শহীদ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন

Barisalpedia থেকে

শহীদ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন (১৯৩৩-১৯৭১) নৌবাহিনীর অফিসার ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। জন্ম ১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তথা ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২ আশ্বিন পিরোজপুর জেলার ডুমুরতলা গ্রামে। তাঁর পিতা মোফাজ্জেল আলী ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। মায়ের নাম লতিফুননেছা বেগম। মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৪৭ সালে বাগেরহাটের কচুয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপর তিনি বাগেরহাট কলেজে আই.এস.সি ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে তাঁর শিক্ষা জীবন ব্যাহত হয়। পরে তিনি বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আই.এসসি ক্লাশে অধ্যয়ন করেন।

লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন.jpg


ব্রজমোহন কলেজে অধ্যয়নকালে মোয়াজ্জেম হোসেন ১৯৫০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। একই বছর তিনি ব্রিটিশ রাজকীয় নৌবাহিনীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মোয়াজ্জেম হোসেন পাকিস্তান নৌবাহিনীর মনোনীত অফিসার হিসেবে ১৯৫৮-১৯৬০ সালে ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে নেভাল বেস চট্টগ্রামে চিফ ইঞ্জিনিয়ার নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৭ সালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদে উন্নীত হন। এ সময় তিনি ডেপুটেশনে পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ সংস্থার বরিশাল শাখায় যোগ দেন।

১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করে। সরকার ১৯৬৮ সালে ফৌজদারি আইন সংশোধন করে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য’ নামে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ গঠন করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত এ মামলার ৩৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালের শুরু থেকে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নৌবাহিনীতে অবস্থানরত বাঙালিদের সমন্বয়ে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলা, সেনা ও বিমান বাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তাদের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা, কার্যক্রম সফল করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান সহ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সিভিল সার্ভিসের বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিভিন্ন গোপন বৈঠক এবং সংগঠন পরিচালনার তহবিল সংগ্রহ করার অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। প্রবল গণআন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করলে মোয়াজ্জেম হোসেন মুক্তিলাভ করেন। এরপর তিনি পুনরায় চাকরিতে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ অবসর গ্রহণ করেন।

অবসর গ্রহণের পর মোয়াজ্জেম হোসেন প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭০ সালের ২৪ মার্চ তিনি ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ঘোষণা দেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ২৮ মার্চ লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেন। এ লক্ষ্যে তিনি লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন, এক দফা প্রভৃতি পুস্তিকা রচনা করেন। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মোয়াজ্জেম হোসেন লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটিকে জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে একটি পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলে রূপান্তর করেন। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে যেকোন ধরনের সমঝোতার পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের নির্দেশ দেন এবং এ উদ্দেশ্যে ১৬ মার্চ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া সফর করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালে কর্নেল তাজের নেতৃত্বে একদ পাকসেনা ঢাকায় তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক কন্যা, এক পুত্র রেখে যান। শিশুপুত্র পিতার নির্মম হত্যাকা- দেখে নির্বাক ও পঙ্গু হয়ে যায়।


লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন স্মরণে ১৯৭৬ সালের ১৬ জানুয়ারি রাঙামাটিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ ঘাঁটির নামকরণ করা হয় বিএনএস শহীদ মোয়াজ্জেম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাকবিভাগ ১৯৯৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকার একটি সড়কের নামকরণ করেছে শহীদ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন সড়ক।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫। ও বাংলাপিডিয়া