ খুঁজে পেয়ে ব্যাপকভাবে জনগণের মন ও হৃদয় জয় করেন।”


সংস্কৃত ভাষা

বাকলা সংস্কৃত ভাষা চর্চার অন্যতম পীঠস্থান ছিল। বাকলার সংস্কৃত পন্ডিতগণ বঙ্গ বিখ্যাত ছিল। সংস্কৃত পন্ডিতদের মধ্যে ত্রিলোচন দাম, রূপসনাতন, জীব গোস্বামী, জানকী নাথ ও মধুসূদনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিজয় গুপ্তের মাতুল ত্রিলোচন দাশ পনেরো শতকের প্রথম ভাগে ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার ভগ্নি রুক্ষ্মিণী বিজয় গুপ্তের মাতা। ত্রিলোচন ফুল্লশ্রী গ্রামে শিক্ষালাভ করে কবিন্দ্র উপাধি লাভ করেন। তার পুরোহিত রামটুরী চক্রবর্তী ও পিতা হেরম্বও চন্দ্র ফুল্লশ্রীতে বসতি স্থাপন করেন। সিহিপাশার ডিংসাই বংশের আদি পুরুষ রামটুরী চক্রবর্তী। ত্রিলোচন দাশ সংস্কৃত ভাষায় কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করেন। কলাপ ব্যাকরণের টীকা নিয়ে তার লেখা ‘কাতন্ত্রবৃত্তি পঞ্জিকা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার পুত্র জানকী নাথ একজন বিখ্যাত নৈয়ায়িক ছিলেন। জানকী নাথ পঞ্চদশ শতকে আবির্ভূত হয়েছিলেন। ন্যায় সিদ্ধান্ত মঞ্জরী ও আন্বীক্ষিকীতত্ত্ব বিবরণ জানকি ণাথ রচিত। প্রথম গ্রন্থে তিনি স্বরচিত মনিমরীচি ও তাৎপর্যদীপিকার উল্লেখ করেছেন। তার শিষ্য কলাদ তর্কবাগীশের ভাষারতœ ও তত্ত্বচিন্তামণির অনুমান খন্ডের টীকা রচনা করেছেন। জানকী নাথের পুত্র ভাবানী নাথ সার্বভৌম ও পৌত্র রঘুনাম কবিকন্ঠ বরণ ও রঘুরাম দাশ কবিকন্ঠ পান্ডিত্য গৌরবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ষোল শতকের প্রথম ভাগে মধুসূদন সরস্বতী কোটালীপাড়ার উপশিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ফুল্লশ্রীতে বিদ্যার্জন করেন। তিনি বারোখানা গ্রন্থ রচনা করেন। তার গ্রন্থের মধ্যে অদ্বৈতসিদ্ধি, প্রস্থান ভেদ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তিনি একজন বিখ্যাত বেদান্ত দার্শনিক ছিলেন এবং আকবরের রাজসভায় সম্মানিত হয়েছিলেন।


রূপ-সনাতন

সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় কয়েকজন প্রতিভাশালী পন্ডিতকে তার সভায় উচ্চপদ প্রদান করেন। এ পন্ডিতদের মধ্যে চন্দ্রদ্বীপ-বাকলার রূপ-সনাতন অন্যতম ছিলেন। রূপ-সনাতন পূর্ব পুরুষ জগতগুরু কর্ণাটক প্রদেশের ভরদ্বাজ গোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ রাজা ছিলেন। তার পুত্র অনুরুদ্ধ দেবের দুই পুত্র-রূপেশ্বর ও হরিহর। হরিহর বৈমাত্রের ভ্রাতা রূপেশ্বরকে বিতাড়িত করে নিজে রাজা হন। রূপেশ্বর সপতœীক পৌরস্ত দেশে পলায়ন করেন। সেখানে তার পদ্মনাভ নামে এক সর্বগুণান্বিত পুত্র জন্মগ্রহণ করে (১৩৮৬ সাল)। পদ্মনাভ দনুজমর্দন কর্তৃক পূজিত হয়ে গঙ্গার হয়ে গঙ্গার তীরে নৈহাটি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। পদ্মনাভের পুত্র মুকুন্দ। মুকুন্দেও পুত্র কুমারদেব পীরালিদের ভয়ে নৈহাটী ছেড়ে দনুজমর্দন প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে চলে আসেন । ৮

যবনের ভয় কুমার নৈহাটী ছাড়িল কিছুদিন বঙ্গে চন্দ্রদ্বীপে বাস কৈলা। [প্রেম বিলাস]

আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিঃ কুমারদেব বাকলায় বসতি স্থাপন করেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজা তাকে ভূমি প্রদান করেন। বাকলায় কুমার দেবের অমর, সন্তোষ ও বল্লভ নামে তিন পুত্রের জন্মগ্রহণ করে। শ্রী চৈতন্যদেব তাদেও তিন ভাইয়ের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ ও অনুপম রেখেছিলেন এবং সে নামেই তারা পরিচিত। অমর ,সন্তোষ ও বল্লভ বাকালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে গৌড়ের রামকেলিতে চলে যান। মুকুন্দ দেবের মৃত্যুর পর তিন ভ্রাতা সুলতানদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে তারা পদোন্নতী লাভ করেন। অমর দবিরখাস-প্রধান অমাত্র, সন্তোষ সাকর মল্লিক-রাজস্ব বিভাগের প্রধান এবং বল্লভ টাকশালের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৫১৩ খ্রিঃ গৌড় শ্রীচৈতন্য দেবের সাথে তাদের সাক্ষাত হয় । ১৫১৪ সনাতন এবং ১৫১৫ খ্রিঃ রূপ রাজসভা ত্যাগ করে শ্রীচৈতন্যেও নিকট চলে যায়। চৈতন্যের দর্শন লাভের পর সনাতন যখন রাজসভা পরিত্যাগ করতে চাইলেন তখন সুলতান হোসেন শাহ তাকে তিরস্কার করে বললেন-

“তোমার বড় ভাই করে দস্যু ব্যবহার। জীব বহু মারি কৈল বাকলা ছারখার। হেতা তুমি কৈলা মোর সর্ব্বকার্য নাশ।”

সনাতনের বড়ভাই ছিল না। এখানে বোধ হয তার ভগ্নিপতি শ্রীকান্তকে উদ্দেশ্য করে এ কথা বলা হয়েছে। সুলতান হয়ত শ্রীকান্তকে বাকলায় পাঠিয়েছিলেন। শ্রীরূপ ও বল্লভ রামকেলি হতে পরিবারবর্গ ও ধনম্পদসহ বাকলার পুরনো বাড়িতে এবং কতেক ফতেহবাদে পাঠান। শ্রীবল্লভ পরিবারবর্গ নিয়ে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের বাড়ীতে বাস করতেন। রূপ-সনাতন যশোর জেলার প্রেমবাগে ভূমি লাভ করে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। “পূর্ব্বে পরিজনে পাঠাইলা সাব হিতে। কত চন্দ্রদ্বীপেট কত ফতেহাবাদেতে॥ শ্রীরূপ বল্লভসহ নৌকায় চড়িয়া। বহু ধন লৈয়া গৃহে গেল হর্ষ হৈয়া॥” (ভক্তি রতœাকর)

বল্লভ চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী বাকলায় স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাস করতেন। রূপ-সনাতনের স্ত্রী সন্তানরাও শ্রীবল্লভের সাথে বাকলায় বাস করতেন। বাকলা নগরে শ্রীবল্লভের পুত্র শ্রীজীব ১৫১৩ খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীজীব বৈষ্ণব ধর্মে মুগ্ধ হয়ে ১৫৩৩ খ্রিঃ বাকলা থেকে নবদ্বীপে যান। ভক্তি রতœাকরে শ্রীজীব সম্পর্কে আছে-

“অধ্যয়ন ছলে নবদ্বীপ যাত্রা কৈল। চন্দ্রদ্বীবাসী লোক বিচারিল মনে॥ অবশ্য শ্রীজীব যাইবেন বৃন্দাবনে। শ্রীজীব সঙ্গেও লোক বিদায় করিয়া॥ ফতেহা হইতে চলে এক ভৃত্য লইয়া।”

শ্রীজীব নবদ্বীপ ও কাশীতে বিখ্যাত গুরুর নিকট বেদান্ত ও দর্শন শাত্রে পান্ডিত্য লাভ করেন। তিনি বৃন্দাবনে শ্রীরূপের নিকট বিদ্যালাভ করেন। রূপ-সনাতনের শাস্ত্র জ্ঞান ছিল অপরিসীম। উভয় ভ্রাতা ৪০ বছরের বেশি মথুরা, বৃন্দাবন ও কাশীধামে ধর্ম সাধনা ও শাস্ত্র চর্চায় অতিবাহিত করেন। তারা যেমন পন্ডিত তেমনি সর্বত্যাগী বৈষ্ণব ভক্ত সন্ন্যাসী ছিলেন। তারা কাশীধামে শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপা লাভ করেন। জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল রুপ-সনাতনের ভক্তি গ্রন্থ রচনায়। বৃন্দাবনের আচার্য পদে রূপ ও সনাতকে বরণ করা হয়েছিল। রূপ-সনাতনের মৃত্যুরপর শ্রীজীব বৃন্দাবনের প্রধান গোস্বামী হন। বৃন্দাবনের আচার্যদিগের মধ্যে যে ছয়জন গোস্বামীর বৈষ্ণব জগতে সর্বজন পরিচিত তাদেও মধ্যে রূপ-সনাতন এবং শ্রীজীব প্রধান। সনাতন শেষ জীবনে বৈষ্ণব তোষণী নামে এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের ভ্রাতুপুষ্প শ্রীজবি গোস্বামী তাদের নির্দেশে ঐ গ্রন্থের সংক্ষেপ করে নামকরণ করেন। লঘু তোষণী হতে রূপ- সনাতনের বংশ পরিচয় পাওয়া যায়। শ্রীজীব ছয়খানা দর্শন গ্রন্থ রচনা করেছেন। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও বৈষ্ণব সাহিত্য রচনা করে রূপ সনাতন ও জীব গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তারা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের গৌরব। যশোর-খুলনা ইতিহাস লেখক সতীশ চন্দ্র মিত্র রূপ-সনাতনকে যশোর জেলার লোক বলে দাবি করেছেন। তার কারণ রূপ-সনাতন গৌড়ের সুলতানের অমাত্য থাকাকালে যশোরের প্রেমবাগে ভূ-সম্পত্তি লাভ করেন। রূপ-সনাতন প্রেমবাগে একটি বাড়ী নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে তাদের কর্মচারী বাস করত। রূপ-সনাতন ও শ্রীবল্লভ কোনদিন প্রেমবাগে বসবাস করেননি। রূপ-সনাতন বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের সন্তান এবং বরিশালের ইতিহাসে তাদের নাম চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। সাহিত্য-সংস্কৃত চর্চায় বাকলা নবদ্বীপ ও বিক্রমপুর হতে প্রাচীন। দেশ-বিদেশের ছাত্ররা বাকলায় বিদ্যার্জনে আসত এবং কবিন্দ্র, সার্বভৌম, কবি কণ্ঠহার প্রভৃতি উপাধি লাভ করত। চিকিৎসাবিদ্যা ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বাকলা বাংলাদেশে অদ্বিতীয় ছিল । বাকলার সাহিত্য-সংস্কৃতি উন্নত ছিল। কিন্তু তা ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। সমাজ ও মানুষ নিয়ে তেমন কোন সাহিত্য এ যুগে সৃষ্টি হয়নি। এ সময ইউরোপ ছিল নবজাগনের যুগ। সর্বত্র মানুষের জয় ঘোষিত হচ্ছিল। অথচ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি তখন ছিল পশ্চাৎমুখী।


তথ্য নির্দেশ

১. মনসা মঙ্গল, বিজয় গুপ্ত ২. প্রাগুক্ত ৩. H.Beveridge, Sistrict of Bakarganj,page35 ৪. Dr. Ahmad Hasan Dani, Muslim Archtecture in Bengal ৫. সাক্ষাৎকার-এডভোকেট কাজী গোলাম মাহবুব, কসবা, গৌরনদী ৬. H.Beveridge, Sistrict of Bakarganj,page35 ৭. সাক্ষৎকার- জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত, গৌরনদী ৮. সতীশ চন্দ্র মিত্র, যশোর-খুলনার ইতিহাস, পৃষ্ঠা ৩৮১-৩৯৭