"সিরাজ শিকদার"-এর বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

Barisalpedia থেকে
(মুক্তিযুদ্ধ)
(মৃত্যু)
৪০ নং লাইন: ৪০ নং লাইন:
  
 
== মৃত্যু ==
 
== মৃত্যু ==
কী অবস্থায় সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে শেষপর্যন্ত আটক হন, এবং ঠিক কখন কোথায় কীভাবে তাঁকে নির্বিচার হত্যা করা হয় সে সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলছেনঃ সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। জাকারিয়া চৌধুরীর (জাকারিয়া চৌধুরী হলেন সিরাজ সিকদারের ছোটবোন ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় ঢাকাস্থ রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় (বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস, অনুবাদ- মোহাম্মাদ শাজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, চতুর্থ মূদ্রণ-জুলাই ২০০৬)। অনেকের মতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। আবার অন্য তথ্য মতে উনি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন, যখন উনি গ্রেফতার হন গ্রেফতার কারী জানতেন না যে উনি সিরাজ শিকদার। ওই দিনই তাঁকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জনু সিরাজ সিকদার গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান শেখ মহিউদ্দিন আহমদ ও মহাসচিব নাজমুল ইসলাম সাইদ ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার নিষ্পত্তি হয় নি।
+
কী অবস্থায় সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে শেষ পর্যন্ত আটক হন, এবং ঠিক কখন কোথায় কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় সে সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলছেনঃ সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। জাকারিয়া চৌধুরীর (জাকারিয়া চৌধুরী হলেন সিরাজ সিকদারের ছোটবোন ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় ঢাকাস্থ রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় (বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস, অনুবাদ- মোহাম্মাদ শাজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, চতুর্থ মূদ্রণ-জুলাই ২০০৬)। অনেকের মতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। আবার অন্য তথ্য মতে উনি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন, যখন উনি গ্রেফতার হন গ্রেফতারকারী জানতেন না যে উনি সিরাজ শিকদার। ওই দিনই তাঁকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জনু সিরাজ সিকদার গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান শেখ মহিউদ্দিন আহমদ ও মহাসচিব নাজমুল ইসলাম সাইদ ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয় নি।
  
  
 
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ১০ জুলাই ২০১৬।
 
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ১০ জুলাই ২০১৬।

০৮:৩৯, ১০ জুলাই ২০১৬ তারিখের সংস্করণ

সিরাজ সিকদার (জন্মঃ ২৭ অক্টোবর, ১৯৪৪- মৃত্যুঃ ২ জানুয়ারি, ১৯৭৫) । বাংলাদেশের একজন সাম্যবাদী বিপ্লবী নেতা ছিলেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি তিনি সমমনা কয়েকজনকে নিয়ে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন থেকে পূর্ববাংলা'কে মুক্ত করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা; সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ অভিমূখে যাত্রা করবার লক্ষ্যে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা করা। সিরাজ সিকদার গ্রেফতার হন ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি এবং পরদিন ২ জানুয়ারি গভীর রাতে তাঁকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ১৭ বছর পর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন এই বিষয়ে আদালতে মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনো বিচরাধীন।

প্রাথমিক জীবন

সিরাজ সিকদারের পিতা আবদুর রাজ্জাক সিকদার সার্কেল অফিসার ছিলেন। জন্ম ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সিরাজ সিকদার বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (বর্তমানে এস.এস.সি) পাশ করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে তিনি আই এস সি পাশ করেন। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা শেষ করেন ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। ছাত্র অবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত থেকে প্রত্যক্ষভাবে ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। (সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ঢাকা, এপ্রিল, ২০০৩)। ১৯৬৫ সালে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির কংগ্রেসে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ঐ বছরই তিনি সরকারের নির্মাণ (সি অ্যান্ড বি) বিভাগের কনিষ্ঠ প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মাথায় সরকারি চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি টেকনাফের ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি বেসরকারী কোম্পানীতে যোগদান করেন।

শ্রেণীসংগ্রাম

১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানুয়ারি সিরাজ সিকদার প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে উপস্থিত করেন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের খসড়া থিসিস। এই থিসিসে তিনি পূর্ব বাংলাকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বলে অভিহিত করেন। প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ধারণ করেন বর্তমান সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদীদের জাতীয় দ্বন্দ্ব। থিসিসে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের আহ্বান জানানো হয়। থিসিসে আরো বলা হয়, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বর্তমান বিশ্ব প্রক্রিয়ার কেন্দ্র। ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ার জনগণের প্রধান শত্রু। এ দ্বন্দ্ব বর্তমান এবং এটিই প্রধান দ্বন্দ্ব। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কোপন্থী)কে সংশোধনবাদী পার্টি বলে অভিহিত করে মন্তব্য করা হয়, এই পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সকল মূলতত্ত্বকে সংশোধন করে প্রকৃতপক্ষে শোষক শ্রেণি অর্থাৎ উপনিবেশবাদী, সামন্তবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল হয়ে পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষকদের বিপথে চালিত করছে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের মূল প্রত্যয় ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। সেই লক্ষ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠিত হয়। তারপর ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তিনি ঢাকা শহরে মাও সেতুং গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তান সরকার এটি পরবর্তীকালে বন্ধ করে দেয়। মওদুদীর জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ তাদের পেছনে প্রথম থেকেই লেগে ছিল।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ঐ বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এর চার নাম্বার দফাটি ছিল পূর্ব বাংলার দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করেন। সিরাজ সিকদারের একটি কবিতার লাইনঃ” আর কয়েকটা শত্রু খতম হলেই তো গ্রামগুলো আমাদের; জনগণ যেনো জল, গেরিলারা মাছের মতো সাঁতরায়…/” আজিজ মেহের বলেনঃআমি মনে করি, কমরেড সিরাজ সিকদারের একটি বিপ্লবী আকাঙ্খা ছিলো। কথাবার্তা, চলাফেরা– সবকিছুর মধ্যে ছিলো একটা আকর্ষণীয় ব্যপার। তরুণ ছাত্রকর্মী, যারা বিপ্লবের জন্য ছিলো ব্যাকুল, তারা সহজেই আকৃষ্ট হয়েছিলো। তারা কয়েকটা গেরিলা গ্রুপ করে, কয়েকটি সরকারি অফিসে বোমাবাজী করে, দেয়াল লিখনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। বিশেষ করে সিরাজ সিকদারের থিসিস আকৃষ্ট করেছিলো ছাত্র-তরুণদের।

মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশাল জয়ের মধ্য দিয়ে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত ও বুর্জোয়াদের সংগঠন আওয়ামী লীগ মূল নেতৃত্বে চলে আসে। তবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে থাকে। এ সময় সংগঠনের পক্ষ থেকে সিরাজ সিকদার শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে লেখা খোলা চিঠির সংক্ষিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ:

১. পূর্ব বাংলার নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এবং সংখ্যাগুরু জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করুন। ২. পূর্ব বাংলার কৃষক-শ্রমিক, প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি-সংবলিত স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার কায়েম করুন। ৩. পূর্ব বাংলাব্যাপী এ সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানান। এ উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠন এবং শহর ও গ্রামে জাতীয় শত্রু খতমের ও তাদের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের আহ্বান জানান। ৪. পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার জন্য শ্রমিক-কৃষক এবং প্রকাশ্য ও গোপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে 'জাতীয় মুক্তি পরিষদ' বা 'জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট' গঠন করুন। ৫. প্রকাশ্য ও গোপন, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র, সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। (এরপর ৬ নম্বর পয়েন্টে শ্রমিক আন্দোলনের খোলা চিঠিতে ১৩টি করণীয় নির্ধারণ করে। এর মধ্যে গ্রামাঞ্চলে জমি বণ্টন, শ্রমিকদের শ্রম শোষণ বন্ধ, ভাষাগত, ধর্মীয়, জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম-অধিকার দেওয়ার বিধানসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা হাজির করে)।

তবে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন শ্রমিক আন্দোলনের এই খোলা চিঠি আমলে আনেননি।

তবে মুজিবনগর সরকার ১৭ এপ্রিল শপথ নেওয়ার পর সেই সরকারের প্রতি আরেকটি খোলা চিঠি দেন সিরাজ শিকদার। সেখানে যুদ্ধের ময়দানে করণীয় বিষয়ে তুলে ধরা হয়। তবে এবারও প্রবাসী সরকার শ্রমিক আন্দোলনের সেই চিঠিতে কর্ণপাত করেনি।১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার পর সিরাজ সিকদার বরিশালের পেয়ারা বাগানে ৩০ এপ্রিল তারিখে গড়ে তোলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনী। ৩ জুন পার্টির নতুন নাম দেয়া হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে সর্বহারা পার্টি দলের গেরিলাদের নির্দেশ দেয় পাকস্তানী বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করতে। কারণ সিরাজ সিকদার পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী, ভারতকে আধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। বরিশাল থেকে শুরু করে দেশের কয়েকটি উপকূলীয় অঞ্চল–বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ জেলা, পাবনা, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় সর্বহারা পর্টির গেরিলারা পাক-বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে সর্বহারা পার্টির বহু সদস্য নিহত হয়েছিলো।

১৯৭১ সালের ১-৩ জুন যুদ্ধের ময়দানে পেয়ারা বাগানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তৈরি হয়। বরিশালের পেয়ারা বাগানকে বেছে নেওয়া হয় পার্টির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর জন্য। এর আগে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পার্টিগুলোর নাম সবই মোটামুটি কমিউনিস্ট পার্টি বা এর কাছাকাছি নাম রাখে; কিন্তু সিরাজ সিকদার প্রলেতারিয়েতের বাংলা সর্বহারার নামে নামকরণ করেন পার্টির। সর্বহারা পার্টি গঠনের ওই দিনে বরিশালের পেয়ারা বাগানে উপস্থিত ছিলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফজলুল হক রানা। কালের কণ্ঠকে তিনি সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে বলেন, 'বরিশালের পেয়ারা বাগানে সেদিন লাখ লাখ মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। মনে হয়েছিল পেয়ারা বাগান যেন কোনো মুক্তাঞ্চল। এখানে নারী-পুরুষ যে এক নতুন পৃথিবীর জন্মের আগে সমবেত হয়েছে নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য।'

বরিশালের বানারীপাড়া অঞ্চলে অবস্থান নেয় শ্রমিক আন্দোলন, ৩০ এপ্রিল গঠন করে জাতীয় মুক্তিবাহিনী, যা দখলমুক্ত করে পেয়ারা বাগানের খানিকটা। এ মুক্তিবাহিনী পরিচালনা করতে সিরাজ সিকদারকে প্রধান করে সর্বোচ্চ সামরিক পরিচালনামণ্ডলী গঠন করা হয়। বরিশালের পেয়ারা বাগান স্বাধীনতাসংগ্রাম চলার সময় প্রথম ঘাঁটি ও মুক্তাঞ্চল। এ বিষয়ে সর্বহারা পার্টির তৎকালীন বৃহত্তর বরিশাল (বরিশাল, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, ঝালকাঠি ও পিরোজপুর) অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদক রইসউদ্দিন আরিফ (পরবর্তী সময়ে সিরাজ সিকদার নিহত হলে অস্থায়ী সর্বোচ্চ বিপ্লবী সংস্থার সভাপতি) কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বরিশালের পেয়ারা বাগান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে প্রথম ঘাঁটি ও মুক্তাঞ্চল। এ অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক বড় অপারেশন চালাতে হয়েছিল। আবার সর্বহারা পার্টি পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। সর্বহারা পার্টি এ অঞ্চলে অজস্র সফল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর।' এছাড়াও ১৯৭০ সালের মে এবং অক্টোবর মাসে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের গেরিলারা ঢাকাস্থ পাকিস্তান কাউন্সিল, বিএনআর ভবন, এবং মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে যে বোমা হামলা পরিচালনা করেছিল, সেটি ছিলো পাকিস্তানি উপনিবেশবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সশস্ত্র হামলা।

বরিশাল অঞ্চলে অসংখ্য সফল হামলা চালিয়ে সর্বহারা পার্টি পাকিস্তানি বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে।

ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সর্বহারা পার্টির সতর্কবাণী

১৯৭১-এ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপে দ্রুত বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ভারতীয় বাহিনীর এই তৎপরতাকে সাদা চোখে দেখেনি সর্বহারা পার্টি। পার্টি মনে করে, পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে দেশ এবার ভারতীয় উপনিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়েছে। এ সময় নতুন বাংলাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার প্রশ্নে সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশের সরকারের প্রতি একটি খোলা চিঠি লেখে। ওই চিঠিতে বলা হয়, ভারতীয় সৈন্যদের অনতিবিলম্বে সরিয়ে নেওয়া, যুদ্ধের সৈনিকদের দিয়ে নৌ, আকাশ ও স্থলবাহিনী তৈরি করা, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং তাদের বিচার নিশ্চিত করা, সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃত্বে জাতীয় বিপ্লবী সরকার গঠনসহ ২৭টি দাবি পেশ করা হয়।

একাত্তর-এর পর

একাত্তর এর পর সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ হিসেবে উল্লেখ করে "পূর্ব বাংলার বীর জনগণ, আমাদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয় নি, পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান" নামক একটি রাজণৈতিক দলিল হাজির করেন। যেখানে আওয়ামীলীগকে জাতীয় বিশ্বাস ঘাতক ও বেঈমান হিসেবে উল্লেখ করে তাদের কে ছয় পাহাড়ের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৬ ডিসেম্বরকে কালো দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এ এই দিনে দেশব্যাপী হরতাল পালন করা হলে মাওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে তা সমর্থন করেন।

মৃত্যু

কী অবস্থায় সিরাজ সিকদার পুলিশের হাতে শেষ পর্যন্ত আটক হন, এবং ঠিক কখন কোথায় কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয় সে সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়েছে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস বলছেনঃ সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। জাকারিয়া চৌধুরীর (জাকারিয়া চৌধুরী হলেন সিরাজ সিকদারের ছোটবোন ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় ঢাকাস্থ রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় (বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস, অনুবাদ- মোহাম্মাদ শাজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, চতুর্থ মূদ্রণ-জুলাই ২০০৬)। অনেকের মতে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের হালিশহরে সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। আবার অন্য তথ্য মতে উনি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন, যখন উনি গ্রেফতার হন গ্রেফতারকারী জানতেন না যে উনি সিরাজ শিকদার। ওই দিনই তাঁকে বিমানে ঢাকায় আনা হয়। পরদিন শেরেবাংলা নগর থেকে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে হত্যা করে। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর ১৭ বছর পর ১৯৯২ সালের ৪ জনু সিরাজ সিকদার গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান শেখ মহিউদ্দিন আহমদ ও মহাসচিব নাজমুল ইসলাম সাইদ ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করেন। এই মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয় নি।


তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ১০ জুলাই ২০১৬।