রায়েরকাঠি

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১২:০৭, ১০ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত সংস্করণে ("পিরোজপুরের রায়েরকাঠি গ্রামটি সেলিমাবাদের সবচেয়ে বড়..." দিয়ে পাতা তৈরি)

পিরোজপুরের রায়েরকাঠি গ্রামটি সেলিমাবাদের সবচেয়ে বড় জমিদার রায় পরিবারের জন্য বিখ্যাত। তাঁদের কারণেই স্থানটির নাম রায়েরকাঠি হয়েছিল।


প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

আদি অংশ- পশ্চিম বাংলার ২৪ পরগণার দিগঙ্গার বাসুকি গোত্রীয় সেন কূলোদ্ভ‚ত দক্ষিণ রাঢ়ীয় মৌলিক কায়স্থ আদিশুরের সভায় আগত রামনাথ সেন হুগলীর দিগঙ্গায় বাস করত। তাঁর পঞ্চদশ অধস্তন কিঙ্কর ভ‚ঁইয়ার পুত্র মদন মোহন সেলিমাবাদ পরগণার জমিদারী লাভ করেন। মদন মোহন একজন বীরযোদ্ধা ছিলেন। তিনি মোগলদের পক্ষে রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তিনি অনেক উপঢৌকন নিয়ে যুবরাজ শাহজাহানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। যুবরাজ তাকে প্রথমে সেরেস্তাদারের চাকরি দেন। সুবাদার রাজস্ব আদায়ের জন্য ফৌজদার ছবি খান ও মদন মোহনকে চন্দ্রদ্বীপে প্রেরণ করেন। সুবাদার সন্তুষ্ট হয়ে স¤্রাটের নামে সেলিমাবাদ পরগণা সৃষ্টি করে মদন মোহনের পুত্র শ্রীনাথের নামে পাট্টা দেন। শ্রীনাথ খুব সম্ভব ১৬২৮ খৃৃস্টাব্দে বাকলায় আগমন করেন এবং বিষখালী নদীর তীরে দক্ষিণচক্র নামে একটি মূর্তি প্রাপ্ত হন। তিনি দক্ষিণচক্র মূর্তিটি নলছিটি থানার নথুল্লাবাদ গ্রামে স্থাপন করেন। তিনি জঙ্গল আবাদ করে জনপদ গড়ে তোলেন। দিল্লীর স¤্রাট তাকে রাজা উপাধি প্রদান করেন। তিনি সুতালরী ও লুৎফাবাদ গ্রামে কাছারি নির্মাণ করেন। শ্রীনাথের পুত্র শ্রীরাম একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। তিনি মগ-পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বীরত্বের পরিচয় দেন। তিনি ঝালকাঠির লুৎফাবাদ গ্রামে বাস করতেন।

রায়দের বংশলতিকা: কিংকর ভ‚ঁইয়ার পুত্র মদনমোহন রায়, তদীয় পুত্র শ্রীনাথ রায়, তদীয় পুত্র শ্রীরাম রায়, তদীয় পুত্র রুদ্রনারায়ণ রায় (তিনিই মূলত রায়েরকাঠি জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা), তদীয় পুত্র নরোত্তম নারায়ণ রায়, তদীয় পুত্র শত্রাজিত রায়, তদীয় পুত্র জয়নারায়ণ রায়। জয়নারায়ণ রায়ের দুই পুত্র শিবনারায়ণ রায় ও দুর্লভ নারায়ণ রায়। শিবনারায়ণ রায়ের পুত্র প্রাণ নারায়ণ, তদীয় পুত্র মহেন্দ্র নারায়ণ। মহেন্দ্র নারায়ণের তিন পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ, মাধব নারায়ণ ও নর নারায়ণ। মাধব নারায়ণের পাঁচ পুত্র গিরীন্দ্র, নগেন্দ্র, যতীন্দ্র, জীবন্দ্রে ও সুরেন্দ্র। নর নারায়ণের দুই পুত্র ভ‚পেন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্র। জয়নারায়ণ রায়ের দ্বিতীয় পুত্র দুর্লভ নারায়ণ রায়ের পুত্র ব্রজনারায়ণ। ব্রজনারায়ণের পুত্র গোকুল নারায়ণ, তদীয় পুত্র অদ্বৈত নারায়ণ, তদীয় পুত্র জিতেন্দ্র নারায়ণ, তদীয় পুত্র নরেন্দ্র নারায়ণ।


রায়েরকাঠিতে জমিদারির দপ্তর স্থাপন

শ্রীরামের পুত্র রাজা রুদ্রনারায়ণ স্বপ্নে দেখলেন পিরোজপুরের দামোদর নদীর উত্তর তীরে এক বৃক্ষ মূলে জগদম্বার পাষাণময়ী দশভুজা মূর্তি প্রোথিত আছে। রুদ্রনারায়ণ সিদ্ধেশ্বরী বা কালী মূর্তি উদ্ধার করে উক্ত স্থানে স্থাপন করেন। সেখানে তিনি রাজধানী নির্মাণ করে বসতি স্থাপন করেন। তিনি দক্ষিণ রাঢ়ীয় রায় বংশের কায়স্থ সন্তান। রায় বংশ জঙ্গল কেটে আবাদ সৃষ্টি করে। তাই তাদের নামানুসারে গ্রামের নাম হয় রায়েরকাঠি।

রায়েদের ধর্মগুরু রূপরাম চক্রবর্তী পাঁচজন নমঃশূদ্রের মুÐু দ্বারা কালী মূর্তি স্থাপন করেন। রুদ্রনারায়ণ অর্থ দিয়ে পাঁচজন চÐালকে ক্রয় করে তাদের মুÐু দিয়ে এই পূজার আয়োজন করেছিলেন। রুদ্রনারায়ণ ১৬৫৮ খৃৃস্টাব্দে বাংলা ১১৬৫ সনের বৈশাখ মাসে মন্দির নির্মাণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে কালী মূর্তি স্থাপন করেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজা ঢাকার সুবাদারের নিকট এ নির্মম হত্যাকাÐের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। সুবাদার রুদ্রনারায়ণকে ঢাকায় কারাদÐ দেন। এক ব্যাঘ্র শিকার করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। রুদ্রনারায়ণ লুৎফাবাদের গোপাল কৃষ্ণ মিরবহরকে এবং বাইশারী গ্রামের পূর্ব আবাদকারী শ্রীমন্ত রায় ও অনন্ত রায়কে নিষ্কর ভ‚মি দান করেন। তিনি শেষ জীবনে কাশী গমন করে মৃত্যুবরণ করেন।


বংশের গুরুত্বপূর্ণ জমিদারগণ ও তাদের কীর্তি

রুদ্রনারায়ণের ৪ পুত্র- নরোত্তম নারায়ণ, কন্দপ নারায়ণ, গন্ধর্ব নারায়ণ (অন্য জনের নাম জানা নেই)। নরোত্তম নারায়ণ সেলিমাবাদ পরগণার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নরেন্দ্র নারায়ণ বনগাঁ-শ্রীপুর, কন্দর্প নারায়ণ খুলনার চিংড়াখালী ও গন্ধর্ব নারায়ণ চিরুলিয়া কোদলায় বসতি স্থাপন করেন। নরোত্তম নারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র শত্রাজিত রায়েরকাঠির জমিদারী লাভ করেন। মিঃ বেভারিজ বলেছেন শত্রাজিত স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে সিদ্ধেশ্বরী মূর্তি প্রাপ্ত হন এবং দেবীর নির্দেশে রায়েরকাঠিতে বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু বেভারিজের এ তথ্য ঠিক নয়। কালী মন্দিরে সংস্কৃত ভাষায় একটি শিলালিপি আছে এবং সেখানে উল্লেখ আছে যে, রুদ্রনারায়ণ বাংলা ১০৬৫ সনে মূর্তি স্থাপন করেছেন। বেভারিজ বলেছেন তিনি বাংলা ১০৫০ সনে কালীমূর্তি স্থাপন করেছেন। কিন্তু তার তারিখ ঠিক নয়।

জয়নারায়ণের কীর্তি- শত্রাজিতের পুত্র জয়নারায়ণ বাংলা ১১৪৪ সনে মন্দির নির্মাণ ও ১১৬২ সনের ৩০ পৌষ মন্দির উদ্বোধন করেন। শত্রাজিত রাজবাড়ী, নহবতখানা, অতিথিশালা, ফটক প্রভৃতি নির্মাণ ও দীঘি খনন করেন। তিনি লুৎফাবাদ গ্রামে দীঘি খননকালে শিবলিঙ্গ পান। তিনি রুনসী গ্রামে শিবলিঙ্গ স্থাপন ও মন্দির নির্মাণ করেন। জয়নারায়ণ একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। আগাবাকের সেলিমাবাদ দখল করলে তাঁর সাথে সুতালরী ও বারৈকরণে জয়নারায়ণের যুদ্ধ হয়। বারৈকরণের যুদ্ধে জয়নারায়ণ আগাবাকেরের সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ২২টি কামান দখল করে রায়েরকাঠি নিয়ে যান।


রায়েরকাঠির সাময়িক পতন ও উদ্ধার

প্রথমবারে জয়নারায়ণের সাথে পরাজিত হওয়ার পরে ১৭৪৮ খৃৃস্টাব্দে আগাবাকের রায়েরকাঠি পুনরায় আক্রমণ করে সেলিমাবাদ দখল করে নিয়ে যায়। তখন জয়নারায়ণ নবাবের নিকট হতে সাড়ে চারআনা জমিদারী উদ্ধার করেন। ১৭৫৩ খৃৃস্টাব্দে আগাবাকের নিহত হলে রাজবল্লভ সেলিমাবাদের সাড়ে এগারো আনা দখল করেন। বাকি জমির রাজস্ব আদায়ের জন্য ঢাকার নায়েব নাজিম জয়নারায়ণের দেওয়ান কৃষ্ণরামকে কারারুদ্ধ করেন। কৃষ্ণরাম কারারক্ষীকে উৎকোচ দেবার টাকা এক কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণকে দিয়ে দেন। এ সংবাদ নায়েব নাজিম জানতে পেরে তাকে মুক্তি দেন এবং জমিদারী ফেরত দেন। রাজা সন্তুষ্ট হয়ে কৃষ্ণরামকে একটি তালুক প্রদান করেন। জয়নারায়ণের পুত্র শিবনারায়ণ ও দুর্লভ নারায়ণ।

শিবনারায়ণ চট্টগ্রামের দেওয়ান গোকুল চন্দ্র ঘোষালের চেষ্টায় কোম্পানির কুঠিয়াল ভেরেলস্টের সাথে সাক্ষাত করেন। ভেরেলস্ট রাজবল্লভ ও তার পুত্রদের দখল থেকে ১১৬৪ বাংলা সনে সাড়ে এগারো আনা সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে শিবনারায়ণকে প্রদান করেন। শিব নারায়ণ সন্তুষ্ট হয়ে দেওয়ান গোকুল চন্দ্র ঘোষালকে পাঁচআনা পনেরো গÐা অংশ প্রদান করেন। ঘোষাল ও শিবনারায়ণের আবেদনক্রমে ১৭৭২ খৃৃস্টাব্দে ঢাকার চীফ মিঃ বারওয়েল জমিদারী অংশীদারদের মধ্যে ভাগ করে দেন। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দের বণ্টননামা বরিশাল কালেক্টরেটে ছিল।


পরবর্তী প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ

রায় বংশের মধ্যে শিবনারায়ণের নাতি মহেন্দ্র নারায়ণ তেজস্বী ও বিচক্ষণ পুরুষ ছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় তার বুৎপত্তি ছিল। তিনি বরিশালের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৮৫৮ খৃৃস্টাব্দে মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতেশ্বরী হলে বরিশালের দরবারে তাঁকে শ্রেষ্ঠ আসন প্রদান করা হয়। কিন্তু মহেন্দ্র নারায়ণ তার আসন চন্দ্রদ্বীপ রাজাকে ছেড়ে দেন। তার পুত্র নরনারায়ণ একজন সাহিত্যিক ছিলেন। এ পরিবারের শিশির কুমার রায় ‘শাদব নারায়ণ’ গ্রন্থ রচনা করেন। এ গন্থে রায় পরিবারের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। রায়েরকাঠির শেষ জমিদার ছিলেন অমরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। এছাড়াও রায়েরকাঠির কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন: ১. রুদ্রনারায়ণ রায় (সপ্তদশ শতক), রায়েকাঠিতে রায়দের জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। ২. নরনারায়ণ রায় (ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ) বাংলা ভাষায় বরিশালের সর্ব প্রথম গদ্যলেখক মর্মে রোহিনীকুমার সেনের দাবি। ৩. উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ শাস্ত্রী (জন্ম ১৫ নভেম্বর ১৮৬৭। মৃত্যু ২১ জুলাই ১৯৫৯) খ্যাতনামা সংস্কৃতবিদ, আদর্শ শিক্ষাব্রতী ও অধ্যাপক; বেদপাঠের অধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ; রায়েরকাঠি রাজবংশের রাজা শশিভূষণ রায় চৌধুরীর পুত্র। ৪. শিশিরকুমার বসু (২৪ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬ - ২৭ জুন ১৯৭০), শিশির পাবলিশিং হাউসের পরিচালক ও বিশিষ্ট সম্পাদক। ৫. নৃপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী (১৯ ফেব্রæয়ারি ১৯০৬ - মৃত্যু ৩০ এপ্রিল) লেখক, প্রাবন্ধিক ও ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, উপেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ শাস্ত্রীর পুত্র। ৬. শিবনারায়ণ রায় (২০.১.১৯২১ - ২৬.২.২০০৮), বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।


স্থাপত্য কীর্তি

রায় পরিবার ৩০০ বছর রায়েরকাঠি গ্রামে বাস করে তারা পিরোজপুরে এক উন্নত জনপদ গড়ে তোলেন। পিরোজপুর শহর হতে উত্তরে ৪ মাইল দূরে গ্রামটি। রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার ছিল উঁচু। চারদিকে সুরক্ষিত পরিখা, প্রবেশদ্বারে একটি পুল। পুলের দু’পাশে রক্ষীদের গোপন কক্ষ ছিল। রাজবাড়িতে ৪০টি সুউচ্চ অট্টালিকা ও সুড়ঙ্গ ছিল। সব অট্টালিকা ভেঙ্গে পড়েছে। রাজবাড়ির সামনে কয়েকটি মন্দির, ৩টি অতিথিশালা, ঘোড়াশালা, নহবতখানা, খাজাঞ্জিখানা, বিচারালয় ও কাছারি ছিল। পাশেই রয়েছে দীঘি। রাজবাড়ির তোরণ ভেঙ্গে পড়েছে। রাজবাড়ির উত্তরে টোনা গ্রাম, পূর্বে কালীগঙ্গা নদী, দক্ষিণে দামোদর ও পশ্চিমে বলেশ্বর নদী। বাড়ির চার পাশে খাল। বাড়িতে অনেক কামান ছিল, কতকগুলো আগাবাকের নিয়ে যান। কোম্পানি আমলে বাকি কামানগুলো ইংরেজরা নিয়ে যায়। রাজবাড়ির মন্দিরটি ধ্বংস হয়েছে। পুরনো মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। পাল আমলের কালী বা সিদ্ধেশ্বরী মূর্তিটি রাজবাড়িতে পূজিত হতো। কালী মূর্তির দু’পাশে শিবলিঙ্গ আছে। রায়েরবাড়ির কালী মূর্তিটি ১৯৮২ খৃৃস্টাব্দে চুরি হয়ে যায়। নবরতœ ভেঙ্গে গেছে। পঞ্চরতেœর তিনটি আছে।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।