সত্যব্রত সেন

Barisalpedia থেকে

ভারতের বিশিষ্ট পরিসংখ্যানবিদ, অর্থনীতিজ্ঞ ও স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্যব্রত সেনের (৩.২.১৯১৪-৩০.৯.১৯৯৬) মূল নিবাস বরিশাল। পিতা বরিশালের কৃষিবিভাগের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সুরেন্দ্রনাথ; মাতা সমাজসেবী হেমলতা।

শিক্ষা

সত্যব্রত বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে পড়ার সময়ই বিপ্লবী নিরঞ্জন সেন ও সতীশ পাকড়াশির সংস্পর্শে এসে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে আই.এসসি. ক্লাসে ভরতি হন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এক বছর পর ছাড়া পেলেও ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আবার বন্দি হয়ে হিজলি বন্দিশিবিরে আটক থাকেন। কারাবাসকালে তিনি আই.এ. এবং অঙ্ক ও অর্থনীতি নিয়ে বি.এ. পাশ করেন। কারামুক্তির পর ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে পড়াশোনার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বি.কম পাশ করেন ও স্ট্যাটিস্টিক্স বিষয়ে ডিগ্রি পান।

কর্মজীবন

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি টি বোর্ডে চাকরি নেন। তিরিশের দশকের শেষ দিকে যে ক-জন তরুণ সংখ্যাতাত্ত্বিকদের নিয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রেসিডেন্সি কলেজের বেকার ল্যাবরেটরিতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট সংস্থার কাজ শুরু করেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ওই সংস্থায় (আই.এস.আই.) চাকরি নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে রাষ্ট্রসংঘ-এর (ইউ.এন.ও.) সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগকে সুচারুভাবে সংগঠিত করার জন্য যে ক-জন সংখ্যাতাত্ত্বিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তিনি তাঁদের অন্যতম।

সমাজ ও দেশসেবা

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিন বছর এই কাজের জন্য নিউইয়র্কে কাটিয়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে আই.এস.আই.-তে কাজ করতে থাকেন, সেইসঙ্গে আন্দোলনের কাজও । ইউ.এন.ও.-র প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ইউনাইটেড নেশন্স স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের তিনি ছিলেন প্রধান সভাপতি। ইউ.এন.ও.- র উপরোধে ১৯৫৪-৫৫ খ্রিস্টাব্দে ফিলিপিন্স- এর ম্যানিলাতে স্থানীয় সংখ্যাবিজ্ঞানীদের স্যাম্পল সার্ভে বিষয়ে শিক্ষাদান করেন। দেশে ফিরে জনগণের সমস্যার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে দেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অনেক সমস্যা ও সংগ্রামের নিরসনের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত। জয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস-এর শ্রমিকদের সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য তাঁর উদ্যম, ষাটের দশকে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনে তার ভূমিকা, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের আন্দোলনে তাঁর বুদ্ধি-পরামর্শ জোগানো, তরুণ শিক্ষার্থী অধ্যাপকদের সঙ্গে সংযোগরক্ষা করার দায়িত্ব পালন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদী পাঠক্রমের শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। পার্টির ক্লাস নিতে তিনি জেলায় জেলায় যেতেন। এরই সঙ্গে সঙ্গে তিনি অতি সহজ-সরল ভাষায় মার্কসীয় তত্ত্ব ও তার প্রয়োগ নিয়ে অবিশ্রান্ত লিখেছেন- কখনো নিজের নামে, কখনো রঞ্জন চৌধুরীর স্বাক্ষরে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কেরালায় ই.এম.এস. নাম্বুদ্রিপাদের নেতৃত্বে প্রথম অকংগ্রেসি কমিউনিস্ট সরকার গঠিত হলে তিনি সেখানে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এই সরকার ভেঙে গেলে তিনি কলকাতায় আই.এস.আই-তে ফিরে আসেন। এসময় কমিউনিস্ট পার্টির কাজে আরও বেশি সময় দেবার ইচ্ছায় তিনি আই.এস.আই.-এর চাকুরি ছেড়ে দেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। কোথাও তিনি বেশি দিন চাকরি করার কথা ভাবেননি। সমাজের প্রয়োজনে আপনাকে উৎসর্গ করাই ছিল তাঁর অভিপ্রায়। প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারে তিনি ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে বামফ্রন্ট সরকারের এস.আর. দাশ উন্নয়ন পরিকল্পনা দপ্তরের সচিব ছিলেন। তাঁর পরিকল্পিত ‘কাজের বিনিময়ে খাদ্যপ্রকল্প’ গ্রামাঞ্চলে খুব জনপ্রিয় হয়। গ্রামোন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা এবং গ্রামোনন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বে পঞ্চায়েতকে যুক্ত করা- এই ব্যবস্থাপনার রূপকারদের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এক টাকা মাত্র পারিশ্রমিক নিয়ে তিনি সরকারের কাজ করেছেন। শ্রমনির্ভর প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের পক্ষপাতী তিনি বিদেশ থেকে প্রযুক্তি আমদানির ও বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীলতার বিরোধী ছিলেন। কিছুটা বিবেকচালিত হয়ে তিনি বামফ্রন্ট সরকার ছেড়ে চলে যান।

লেখালেখি

১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ‘পিপল্স ডেমোক্রেসি’র সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকাতেও তার বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখা অসংখ্য পুস্তিকার মধ্যে কয়েকটি: ‘সমাজ বিকাশের ধারা’, ‘বেকারির বিরুদ্ধে’, ‘চাই আমূল পরিবর্তন’, ‘কমিউনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী’, ‘মার্কসবাদের ভূমিকা’ প্রভৃতি।


তথ্যসূত্র: সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান