সনাতন গোস্বামী

Barisalpedia থেকে

সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় কয়েকজন প্রতিভাশালী পন্ডিতকে তার সভায় উচ্চপদ প্রদান করেন। এ পন্ডিতদের মধ্যে চন্দ্রদ্বীপ-বাকলার রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামী অন্যতম ছিলেন।


পূর্ব পুরুষ

সনাতন গোস্বামীর পূর্ব পুরুষ জগতগুরু কর্ণাট প্রদেশের ভরদ্বাজ গোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ রাজা ছিলেন। এই রাজার এক অধস্তন পুরুষ কুমারদেব পীরালিদের ভয়ে নৈহাটী ছেড়ে দনুজমর্দন প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে চলে আসেন । আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিঃ কুমারদেব বাকলায় বসতি স্টথাপন করেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজা তাকে ভূমি প্রদান করেন।

জন্ম ও শিক্ষা

বাকলায় কুমার দেবের অমর, সন্তোষ ও বল্লভ নামে তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। শ্রী চৈতন্যদেব তাদের তিন ভাইয়ের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ ও শ্রীঅনুপম রেখেছিলেন এবং সে নামেই আজও তারা পরিচিত। শ্রীসনাতন বাকলায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে গৌড়ের রামকেলিতে চলে যান। মুকুন্দ দেবের মৃত্যুর পর তিন ভ্রাতা সুলতানদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে তারা পদোন্নতি লাভ করেন। সনাতন দবিরখাস অর্থৎ প্রধান সচিব পদে বৃত হন।


চাকুরি লাভের কিংবদন্তী

গৌড়ের সুলতানের দরবারে সনাতন গোস্বামীর এতবড় চাকুরি লাভের পিছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক কিংবদন্তী। এই কিংবদিন্ত থেকে জানা যায় যে সুলতান ফিরোজ শাহ তাঁর নির্মিত বিখ্যাত ফিরোজ মিনারটি প্রথমে একজন রাজমিস্ত্রিকে দিয়ে তৈরি করান। তৈরি শেষ হয়েছে শুনে সুলতান এটি দেখতে গেলেন এবং চূড়ার ওপর উঠলেন। রাজমিস্ত্রি তখন তাঁর সামনে এসে গর্ব করে বললো- ‘এর চেয়েও অনেক উঁচু মিনার আমি তৈরি করতে পারতাম’। সুলতান বললেন- ‘তাহলে তাই করলে না কেন?’ রাজমিস্ত্রি বললো- ‘আমার কাছে এত মালমশলা ছিল না’। সুলতান বললেন- ‘ছিল না তো আমার কাছে গিয়ে চাইলে না কেন?’ রাজমিস্ত্রি এর কোনো উত্তরই দিতে পারলো না। সুলতান তখন রেগে আগুন হয়ে আদেশ দিলেন রাজমিস্ত্রিকে ধরে মিনারের চূড়া থেকে ফেলে দিতে। মুহূর্তের মধ্যেই তাঁর আদেশ পালিত হলো।

এভাবে রাজমিস্ত্রি প্রাণ হারালো। এদিকে সুলতান চূড়া থেকে নেমে এসে তাঁর প্রিয় ভৃত্য হিঙ্গাকে আদেশ দিলেন তখনি মোরগাঁওয়ে যেতে। হিঙ্গা তৎক্ষনাৎ মোরগাঁও নামক গ্রামের দিকে রওয়ানা হলো, কিন্তু মোরগাঁওয়ে কেন যেতে হবে তা সে কিছুই বুঝতে পারলো না। রাজা তখন এত রেগে রয়েছেন যে রাজাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতেও তার সাহস হলো না। মোরগাঁওয়ে পৌঁছে হিঙ্গা গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলো কী কাজের জন্য তাকে এখানে পাঠানো হতে পারে। কিন্তুু অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে সে অনেক উদ্বেগের সাথে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে তার সাথে এই সনাতন নামের ব্রাহ্মণ যুবকের সাথে দেখা হয়ে গেলো। হিঙ্গা তখন ভাবলো এর সঙ্গেও একটু পরামর্শ করে দেখা যেতে পারে- যদি কোনো সুরাহা হয়। এই ভেবে সে সনাতনকে তার সমস্যার কথা খুলে বললো। সনাতন জানতে চাইলো মিনার থেকে তার রওয়ানা হবার অব্যবহিত আগে কী কী ঘটনা ঘটেছিলো। হিঙ্গা সবই গোড়া থেকে বললো। সব শুনে সনাতন বললো- ‘তাহলে সুলতান তোমাকে নিশ্চয়ই পাঠিয়েছেন মোরগাঁও থেকে ভালো ভালো রাজমিস্ত্রি নিয়ে যেতে’। হিঙ্গাকে মোরগাঁওয়ে পাঠানোর কারণ মোরগাঁওয়ের রাজমিস্ত্রিদের খুব খ্যাতি ছিল। ব্যাখ্যাটা হিঙ্গার মনে ধরলো। সে মোরগাঁও থেকে খুব সুদক্ষ কয়েকজন রাজমিস্ত্রি নিয়ে সুলতানের কাছে গেলো।

সুলতানের মেজাজ ততক্ষণে ঠান্ডা হয়েছে। তিনি তখন ভাবছিলেন- ‘তাই তো! হিঙ্গাকে কী করতে হবে তা না বলেই মোরগাঁওয়ে পাঠালাম’। এমন সময় হিঙ্গা তাঁর সামনে মোরগাঁওয়ের রাজমিস্ত্রিদের নিয়ে এসে হাজির। সুলতান তো অবাক। হিঙ্গা তার মনের কথা কী করে জানলো? হিঙ্গা সমস্ত খুলে বললো। বোঝা গেল তীক্ষ্ণবুদ্ধি সনাতনের পরামর্শেই তার পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব হয়েছে। সুলতান শুনে বিস্মিত হলেন এবং সনাতনকে ডাকিয়ে এনে রাজদরবারের খুব উঁচু একটি পদে নিয়োগ করলেন। হিঙ্গা যেসব রাজমিস্ত্রি নিয়ে গেলো তাদের দিয়ে সুলতান মিনারের উচ্চতা আরো বাড়িয়ে মিনার নির্মাণ সমাপ্ত করলেন। সুখময় মুখোপাধ্যায় লিখেছেন গল্পটি মালদহ জেলা এবং সন্নিহিত অঞ্চলের লোকদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এখনো ভালো করে না বুঝিয়ে কেউ কোনো হুকুম করলে ঐ অঞ্চলের লোকেরা ব্যঙ্গ করে বলে- ‘এ যে দেখছি হিঙ্গা তুই মোরগাঁওয়ে যা’।

দেখা যাচ্ছে সনাতনের রাজদরবারে পদপ্রাপ্তি এমন একটি আকস্মিক ঘটনার মাধ্যমে ঘটেছিলো। কিন্তু সনাতন যেভাবেই রাজদরবারে প্রবেশ করুক সেখানে তিনি অতুুলনীয় ধীশক্তি ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন বলেই তিন বছরের হাবশী সুলতান ফিরোজ শাহের সময়ে নিয়োগ পাওয়া এই লোক পরবর্তীতে বিচক্ষণতম সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের দরবারে মন্ত্রীর মর্যাদায় পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি তাঁর ভাই রূপ গোস্বামীকে এবং ভ্রাতুষ্পুত্র জীব গোস্বামীকেও গৌড়ের সুলতানদের দরবারে অতি উঁচু পদে চাকুরি দিয়েছিলেন।

ধর্ম ও দীক্ষা

১৫১৩ খ্রিঃ গৌড়ে শ্রীচৈতন্য দেবের সাথে রূপ ও সনাতনের সাক্ষাৎ হয়। ১৫১৪ সালে সনাতন এবং ১৫১৫ খ্রিঃ রূপ রাজসভা ত্যাগ করে শ্রীচৈতন্যের নিকট চলে যায়। চৈতন্যের দর্শন লাভের পর সনাতন যখন রাজসভা পরিত্যাগ করতে চাইলেন তখন সুলতান হোসেন শাহ তাকে তিরস্কার করলেন।

রূপ ও সনাতনের শাস্ত্রজ্ঞান ছিল অপরিসীম। উভয় ভ্রাতা ৪০ বছরের বেশি মথুরা, বৃন্দাবন ও কাশীধামে ধর্ম সাধনা ও শাস্ত্র চর্চায় অতিবাহিত করেন। তারা যেমন পন্ডিত তেমনি সর্বত্যাগী বৈষ্ণব ভক্ত সন্যাসী ছিলেন। তারা কাশীধামে শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপা লাভ করেন। জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল রুপ-সনাতনের ভক্তি গ্রন্থ রচনায়। বৃন্দাবনের আচার্য পদে রূপ ও সনাতকে বরণ করা হয়েছিল।


গ্রন্থ রচনা

সনাতন শেষ জীবনে বৈষ্ণব তোষণী নামে এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। তাদের ভ্রাতুপুষ্প শ্রীজবি গোস্বামী তাদের নির্দেশে ঐ গ্রন্থের সংক্ষেপ করে নামকরণ করেন ‘লঘু তোষণী’ । লঘু তোষণী হতে রূপ ও সনাতনের বংশ পরিচয় পাওয়া যায়। তারা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের গৌরব।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০