রূপ গোস্বামী
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় কয়েকজন প্রতিভাশালী পন্ডিতকে তার সভায় উচ্চপদ প্রদান করেন। এ পন্ডিতদের মধ্যে চন্দ্রদ্বীপ-বাকলার রূপ গোস্বামী অন্যতম।
পূর্বপুরুষ
রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামীর পূর্ব পুরুষ জগতগুরু কর্ণাট প্রদেশের ভরদ্বাজ গোত্রীয় এক ব্রাহ্মণ রাজা ছিলেন। এই রাজার অধস্তন বংশধরদের মধ্য থেকে এক কুমারদেব পীরালিদের ভয়ে নৈহাটী ছেড়ে দনুজমর্দন প্রতিষ্ঠিত চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে চলে আসেন । ‘যবনের ভয় কুমার নৈহাটী ছাড়িল/ কিছুদিন বঙ্গে চন্দ্রদ্বীপে বাস কৈলা। [প্রেম বিলাস ‘ আনুমানিক ১৪৬০ খ্রিঃ কুমারদেব বাকলায় বসতি স্থাপন করেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজা তাকে ভূমি প্রদান করেন। বাকলায় কুমার দেবের অমর, সন্তোষ ও বল্লভ নামে তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। শ্রী চৈতন্যদেব তাদের তিন ভাইয়ের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ ও শ্রীঅনুপম রেখেছিলেন এবং পরবর্তীতে তারা এই নামেই পরিচিত হন। এদের মধ্যে সন্তোষ ছিলেন শ্রীরূপ গোস্বামী।
কর্মজীবন
শ্রীরূপ গোস্বামী বাকালায় প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে গৌড়ের রামকেলিতে চলে যান। মুকুন্দ দেবের মৃত্যুর পর তিন ভাই সুলতানদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে তারা পদোন্নতি লাভ করেন। শ্রীরূপ গোস্বামী সাকর মল্লিক (সগির মালিক) অর্থাৎ রাজস্ব বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৫১৩ খ্রিঃ গৌড় শ্রীচৈতন্য দেবের সাথে তিন ভাইয়ের সাক্ষাত হয় । ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে রূপ রাজসভা ত্যাগ করে শ্রীচৈতন্যের নিকট চলে যান।
পান্ডিত্য ও গ্রন্থ রচনা
রূপ ও সনাতনের শাস্ত্র জ্ঞান ছিল অপরিসীম। উভয় ভ্রাতা ৪০ বছরের বেশি মথুরা, বৃন্দাবন ও কাশীধামে ধর্ম সাধনা ও শাস্ত্র চর্চায় অতিবাহিত করেন। তারা যেমন পন্ডিত তেমনি সর্বত্যাগী বৈষ্ণব ভক্ত সন্যাসী ছিলেন। তারা কাশীধামে শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপা লাভ করেন। জ্ঞান ও ভক্তির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল রুপ ও সনাতনের ভক্তি গ্রন্থ রচনায়। বৃন্দাবনের আচার্য পদে রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামীকে বরণ করা হয়েছিল।
রূপ গোস্বামী নাট্যকার ছিলেন। তাঁর একটি একোক্তি নাটক ‘দানকেলী কৌমুদী’। এ নাটক কৃষ্ণের ঘাটদান লীলা বিষয়ে লিখিত। বৈষ্ণব রসশাস্ত্র বিষয়ে তাঁর দুখানি গ্রন্থ ‘ভক্তি রসামৃত সিন্ধু’ ও ‘উজ্জ্বলনীলমণি’। পরবর্তীকালে যাঁরা গীতিকবিতায় কৃষ্ণলীলা বর্ণনা করেছেন তাঁদের মাঝে ‘উজ্জ্বলনীলমণি’র প্রভাব অল্পবিস্তর লক্ষ্যনীয়। এছাড়াও রূপ গোস্বামীর তিনখানা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘উদ্ভবসন্দেশ’ ‘গীতাবলি’ ও ‘পদ্যাবলী’।
সনাতন শেষ জীবনে বৈষ্ণব তোষণী নামে এক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। লঘু তোষণী হতে রূপ ও সনাতনের বংশ পরিচয় পাওয়া যায়। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও বৈষ্ণব সাহিত্য রচনা করে রূপ সনাতন ও জীব গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তারা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের গৌরব।
তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।