লাখুটিয়ার জমিদার/ রায়চৌধুরী পরিবার

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৬, ১১ জুন ২০১৮ পর্যন্ত সংস্করণে

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

লাখুটিয়ার রায় বংশের আদিপুরুষ রামচন্দ্র খাঁ ত্রিবেণীর অধিবাসী। তাঁর চতুর্থ প্রজন্মের সন্তান ঘনশ্যামকে চন্দ্রদ্বীপের রাজা উদয় নারায়ণ (১৭২৩-১৭৬৮) ব্রহ্মোত্তর ও তালুক প্রদান করে লাখুটিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলত এঁদের জমিদারিও ছিল চন্দ্রদ্বীপ পরগণায়। ঘনশ্যামের উত্তরপুরুষরাই লাখুটিয়ার জমিদার তথা রায়চৌধুরী পরিবার হিসেবে খ্যাত। রবীন্দ্রনাথের দুই ভাতিজি এই বাড়িতে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই ইহা রবীন্দ্রনাথের বেয়াই বাড়ি।


লাখুটিয়ায় বসতি

লাখুটিয়ার রায় বংশের আদিপুরুষ রামচন্দ্র খাঁ বাংলা বিহার সীমান্তে মোগল শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি চাকরি ও সম্পদ হারিয়ে বাউফল থানার পুরী গ্রামে আগমন করেন। সম্ভবত মগ-পর্তুগীজদের আক্রমণে তার প্রপৌত্র দুর্গারাম রায় স্ত্রীসহ নিহত হন। ধাত্রী তাদের শিশুপুত্র ঘনশ্যামকে নিয়ে চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী মাধবপাশায় আশ্রয় নেয়। রাজা তাকে লাল-পালন করেন এবং প্রধান খানসামা নিযুক্ত করেন। রাজা উদয় নারায়ণ (১৭২৩-১৭৬৮) ঘনশ্যামকে ব্রহ্মোত্তর ও তালুক প্রদান করে রায় উপাধি দিয়ে লাখুটিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন।


লাখুটিয়ার নামকরণ

তখন সুগন্ধার একটি শাখা নদী লাখুটিয়া হয়ে প্রবাহিত হতো। এ নদীর দক্ষিণ তীরে গভীর জঙ্গলে লক্ষ লক্ষ টিয়া পাখি বাস করত। লক্ষ টিয়া হতে লাখুটিয়া নাম হয়েছে। ঘনশ্যাম রায় রাণী বিমলার খননকৃত শার্সী দীঘির উত্তর পাশে জঙ্গল আবাদ করে বাসগৃহ নির্মাণ করেন।


লাখুটিয়ার রায়দের বংশ তালিকা

এই পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ও আদি পুরুষ রামচন্দ্র খাঁ। রামচন্দ্র খাঁয়ের পুত্র রূপ চন্দ্র খাঁ। তাঁর পুত্র দুর্গারাম রায়। তাঁর পুত্র ঘনশ্যাম রায় চৌধুরী। তাঁর পুত্র রাধাকৃষ্ণ রায় ও বলরাম রায় চৌধুরী। রাধাকৃষ্ণ রায়ের পুত্র রাম কিশোর রায় চৌধুরী। বলরাম রায় চৌধুরীর পুত্র রাজচন্দ্র রায় চৌধুরী, মাধবচন্দ্র রায় চৌধুরী, কালাচাঁদ রায় চৌধুরী, শিবচন্দ্র রায় চৌধুরী ও প্রতাপ রায় চৌধুরী। রাজচন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র রাখাল চন্দ্র রায় চৌধুরী, বিহারী লাল রায় চৌধুরী, ও প্যারী লাল রায় চৌধুরী। রাখাল চন্দ্র রায় চৌধুরীর পুত্র দেবকুমার রায়চৌধুরী। বিহারী লাল রায় চৌধুরীর পুত্র শ্রী সুকুমার, সুশীল, জ্যোতিন্দ্র ও সুরেন্দ্র। প্যারী লাল রায় চৌধুরীর পুত্র ইন্দ্রলাল ও পরেশলাল। সুরেন্দ্র রায়চৌধুরীর পুত্র দেবেন ও পংকজ।


বংশের বিখ্যাত ব্যক্তি ও কৃতিত্ব

রাজচন্দ্র রায়চৌধুরী- এই বংশের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব রাজচন্দ্র রায়চৌধুরী। ঘনশ্যাম রায়ের পৌত্র রাজচন্দ্র রায়চৌধুরী ১৭৯৭ খৃৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। রাজচন্দ্র রায় ১৯ শতকের প্রথম ভাগে বরিশালে আইন ব্যবসা করতেন। তিনি সংস্কৃত ও ফার্সী ভাষায় প-িত ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন। পুলিশি চাকরি পরিত্যাগ করে তিনি আইন ব্যবসা করেন। তিনি আজিমপুর পরগণার অংশ ও কয়েকটি তালুক ক্রয় করেন। তিনি ১৮৬০ খৃৃস্টাব্দে বরিশাল হতে লাখুটিয়ায় খাল খনন ও রাস্তা নির্মাণ করেন। এ খাল কাটাখাল বা কাটাখালী নামে পরিচিত। তিনি বাড়িতে কয়েকটি সুরম্য দালান ও মন্দির নির্মাণ করেন। বাড়ির সামনে তিনি একটি দীঘি খনন ও রাসমেলা প্রতিষ্ঠা করেন। রাসমেলা এক মাস ধরে চলত। কোম্পানি আমলে তিনি বরিশালের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন।

রাখালচন্দ্র রায়চৌধুরী- রাজচন্দ্র রায়চৌধুরীর পুত্র রাখাল চন্দ্র রায়চৌধুরী আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং বরিশাল অঞ্চলে ব্রাহ্ম সমাজের তিনি অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি পিতার নামে বরিশাল শহরে ফকিরবাড়ি এলাকায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কিছুদিন উক্ত কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। কলেজটি নেই, তবে সেখানে এখনো রাখাল বাবুর পুকুর রয়েছে। রাখাল চন্দ্র রায়চৌধুরীর স্ত্রী কুসুমকুমারী রায়চৌধুরাণী বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক। তাঁদের পুত্র দেবকুমার রায় চৌধুরী একজন বিখ্যাত কবি।

প্যারীলাল রায়চৌধুরী- রাজচন্দ্র রায়চৌধুরীর ৩য় পুত্র প্যারীলাল রায়চৌধুরী বরিশালের প্রথম ব্যারিষ্টার। তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ব্যারিষ্টারী পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

দেবকুমার রায়চৌধুরী- দেবকুমার রায়চৌধুরী ছিলেন রাখাল চন্দ্র রায়ের পুত্র এবং একজন সুসাহিত্যিক। জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৮৮৬। মৃত্যু ১০ ডিসেম্বর ১৯২৯। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদের বরিশাল শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ও ১৯০৬ খ্রি. বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন বরিশালে অনুষ্ঠিত হয়। তিনি কবি দ্বিজেন্দ্রলালের ‘পূর্ণিমা সম্মেলনে’ স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন। তাঁর রচিত দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনী একটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। রচিত কাব্যগ্রন্থ: ‘অরুণ’, ‘প্রভাতী’, ‘মাধুরী’, ‘ধারা’ এবং কাব্যনাট্য: ‘দেবদূত’। রচিত ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ পুস্তিকায় তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন সমস্যা বিশ্লেষণ করে মীমাংসার পথ দেখিয়েছেন। সুশীল কুমার রায়- বিহারী লাল রায়ের পুত্র সুশীল কুমার রায় এমবিবিএস, এফআরসিএস ডিগ্রী লাভ করে লন্ডনে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতেন।

জ্যোতিন্দ্র কুমার- বিহারী লাল রায়ের তৃতীয় পুত্র জ্যোতিন্দ্র কুমার ব্যারিষ্টারী পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা করেন।

ইন্দ্রলাল রায়- প্যারীলালের পুত্র ইন্দ্রলাল রায় বাঙালীদের মধ্যে প্রথম বৈমানিক।

পরেশ লাল রায়- প্যারীলালের পুত্র পরেশ লালের নামানুসারে বরিশাল শহরে পরেশ সাগর নামে দীঘি রয়েছে।


উপসংহার

এভাবে লাখুটিয়ার জমিদাররা মূলত বিংশ শতকের উন্নয়ন ও শিক্ষায় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিয়ে বরিশালের অন্যতম আলোকিত পরিবার হিসেবে নাম কুঁড়িয়েছে।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।