শিব নারায়ণ, রাজা

Barisalpedia থেকে

চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পঞ্চদশ রাজা শিবনারায়ণ। তিনি পিতা উদয় নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজ্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। তার রাজত্বকাল ১৭৬৮=১৭৭৭।


পারিবারিক জীবন

শিবনারায়ণ নলছিটি থানার নথুল্লাবাদের মিরবহর পরিবারের কন্যা দুর্গাবতীকে বিযে করেন। মিরবহরের পূর্ব পুরুষ গোপাল বসু। এ বংসের রামপ্রসাদ জমিদার ছিলেন। তার তিন পুত্র এবং এক কন্যা ছিল। তার কন্যাই রানী দুর্গাবর্তী শিবনারায়ণের স্ত্রী।

দুর্গাবতীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গোবিন্দ প্রসাদ লোভী ও ধূর্ত ছিলেন। গোবিন্দ প্রসাদ চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের দেওয়ান ছিলেন। তার মাসিক বেতন ছিল এক হাজার টাকা। তিনি রাজ্যে প্রভাবশালী ছিলেন। তাই অনেকে তাকে রাজা বলে জানত এবং নথুল্লাবাদের মিরবহর বাড়িকে রাজবাড়ী বলত। তার বাড়িতে অনেক দালান ও মন্দির নির্মাণ করা হয়। মন্দিরের দক্ষিণ চক্র, বিরূপাক্ষ ও মহাকালীর বিগ্রহ ছিল।

ব্যক্তি চরিত্র

রাজা শিবনারায়ণ পিতা উদয় নারায়ণের চরিত্রের বিপরীত ছিলেন। তিনি অতিশয় ইন্দ্রিয়পরায়ণ, অকর্মণ্য ও অলস ছিলেন। তিনি সব সময় হেরেমে রমণীদের দ্বারা আবৃত থাকতেন। একদল কুচক্রী কর্মচারী রাজাকে ভোগ-বিলাসে লিপ্ত রাখত। তার ভয়ে অনেক গ্রামবাসী স্ত্রী কন্যা নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। তিনি রাজ্য শাসনে অমনোযোগী ছিলেন। রানী দুর্গাবতী অনেক চেষ্টা করে স্বামীকে ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন।


রানী দুর্গাবতীর রাজদায়িত্ব গ্রহণ

দুর্গাবতীকে কালা রানী বলা হতো। প্রজারা তাকে রাণীমাতা বলত। দুষ্ট কর্মচারীরা রাজ্যের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত এবং প্রজাদের উৎপীড়ন করে অর্থ আদায় করত। রানী বাধ্য হয়ে রাজ্যা শাসনের ভার নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তিনি অনেক পুুরনো কর্মচারী বাদ দিয়ে নিজ আত্মীয়-স্বজনদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। তিনি তার ভ্রাতা গোবিন্দ প্রসাদকে রাজ্যের দেওয়ান নিযুক্ত করেন। শিবনারায়ণকে ঢাকা জেলার উলাইনে পিতার জমিদারী নিয়ে মামলা করতে হয়। রাজবল্লভের পুত্র গঙ্গাদাস দু’দলের মধ্যস্থতাকারী নির্বাচিত হন। এ মামলায় কালেক্টর এন গ্লোভার ও হরিরাম মল্লিক জজ ছিলেন। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২ ডিসেম্বর ফার্সী ও বাংলা ভাষায় মামলার রায় বের হয়। রায়ে লব্ধ জমিদারী সনদে দিল্লীর স¤্রাট শাহ আলম বাদশাহ ও ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিলমোহর ছিল।


শিবনারায়ণের মস্তিস্ক বিকৃতি

শিবনারায়ণের মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটলে তাকে বন্দী করে রাখা হয়। ছুটি পেলে তিনি অন্যের ওপর অত্যাচার করতেন। রাজার দেওয়ান রামদেব চক্রবর্তী রহমতপুর থেকে পাল্কি করে রাজবাড়িতে আসতেন। একদিন রাজা রাজবাড়িতে প্রবেশ নিষেধ করে দেন। পাল্কির বাহক রক্ষীদের নিষেধ উপেক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করলে রাজার প্রহরী তরবারির আঘাতে রামদেবকে হত্যা করে। এ হত্যার জন্য শিবনারায়ণ দুঃখ প্রকাশ করেন এবং রামদেবের ভ্রাতা রামভদ্রকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। রামভ্রদের মৃত্যুর পর তার পুত্র রামজীবনকে ১৩ বছর বয়সে দেওয়ান নিযুক্ত করা হয়। তিনি নামেমাত্র দেওয়ান ছিলেণ। রানীর ভ্রাতা গোবিন্দ প্রসাদ প্রধান দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন। শিবনারায়ণের উন্মত্ততা বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন রাতে ছুটি পেয়ে তিনি ঘুমন্ত রাজবাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেন এবং বড় বড় দালান ভষ্মীভূত হয়ে যায়। মোগল স¤্রাটের নিকট হতে প্রাপ্ত পাঞ্জা অঙ্কিত সনদ দলিল ও সিংহাসন পুড়ে যায়। শিবনারায়ণকে প্রজারা পাগলা রাজা বলত।


দুর্দশাগ্রস্ত শেষ জীবন

তার রাজত্বকালে ১৭৭০ খৃৃস্টাব্দে মন্বন্তর দেখা দেয়। হেষ্টিংসের পাঁচসালা বন্দোবস্তের সময় চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে দুর্যোগ দেখা দেয়। শিবনারায়ণের রাজত্বকালে চাখারের মজুমদার ও মীর পরিবারের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। শিবনারায়ণের সাথে মজুমদার ও মীরদের বিবাদ শুরু হয়। একবার শিব মেলায় মজুমদার ও রাজকর্মচারীদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। মজুমদার ও মীররা মাধবপাশা আক্রমণ করে এবং রাজা শিবনারায়ণকে বন্দী করে নিয়ে যায়। এক রাতে প্রাচীর নির্মাণ করে রাজাকে বন্দী করে রাখা হয়। রাজাকে চাখারে যে বাড়িতে রাখা হয়েছিল, সে বাড়িকে রাজার হাউলী বলা হয়। রাজার কর্মচারী ও ভক্তরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

মৃত্যু

রাজা শিবনারায়ণ দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর ১৭৭৭ খ্রিস্টব্দে দেহত্যাগ করেন।