সাইয়েদুল আরেফিন (র.)

Barisalpedia থেকে

বরিশাল অঞ্চলে আগত প্রথম সুফী-সাধক ও ইসলাম প্রচারক। পূর্ণ নাম সুলতান-উল-আউলিয়া হযরত সাইয়েদুল আরেফিন। কথিত আছে তৈমুরলঙ্গের ভারত আক্রমণের সময় (১৩৯৮ খৃঃ) হযরত সায়েদুল আরেফিন বাকলা বন্দরে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন। কিন্তু তার আগমনের সঠিক তারিখ আমাদের জানা নেই। মিঃ বেভারিজ ও জে.সি জ্যাক বলেছেন হযরত অরেফিন ১৭ শতকে বাকলা নগরে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কিন্তু তারা কিংবদন্তি বা লোকমুখে শুনে হযরত আরেফিনের বাকলা আগমনের তারিখ অনুমান করেছেন।


ঐতিহাসিক সময়কাল

বেশিরভাগ গবেষকের মতে হজরত সাইয়েদুল আরেফিন দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় মোহাম্মদ তুঘলকের রজত্বকালে (১৩৮৮-১৪১৪ সাল) চন্দ্রদ্বীপে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরলঙ্গের ভারত আক্রমণের সময় হযরত সাইয়েদুল আরেফিন মধ্যপ্রাচ্যে হতে সমুদ্রপথে বাকলা বন্দরে আসেন। খুব সম্ভব আরবীয় বা পারস্যের বণিকদের সাথে তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম থেকে চন্দ্রদ্বীপে আসেন। স্থানীয় প্রবাদ যে, তিনি পাথরের ওপর ভেসে চন্দ্রদ্বীপে আসেন। ১৫ ও ১৬ শতকে বাংলাদেশে অনেক সূফী-সাধক ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে অসেন। সিলেটের হযরত শাহজালাল, বাগেরহাটের হজরত খানজাহান, গৌড়ের নূর-কুতুব-উল-আলম, উত্তরবঙ্গের শাহ মখদুম ও বাকলার সাইয়েদুল আরেফিন ইসলাম ধর্ম প্রচার করে বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।


কিংবদন্তী বা কাব্যকাহিনী

সাইয়েদুল আরেফিন হজরত শাহজালালের সাথী ছিলেন। হজরত শাহজালাল ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে জান্নাতবাসী হন। স্থানীয় লোকের মতে সাইয়েদুল আরেফিন বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। বাকলা আগমনের পর চন্দ্রদ্বীপের রাজা তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। তৎকালীন যুগে ইসলাম ধর্ম প্রচারক পীর-দরবেশগণ রাজদরবারে সম্মানিত হতেন। তাদের নিষ্কর বা লাখেরাজ ভূমি প্রদান করা হতো। হজরত আরেপিন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে বিভিন্ন স্থানে ধর্ম প্রচার করেন। তাঁকে নিয়ে এ অঞ্চলে অনেক কাব্যকাহিনী প্রচলিত আছে, তার একটি থেকে চয়িত কিছু অংশ:

“দরবেশ নিয়ে এ অঞ্চলে দূর বাগদাদ হতে

নদীর বক্ষে শীলায় বসিয়া নামেন কালিসূরী তটে

ঘাটে ছিল সূরীর কন্যা নাম ছিল তার কালী

তন্ডুল ধুইতে এসেছিল কালি ঘাটে পীর দেখে কৌতূহলী।

কালির কাছে বলেন সৈয়দ আরেফিন।

জলদি খানা দাও ক্ষুধার্ত আমি বিদেশী হেথা অচেনা

খানা কোথা পাবো তন্ডুল কাচা যে, পীর হাসি বলেন পাত্র দেখ চেয়ে

অন্ন আছে হেথায়, একি? সুপক্ক অন্ন বিস্ময় হলো বালা

মনে ভাবে বালা ইহা দেবতার ছলা

সাইদুল পদে অনুগতা কালী জাতিতে তিনি শুরী

স্মরণীয়া হলো সেদিন হতে নাম তাই কালিশুরী

দরগা বসান দরবেশ তথা বটবৃক্ষ তলে

শাসকবর্গ খাদেম হলেন পীরের চরণতলে।”

এ কহিনী আরো ভিন্নভাবেও প্রচলিত আছে। যেমন, বলা হয় হজরত আরেফিন নামাজের চাদরের উপরে বসে কালাইয়া নদী অতিক্রম করছিলেন। নদীর ঘাটে একটি হিন্দু মেয়ে ভাগ রান্নার জন্য চাল ধৌত করছিলেন। হজরত আরেফিন মেয়েটির নিকট ভাত খেতে চান। মেয়েটি বলল, তিনি হিন্দু হয়ে মুসলামানের জন্য কি করে ভাত পাক করবেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পাত্রের চাল হঠাৎ ভাত হয়ে গেল। মেয়েটি এ অলৌকিক ঘটনা দেখে দরবেশের নিকট ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। মেয়েটির নাম ছিল কালি এবং তার মায়ের নাম ছিল শুরী। শুরীর মেয়ে কালি এবং তা থেকে গ্রামের নাম হলো কালিশুরী। সাইয়েদুল আারেফিন কালিশুরী ধর্ম প্রচারের কেন্দ্র স্থাপন করেন। অনেকে বলেন তিনি কালিকে বিবাহ করেছিলেন। আবার কেউ বলেন কালি তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কালির মৃত্যুর পরে তাকে সাইয়েদুল আরেফিন খানকার নিকট কবর দেয়া হয়। তার স্মরণে উক্ত মাজারের নিকট প্রত্যেক বছর অগ্রহায়ণ মাসে এক মাসব্যাপী মেলা বসত। এ মেলা কালিশুরী মেলা নামে বিখ্যাত ছিল।

কীর্তি

হজরত সাইয়েদুল আরেফিন একজন বিখ্যাত সূফী ছিলেন। তার আহবানে শত শত স্থানীয় অমুসলমান ইসরাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার সাথে বাগদাদ থেকে কয়েকজন ভক্ত এসছিলেন। তার মৃত্যুর পর তাকে কালিসূরীতে কবর দেয়া হয়। তার মাজারকে কেন্দ্র করে কালিশুরীর ইসলাম ধর্ম প্রচার কেন্দ্ররূপে দক্ষিণ পূর্ববঙ্গে খ্যাতি অর্জন করে। বাকলা বন্দরে দেশী-বিদেশী বণিকেরা বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য নিয়ে আসত। কালিশুরী মেলায় এ পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ পেত। কালিশুরী মাজার ও মেলা শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্র নয়। মাজারে হাজার হাজার হিন্দু মুসলমানের সমাবেশ হতো। হিন্দুরা মাজারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। একজন দরবেশের পাশে হিন্দু মহিলার মাজার। এ মাজারকে উপলক্ষ করে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি হয়। এ মাজারে কয়েক শ’ বছরের একটি প্রাচীন বটগাছ ছিল। এ গাছটিকে অনেক হিন্দু ভক্তি করত। আরব দেশ থেকে আগত মাওলানা মাদানী একদল মুসলমানকে উত্তেজিত করে ১৯৪৭ সালে এই ঐতিহাসিক বটবৃক্ষটিকে কেটে ফেলেন। মাওলানা মাদানী ১৯৭১ সালে মুন্সীগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন।

সাইয়েদুল আরেফিন দীর্ঘদিন ধরে চন্দ্রদ্বীপে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। তার মৃত্যুর পর তার ভক্তগণ মাজারকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। দিল্লির সম্রাটের নির্দেশে চন্দ্রদ্বীপের রাজা মাজারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করেন। তার ভক্তরা এ সম্পত্তি ভোগ করত। কালিসূরী গ্রামে সাইয়েদুল আরেফিনের মাজারে ৩৬০ ঘর খাদেম ছিলেন। তারা দাবি করেন যে, তাদের পূর্ব পুরুষরা হজরত আরেফিনের সাথে বাগদাদ হতে চন্দ্রদ্বীপে আসেন। বাউফল থানার গুসিঙ্গার মুন্সী বাড়ীর শাহ শাহদাদ খাদেমদের বংশধর। আজও বরিশালের প্রথম ইসলাম ধর্ম প্রচারক সাইয়েদুল আরেফিনের মাজার শত শত ভক্তদের চিত্তদুয়ারে শান্তির বাণী পৌঁছে দেয়।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (প্রথম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।