সাতুরিয়ার জমিদার মিয়া পরিবার

Barisalpedia থেকে

সেলিমাবাদ পরগণার তালুকের মধ্যে কীর্তিপাশা ও রাজাপুরের সাতুরিয়া তালুক অন্যতম ছিল। হজরত খানজাহান আলীর সহচর হজরত সাজেন্দার বংশধর শেখ শাহাবুদ্দিন ছিলেন এই তালুকদারির প্রতিষ্ঠাতা। এ পরিবারের সবচেয়ে কৃতিত্বময় ব্যক্তিত্ব ছিলেন সৈয়দা মেহেরুন্নেছা যিনি সাতুরিয়ায় ইংরেজি স্কুল, পোস্ট অফিস ও রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন এবং এছাড়াও বরিশাল সদর হাসপাতালের জন্য জমি দান করেছিলেন।


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

সাতুরিয়া মিয়াদের পূর্বপুরুষ হজরত সাজেন্দা বাগেরহাটের হাবেলী গ্রামে বাস করতেন। সাতুরিয়ার মিয়া পরিবারের জনাব মতিয়ুর রহমান ও তৈয়ফুর হোসেন যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যায় শাহাবুদ্দিন আরব হতে দিল্লী হয়ে বাগেরহাটে আসেন। ১৮ শতকের শেষভাগে শাহাবুদ্দিন সাতুরিয়ার বসতি স্থাপন করেন। রায়েরকাঠির জমিদার প্রাণ নারায়ণের মৃত্যুর পর শিশুপুত্র মহেন্দ্র নারায়ণ জমিদারী হারায়। কথিত আছে শেখ শাহাবুদ্দিন রানীমাতা ও মহেন্দ্রকে মুর্শিদাবাদ নবাবের নিকট নিয়ে যান এবং জমিদারী উদ্ধার করতে সমর্থ হন। এ কথার ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় না। কারণ ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় শেখ শাহাবুদ্দিনের আবির্ভাবকাল মহেন্দ্র নারায়ণের প্রায় ১৫০ বছর পূর্বে। তবে এ কথা ঠিক শাহাবুদ্দিন রায়েরকাঠির কোন রাজার জমিদারী কার্যে সহায়তা করে রাজার সন্তুষ্টি লাভ করেছিলেন যে জন্য রাজা তাকে খারিজা তালুক প্রদান করেন। বাকলা গ্রন্থের প্রণেতা রোহিনী কুমার সেন লিখেছেন “সাতুরিয়া মিঞাগণের পূর্ব পুরুষ সেখ সাহাবুদ্দিন রায়েরকাঠিতে চাকরি করিতেন। ক্রমে ক্রমে তিনি রাজ সরকার হইতে কতক তালুকপ্রাপ্ত হইয়া সুক্তাগড় নামক স্থানে বাস করিতে আরম্ভ করেন।” খোসাল চন্দ্র রায় লিখেছেন “[সাজেন্দার] বংশীয় সেখ সাহাবুদ্দিন নামে একজন আওলিয়া (ফকির) রায়েরকাঠির চৌধুরীগণ কর্তৃক কতক চেরাগি ও তালুকাদি প্রাপ্ত হইয়া এই সাতুরিয়া গ্রামের ৫ মাইল পূর্বে সুক্তাগড় নামক পল্লীতে বাস করেন।”


বংশলতিকা

বংশলতিকায় শেখ শাহাবুদ্দিনের পূর্বপুরুষ সাজেন্দা পর্যন্ত সিলসিলা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পূর্বপুরুষগণের মধ্যে ধারাবাহিকতা রেখে সর্বপ্রথম যে পুরুষের নাম জানা গেছে তিনি শেখ ফুল। শেখ ফুল হযরত সাজেন্দার কততম অধস্তন পুরুষ তা আমরা জানি না। শেখ ফুলের পুত্র শেখ নূর, তাঁর পুত্র শেখ মহব্বত তকী, তাঁর পুত্র শেখ জালাউদ্দীন, তাঁর পুত্র শেখ শাহাবুদ্দিন (তালুকদারির প্রতিষ্ঠাতা)। শেখ শাহাবুদ্দিনের ৯পুত্র ও ২ কন্যা: শেখ নাজিম উল্লাহ, শেখ আজিম উল্লাহ, শেখ বোরহান উল্লাহ, শেখ হাবিব উল্লাহ, শেখ বরকত উল্লাহ, শেখ কুদরত উল্লাহ, শেখ মতি উল্লাহ, শেখ শফি উল্লাহ, শেখ বাবর উল্লাহ, রহিমা বিবি ও খোদেজা বিবি। শেখ শাহাবুদ্দিনের প্রথম সন্তান শেখ নাজিম উল্লাহর পুত্রগণ: দ্রাজাতুল্লাহ ওরফে ধন মিয়া (শ্রী খোসাল চন্দ্র রায় ও রোহিনী কুমার সেন তাদের বইয়ে তার নাম দ্রোহতুল্লাহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন), শরফ উল্লাহ, ইজ্জতুল্লাহ, এনায়েত উল্লাহ ও মেহের উল্লাহ। দ্রাজাতুল্লাহর পুত্র আব্দুল গফুর মিয়া (গফুর মিয়ার স্ত্রী ছিলেন মেহেরুন্নেছা)। গফুর মিয়ার কন্যা শামসুন্নেছা (শায়েস্তাবাদের সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ ওরফে নওশীন মিয়ার স্ত্রী)।

দ্রাজাতুল্লাহর দ্বিতীয় ছেলে শরফ উল্লাহ মিয়ার কন্যা ছিলেন জমিলা খাতুন। শেখ শাহাবুদ্দিনের ৯ পুত্রের মধ্যে ৪র্থ পুত্র হাবিব উল্লাহ সাহেবের অধস্তন পুরুষদের একজন আহমদ আলী মিয়া বিবাহ করেছিলেন শরফুল্লাহ মিয়ার কন্যা জমিলা খাতুনকে। আহমদ আলী ও জমিলা দম্পতির তিন সন্তান আব্দুল হামিদ, আজিজুন্নেসা ও সৈয়দুন্নেসা। উক্ত সৈয়দুন্নেসার ছেলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। শেখ শাহাবুদ্দিনের প্রথম পুত্র শেখ নাজিম উল্লাহর ৪র্থ পুত্র এনায়েত উল্লাহর পুত্র ছিলেন শেখ আব্দুল আজিজ মনসুর মিঞা। আব্দুল আজিজ মনসুর মিঞার মেয়ে মেহেরুন্নেছা (সমগ্র মিঞা বংশের মাঝে উজ্জ্বলতম ব্যক্তি)।

শেখ শাহাবুদ্দিনের ৪র্থ পুত্র শেখ হাবিব উল্লাহর ২ পুত্র: ওমর বকশ ও শেখ আলী বকশ। ওমর বকশের পুত্র কুদু বকশ, তাঁর পুত্র আজিজ মিয়া, তাঁর পুত্র মুহাম্মদ ইসহাক মিয়া, তাঁর পুত্র শহীদ মুহাম্মদ ইয়াকুব ও তৈফুর হোসেন। শহীদ মুহাম্মদ ইয়াকুবের পুত্র লেনিন। শেখ হাবিব উল্লাহর ২য় পুত্র শেখ আলী বকশের পুত্র শেখ নাদের বকশ, তাঁর পুত্র আবদুল আজিজ, তাঁর পুত্র মুহাম্মদ হোসেন, তাঁর পুত্র আবুজান মনসুর মিয়া, তাঁর পুত্র মালেক মিয়া, তাঁর পুত্র মতিয়ুর রহমান মিয়া।


গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ

শেখ শাহাবুদ্দিন: শাহাবুদ্দিন রায়েরকাঠির রাজদরবারের একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি একই সাথে একজন জমিদার ও আধ্যাত্মিক সাধক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৬২৮ সালে এবং মৃত্যু ১৭৪৫ সালে। তিনি ১১৭ বছর জীবিত ছিলেন। তার মাজারের শিলালিপি ও প্রাচীন কাগজপত্রে তার জন্ম ও মৃত্যু তারিখ পাওয়া যায়। তিনি কিছুদিন পিরোজপুরে ছিলেন। তিনি ফরিদপুরের গোট্টীর সৈয়দ পরিবারে বিয়ে করে রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ঢাকার মিরপুরে শাহ আলী বোগদাদীর যে মাজার রয়েছে তিনিও গিরদা-গোট্টির এই পরিবারের সদস্য। শেখ শাহাবুদ্দিন সাহেবের স্ত্রী ছিলেন তিন জন। প্রথম স্ত্রীর সন্তানগণ রাজাপুরস্থ সাতুরিয়ার মিয়াবাড়ি বলে পরিচিত বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরুকরেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তানগণ কাউখালীর পাড় সাতুরিয়ায় স্থায়ী হন। তৃতীয় স্ত্রীর সন্তানদেরকে নিয়ে জনাব শেখ শাহাবুদ্দিন শুক্তাগড়ে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন যেখানে এখন তাঁর মাজার বিদ্যমান। দ্রজাজাতুল্লাহ: জনাব শেখ শাহাবুদ্দিনের নাতি দ্রাজাতুল্লাহ ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। এই দ্রাজাতুল্লাহ ওরফে ধন মিঞার প্রতিপত্তির কথা খোসাল চন্দ্র রায় তাঁর ‘বাকরগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেনে এবং রোহিনীকুমার সেন তাঁর বাকলা গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।

মেহেরুন্নেছা: ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে সাতুরিয়ায় পোস্ট অফিস, স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের প্রতিষ্ঠাতা । জন্ম: ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ। পিতা: আব্দুল আজিজ মনসুর মিয়া। পিতামহ: এনায়েত উল্লাহ। প্রপিতামহ: নাজিম উল্লাহ। প্রপিতামহের পিতা: শেখ শাহাবুদ্দিন। স্বামী: গফুর মিয়া। স্বামী গফুর মিয়া ছিলেন মেহেরুন্নেছার পিতামহ এনায়েত উল্লাহর ভাই দ্রাজাতুল্লাহর পুত্র। ফলত গফুর মিয়া ছিলেন তার চাচা সম্পর্কের। স্বামীর মৃত্যুতে মেহেরুন্নেছা স্বামীর সম্পত্তি ও পিতার সম্পত্তির যোগফল রূপে বিশাল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। মেহেরেুন্নেসার জনহিতৈষণা ও প্রতিপত্তির কথা রোহিনীকুমার সেন তাঁর বাকলা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন- “বর্তমান সময়ে বিবি মেহেরুন্নেছা খাতুনের নাম বিশেষ বহু লোকের আশীর্বাদের পাত্র হইয়াছেন। ইহার যতেœ ও অর্থব্যয়ে সাতুরিয়ায় পোস্টাফিস, স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি স্থাপিত হইয়াছে” (দে’জ পাবলিশিং প্রকাশিত বৃহত্তর বাকরগঞ্জের ইতিহাস ১৬৮)। পরিমাণে ইহা মাত্র দুটি বাক্য হলেও ইহা একটি বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থের উদ্ধৃতি যা প্রমাণ করে যে মেহেরুন্নেছা হলেন রাজাপুরের সেই বিখ্যাত মহীয়সী নারী যিনি ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে রাজাপুরে প্রথম স্কুল, পোস্ট অফিস এবং দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। জনাব পল্টু উল্লেখ করেছেন যে মেহেরুন্নেছার উদ্যোগে সাতুরিয়ায় সাহেবের রাস্তা নামে একটি রাস্তা নির্মিত হয়েছিল (৫৮)। বরিশাল সদর হাসপাতালের জন্য তিনি জমি ও অর্থ প্রদান করেছিলেন এবং একটি ওয়ার্ড তাঁর ব্যয়ে নির্মি ত হয়েছিল। মেহেরুন্নেছার সময়ে সাড়ে সাত হাজার বিঘার তালুক পূর্বতন তালুকদারির সাথে যোগ হয় বলে রেজাউল কবীর পল্টুর বক্তব্য থেকে অনুমিত হয় (৫৬)।

তিনি তার মেয়ে শামসুন্নেসাকে বিয়ে দিয়েছিলেন দক্ষিণ বঙ্গের সবচেয়ে বিখ্যাত মুসলিম জমিদার পরিবার অর্থাৎ শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের সন্তান সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ চৌধুরী ওরফে নওশীন মিয়ার সাথে। সাতুরিয়ার মিঞা বংশের এই মহীয়সী নারীর স্মৃতিতে পরবর্তীতে শেরে বাংলার সহযোগিতায় জলিল মিঞা, আজাহার মিয়া ও আক্তার মিয়ার উদ্যোগে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সাতুরিয়া মেহেরুন্নেছা মেমোরিয়াল (এম. এম.) উচ্চ বিদ্যালয়।

মুহাম্মদ ইয়াকুব: মুহাম্মদ ইসহাক মিয়ার পুত্র মুহাম্মদ ইয়াকুব শেরে বাংলার ব্যক্তিগত সচিব ও একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী তাকে হত্যা করে।

জমিদারির আওতা

খারিজা তালুক লাভের পরে ক্রমান্বয়ে তালুকদারির সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতায় এক সময়ে সাতুরিয়ার মিয়াদের তালুকদারি ছিল বাগেরহাটের কচুয়া, চিতলমারী, আন্ধারমানিক, রঘুনাথপুর, মাটিভাঙ্গা, পাটগাতী, দেপাড়া, পাঁচপাড়া, শাবুখালী, বগা, শিয়ালকাঠী, ভ্রমরগাতি, ধোপাখালী, গজালিয়া; পিরোজপুরের ভাদুরা শংকরপাশা, কুমারমারা, হরিণাগাতী, হরিনাভট্টাচার্য, ডুমুরতলা, বাইনখালী, কেশোতা; এবং রাজাপুরের বারকাকপুর, নারিকেলবাড়িয়া, মনোহরপুর, কৈবর্তখালী, ফুলুহার, উত্তর তারাবুনিয়া প্রভৃতি স্থানে।


তথ্য উৎস: ১. তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০। ২। মুহম্মদ মুহসিন। চরিতাভিধান: রাজাপুরের গুণী ও বিশিষ্টজন। নালন্দালোক, ঢাকা। ২০১০।