রামচন্দ্র বসু

Barisalpedia থেকে

রামচন্দ্র বসু চন্দ্রদ্বীপের ১০ম রাজা। দীর্ঘ ১৫৯৮ থেকে ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি চন্দ্রদ্বীপের রাজা ছিলেন। তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৫৮৬ সালে।

শিক্ষা ও সিংহাসনে আরোহণ

যুবরাজ রামচন্দ্র রায় ১৫৯৮ খ্রিঃ পিতা কন্দর্প নারায়ণের মৃত্যুর পর বাকলার সিংহাসনে আরোহন করেন। তিনি সম্ভবত ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী কচুয়ায় জন্মগ্রহন করেন। পন্ডিতদের নিকট তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করেন। প্রধান সেনাপতি রঘুনান্দ ও মল্লবীর রামমোহন তত্ত্ববধানে তিনি যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করেন। রামচন্দ্রের মাতা তাকে রাজ্য শাসনে সব সময় সহায়তা করতেন।

হোসেনপুরে রাজধানী নির্মান

কন্দর্প নারায়ণ জীবিতকালে রাজধানী হোসেনপুরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। রামচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেই বর্তমান ঝালকাঠি উপজেলার গাভা-রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে রাজধানী নির্মান শুরু করেন। পঞ্চ নদীর সঙ্গমস্থলের পশ্চিম পারে হোসেনপুর। তিনি নদীর পশ্চিম পাশে দীঘি খনন করে কালীমন্দির নির্মান করেন। পঞ্চকরণের পশ্চিম পাশে পরিখা খনন করে রাজধানীকে সুরক্ষিত করেন। তিনি রাজধানী থেকে মুসলমান ও নমঃশূদ্রদের অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে কুলীণ ব্রাহ্মন, কায়স্থ, ও বৈদ্যদের বসান। তিনি লক্ষ্মীনারায়ণ বন্দ্যেপাধ্যায় ও কালীকিঙ্কর ন্যায়কে রাজার দ্বারপন্ডিত নিযুক্ত করেন এবং তাদের নিকট বিভিন্ন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করেন। রাজবাড়ির দক্ষিণে রাজ-পুরোহিতের বাড়ি ছিল। তিনি রামরত্ন দাশগুপ্তকে অমাত্য ও শ্রী কান্তকে প্রধান খানসামা নিযুক্ত করেন। রাজবাড়ির উত্তরে রঘুনাথ ও অনন্তদেবের বিগ্রহ স্থাপন করেন। তিনি পঞ্চকরণে একটি বন্দর প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চকরণ পাঁচটি নদীর সঙ্গমস্থল ছিল। একটি নদী দক্ষিণে ঝালকাঠি, একটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে স্বরূপকাঠি, একটি গুঠিয়া এবং অপরটি উত্তরে উজিরপুরের দিকে প্রবাহিত হতো। হোসেনপুরের পশ্চিমে রাজা নিজ নামে রামচন্দ্রপুর গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। হোসেনপুরে ও গাভা-রামচন্দ্রপুরে বাকলা থেকে আগত কুলীনগণ বসতি স্থাপন করেন।


প্রতিরক্ষা

রঘুনাথ ফৌজদার রামচন্দ্রের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। রঘুনন্দের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ, রামনাথ, রঘুনাথ ও রামমোহন রাজার সেনাবাহিনীতে চাকরি করত। মুলাদী থানার জাহাপুরের জমিদার দত্তদের পূর্বপুরুষ রামেশ্বর দত্ত রমাচন্দ্রের একজন সেনানায়ক ছিলেন। রাজার প্রধান শরীররক্ষক ছিলেন রামমোহন মাল। বীরশ্রেষ্ঠ রামমোহন মাল রূপকথার নায়ক ছিলেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিলণ সীমান্ত প্রদেশে। তিনি জাতিতে ক্ষত্রিয় । তার পিতা ভুলুয়ায় বসতি স্থাপন করেন। রামমোহনের বীরত্বের কথা শুনে কন্দর্প নারায়ণ তাকে প্রধান শরীররক্ষক নিযুক্ত করেন। রামমোহন ও তার পুত্রগন প্রথমে রাকুদিয়া ও পরে উজিরপুরে বসতি স্থাপন করেন। রামমোহনের পুত্র কৃষ্ণজীবন রাজার নৌবাহিনীর প্রধান বা মীরবহর ছিলেন।

রামচন্দ্রের দুই দল পর্তুগীজ সৈন্য ছিল। পর্তুগীজরা কামান ,বন্দুক ও গোলাবারুদ তৈরি করত। জন গেরির অধীনে দেশী ও পর্তুগীজ মিলে ১০ হাজার সৈন্য ছিল। জন ফার্নান্ডেজ নামে তার আর একজন ওলন্দাজ সেনাপতি ছিল। তার সেনাপতি মদন সিংহের তত্ত্বাবধানে দেশীয় কর্মকাররা কামান, বন্দুক ও গোলাবারুদ তৈরি করত। নারায়ণপুর, হলুদপুর, গুঠিয়া, নথুল্লাবাদ, শায়েস্তাবাদ, কাগাশুরা, কালিজীরা ও ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজার সেনানিবাস ছিল। ভারুকাঠি, নারায়ণপুর, গুঠিয়া, চাঙ্গুরিয়, শঙ্করপুর, সেনেরহাট ও হলুদপুর নিয়ে রাজার প্রধান সেনানিবাস ছিল। এখানে সৈন্যদের ট্রেনিং হতো। মাধবপাশা হতে শায়েস্তবাদ পর্যন্ত সৈন্যদের যাতায়াতের জন্য রাস্তা ছিল্য। সেনানিবাসগুলোতে দীঘি ও দুর্গের ধ্বাংসাবশেষ আছে।

মাধবপাশায় রাজধানী স্থাপন

হোসেনপুরে কয়েক বছর রাজত্ব করার পর রামচন্দ্র রাজধানী মাধবপাশা বা শ্রীনগরে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। বাদলা, বারৈখালী, মাধবপাশা, পাংশা ও প্রতাপপুর নিয়ে তিনি রাজধানী নির্মান করেন এবং নতুন রাজধানীর নাম রাখেন শ্রীনগর। তিনি প্রতাপপুর হতে কালীজিরা নদী পর্যন্ত একটি খাল খনন করেন। এ খাল রাজার বেড় নামে পরিচিত। রাজবাড়ির পূর্ব ও পশ্চিমে রামসাগর ও শুকসাগর নামে দুটি দীঘি খনন করেন। রাজবাড়িতে সুবৃহৎ প্রাসাদ নির্মাণ করেন। রাজবাড়ির পশ্চিমে কোষাঘাটা ছিল। তিনি কাশীপুরে একটি কাঠের দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি স্থান হতে একদল লোক এনে সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তাদের বকসারী সৈন্য বলা হতো। তিনি গুঠিয়া নদীর তীরে নয়াবড়িতে একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। দুর্গটি এখন কেল্লাঘাটা নামে পরিচিত। অনেক ইতিহাসবিদ বলে থাকেন রাজা কন্দর্প নারায়ণ মাধবপাশায় রাজধানী নির্মান করেন। কিন্তু তাদের অনুমান ঠিক নয়। কন্দর্প নারায়ণের মৃত্যুর প্রায় ৪ বছর পর তার পুত্র রামচন্দ্র রায় মাধবপাশা বা শ্রীনগরে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।

জুম্মন খাঁর রিপোর্টে রামচন্দ্র

টোডরমল সুবে বাংলাকে ১৯ টি সরকারে বিভক্ত করে রাজস্ব নির্ধারণের জন্য প্রত্যেক সরকারে কর্মচারী প্রেরণ করেন। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব নিধারণের জন্য কানুনগো জুম্মন খাঁ রাজা রামচন্দ্র রায়ের সাথে রাজধানী হোসেনপুরে সাক্ষাত করেন। জুম্মন খাঁ রামচন্দ্র সম্পর্কে লিখেছেন, “রাজা রামচন্দ্র বালক হলেও তাকে বিশেষ বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। তিনি আমাদের বিশেষ সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা করে বসতে দিলেন এবং উপযুক্ত বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিলেন। তার বিস্তীর্ণ রাজ্য ধনেধান্য পূর্ণ, প্রজারা সুখী , জনগন সুস্থ দেহের অধিকারী এবং সবল। যুবকরা প্রায় প্রত্যহ অপরাহ্নে দলবদ্ধ হয়ে মল্লক্রীড়া করে। অনেককে অস্ত্রশস্ত্র বিষয়ও পারদর্শী দেখা যায়। রাজাও এজন্য সকলকে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।”


ধর্মযাজক ফনসেকার রিপোর্টে রামচন্দ্র

১৫৯৯ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে জেসুইট পাদ্রী মেলকিয়র ফনসেকা (Melchior Fonseca) ও এণ্ড্রু বাওয়েস রাজা রামচন্দ্রের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ফনসেকার সাক্ষাতকারের বিবরণ একটি চিঠিতে লেখা আছে। ফাদার ফনসেকা উক্ত চিঠিতে বলেন, ‘বাকলার রাজা আমাকে আহ্বান করে পাঠান। আমি ও আমার সঙ্গী পর্তুগীজদের নিয়ে তার নিকট উপস্থিত হই । রাজা প্রাসাদে পৌঁছে আমাদের আনার জন্য দু’বার সংবাদ প্রেরণ করেন। আমরা পৌঁছে দেখি রাজা তার সম্মানিত অমাত্য ও সেনাপতিসহ আসনে উপবিষ্ট আছেন। সকলে সুন্দর গালিচার উপর বসে আছে। আমরা দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালাম। রাজা তার সামনের আসনে আমাকে ও আমার সঙ্গীদের বসতে অনুমতি দেন। পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পরে রাজা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোথায় যাবেন।’ আমি উত্তর দিলাম ‘ আমরা আপনার ভাবী শ্বাশুর চন্ডিকানের রাজার নিকট যাব।’ রাজা আমাদের গির্জা নির্মানের আদেশ দিলেন। পরে তিনি দু’জনের বৃত্তির বন্দোবস্ত করেন। বাকলা থেকে চন্ডিকানের পথ এত সুন্দর ও মনোজ্ঞ যে, আমরা কখনও সে দৃশ্য দেখেছি কিনা সন্দেহ। অনেক স্বচ্ছ সলিল নদ-নদী অতিক্রম করে আমরা চলছি। এ সকল নদীকে এদেশে গাঙ বলে থাকে এবং এগুলোর তীর সবুজ বৃক্ষরাজি দ্বারা সুশোভিত। মাঠে ধান রোপণ করা হচ্ছে। গাভীর দল বিচরণ করছে। খালের মধ্যে প্রবেশ করে দেখলাম অনুকরণপ্রিয় বানরগুলো লাফ দিয়ে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাচ্ছে। এ সকল সুন্দর ও উর্বরস্থানে অনেক ইক্ষু জন্মেছে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাতায়াত করা খুবই বিপজ্জনক। কারণ তার মধ্যে অনেক গন্ডার ও হিংস্র জন্তু বিচরণ করে থাকে। আমরা ২০ নভেম্বর চন্ডিকানে উপস্থিত ইই।’ চন্ডিকান বা যশোর রাজ্যে পৌঁছে ফনসেকার ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারী লেখা পত্রে তার ভ্রমণের সাফল্য বর্ণনা করেছেন। ফনসেকা জেসুইট প্রধানের নির্দেশে ও বাকলায় অবস্থানরাত পর্তুগীজ খ্রিস্টানদের অনুরোধে বাকলা হয়ে চন্ডিকানে যান। প্রায় দুই বছর কোন পাদ্রী বাকলার প্রার্থনা পরিচালনা করননি। ফনসেকা চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী হোসেনপুরে রাজা রামচন্দ্রের সাথে সাক্ষাত করেন এবং পর্তুগীজদের প্রার্থনা পরিচালনা করেন। রামচন্দ্র তাদের যাতায়াত খরচ ও পরিচয়পত্র প্রদান করেন। ফনসেকার নির্দেশে পর্তুগীজরা বাকলায় গির্জা নির্মাণ করেন। সম্ভবত রাজধানীতে এ গির্জা নির্মিত হয়। ফনসেকা তার বিবরণে রামচন্দ্রকে আাট বছরের বালক বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু রামচন্দ্রের বুদ্ধির প্রখরতা দেখে মনে হয় তার বয়স তখন কমপক্ষে ১২ বছর ছিল।

রামচন্দ্রের বিয়ে

রাজা কন্দর্প নারাযণ জীবিতকালে তার পুত্র রামচন্দ্রের সাথে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিমলার সহিত বিয়ে ঠিক করেন। রামচন্দ্র ও বিমলা শিশু বিধায় বিবাহের কাজ কন্দর্প নারায়নের জীবৎকালে সমাপ্ত করা সম্ভব করা হয়নি। ১৬০২ খ্রিঃ রাজমাতার নির্দেশে বিয়ের তারিখ ঘোষণা করা হলো। বাকরা ও ঈশ্বরীপুর বিয়ের আনন্দে জনগণ মুখরিত হলো। প্রধান শরীররক্ষক রামমোহন মাল, সেনাপতি রঘুনন্দ, ফার্নেন্ডেজ, প্রধান ভাড় রামাইঢুঙ্গীসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও অমাত্য ৬৪ দাঁড়ের নৌকায় যশোরের রাজধানী ঈশ্বরীপুর অভিমুখে রওনা দেন। তারা গুঠিয়া, সুগন্ধা, পিরোজপুরের দামোদর, খুলানার ভৈরব ও কাপোতাক্ষ হয়ে কোষ নৌকায় প্রদাপাদিত্যের রাজধানীতে পৌঁছেন। খুলনা জোলার সাতক্ষীরা মহকুমার শ্যামনগর থানার ঈশ্বরীপুরে প্রতাপাদিত্যের রাজবাড়ী। প্রতাপাদিত্য তার পাত্রমিত্র নিয়ে রামচন্দ্র ও তার সাথে আগত বরযাত্রীদের সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। রাজা রমচন্দ্রের সাথে প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিমলার বিবাহকার্য সমাধা হলো। আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া পালনান্তে বর-কনে মহাসমারোহে বাসরঘরে নেয়া হলো। কিন্তু একটি সামান্য ঘটনা দুই রাজপরিবারের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে। রামচন্দ্রের ভাড় রামাইঢুঙ্গী স্ত্রীবেশে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে প্রতাপদিত্যের স্ত্রী শরৎকুমারীর সাথে ভাঁড়ামি করে। রামাই ভাঁড়ের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রতাপাদিত্য এই ঘটনা জানতে পেরে জামাতা রামচন্দ্র ও রামাই ভাড়ের শিরচ্ছেদের আদেশ দেন। রাণী এই আদেশ শুনে ভীত হয়ে পড়েন। তিনি পুত্র উদয়াদিত্য ও কন্যা বিমলাকে রামচন্দ্রের জীবননাশের সংবাদ জানিয়ে দেন। বিমলা স্বামীকে তার প্রাণনাশের সংবাদ দেন। উদয়দিত্য, রাণী শরৎকুমারী ও রামমোহন মাল রামচন্দ্রের প্রাণরক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালান। প্রতাপাদিত্য রামচন্দ্র যাতে পালিয়ে না যেতে পারেন তার জন্য সমস্ত পথ বন্ধ করে দেন। উদয়াদিত্য সেদিন যশোরে নাচ দেখতে যাবার ভান করে রামচন্দ্রকে পালকির মশালধারী নিয়োগ করেন। রামমোহন মাল রামচন্দ্রকে ঘাড়ে করে রাজপ্রাসাদের দোতলা থেকে বিমলার সহায়তায় নিচে নামিয়ে আনেন। উয়াদিত্য ও তার বন্ধু সীতারাম রামচন্দ্র ও তার সাথীদের রাজবাড়ি হতে নৌকায় পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। ৬৪ দাঁড়ের নৌকায় আরোহণ করে রামচন্দ্র রাতের অন্ধকারে বাকলায় রওনা দেন। কিন্তু নদীতে বড় বড় গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। রামমোহন মাল গাছের ওপর দিয়ে নৌকা টোনে যমুনা নদী অতিক্রম করে ভৈরব নদীতে পাড়ি দেন। নদীতে পড়ে রামচন্দ্রের সেনাপতি রঘুনন্দ ও নানা ফার্নান্ডেজ কামানের শব্দ করেন। প্রতাপাদিত্য বুঝতে পারলেন রামচন্দ্র পালিয়েছে। রামচন্দ্র নিরাপদে বাকলায় পৌঁছেন। কথিত আছে রামমোহন মাল একা নাকি নৌকা টেনে এনেছেন। অনেক ইতিহাসবিদ এ কাহিনীকে ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, বাকলা রাজ্য দখল করার জন্য প্রতাপাদিত্যে রামচন্দ্রকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। প্রতাপাদিত্যর জীবনী লেখক হরিষচন্দ্র তর্কালঙ্কারের মতে, রামচন্দ্র পর্তুগীজদের ভয়ে যশোরে পালিয়ে যান। প্রতাপাদিত্য এ সুয়োগে তাকে হত্যা করে বাকলা দখল করার পরিকল্পনা করেন। ইতিহাসবিদ সতীশ মিত্র এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু প্রতাপাদিত্যের চরিত্র নিষ্ঠুর ছিল। তিনি পিতৃব্য বসন্ত রায় ও পর্তুগীজ সেনাপতি কার্ভালোকে হত্যা করেন। ১৬০২ খ্রিঃ আরাকান রাজা বাকলা আক্রমণ করে। এ সুযোগে হয়ত প্রতাপাদিত্য জামাতাকে হত্যা করে বাকলা রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলেন।

রামচন্দ্র নববধূকে নিয়ে আসতে না পেরে মনোক্ষুণ্ন হলেন। তার ইচ্ছা ছিল বিমলাকে নিয়ে নতুন রাজধানী শ্রীপুর বা মাধবপাশায় বসবাস করবেন। তিনি শম্ভুচন্দ্র ঘোষের দৌহিত্রীর পাণি গ্রহণ করার দিন ধার্য করেন। ওদিকে প্রতাপাদিত্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে কন্যা বিমলাকে অনেক উপঢৌকনসহ বাকলায় প্রেরণ করেন। বিমলা কোষা নৌকায় উদয়াদিত্যের সাথে হোসেনপুরে পৌঁছেন এবং মাঝির ঘাটের পশ্চিম পাড়ে নৌকা নোঙ্গর করেন। যে স্থানে নৌকা নোঙ্গর করেন সে স্থানে রানীপুর বলে প্রসিদ্ধ। বিমলার নৌকা হোসেনপুর থেকে কালীজিরা ও রাজার বেড়ের মিলন স্থানে নোঙ্গর করে। উদয়াদিত্য ছদ্মবেশে রাজধানীতে গিয়ে রামচন্দ্রের বিয়ের আয়োজন দেখতে পান। তিনি বিমলাকে নিয়ে যশোর ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু বিমলা রাজি হলেন না। উদয়াদিত্য ফিরে গেলেন। বিমলা যেখানে নৌকা নোঙ্গর করেছেন সেখানে শত শত লোক আসতে থাকে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সেখানেক হাট বসে গেল। জনগণ হাটের নাম দিল বৌঠাকুরানীর হাট। বৌঠাকুরানীর হাট নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ রচনা করেন। অবশ্য বৌঠাকুরানী উপন্যাসের অনেক চরিত্র ও কাহিনী কাল্পনিক। বিমলা বৌঠাকুরানীর হাটে চার মাস অতিবাহিত করলেন, তব রাজা রামচন্দ্র তাকে গ্রহণ করলেন না। রানীর সাথে আগত কুলীনগণ বাড়ৈখালী, রৈভদ্রদী ও গুঠিয়ায় বসতি স্থাপন করেন।

রাণী রাজার বেড় হয়ে লাখুটিয়ার নদীতে বজরা নোঙ্গর করেন। লাখুটিয়া তখন ছোট নদী। এখানে লক্ষ লক্ষ টিয়া বাস করত। লক্ষ টিয়া হতে লাখুটিয়া হয়েছে। রাণী জনগণের জলকষ্ট নিবারণের জন্য সার্সী গ্রামে লাখুটিয়া রায়েরবাড়ীর দক্ষিণ পাশে এক বিরাট দীঘি খনন করেন। বিমলা দরিদ্রের দান করেও সুনাম অর্জন করেন। রাজমাতা পুত্রবধূর প্রশংসা শুনে আনন্দিত হন। তিনি রামচন্দ্রকে বিমলাকে গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেন। রাজমাতা নিজে লাখুটিয়ায় এসে বিমলার সাথে সাক্ষাত করেন। বিমলা অনেক স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে রাজমাতাকে প্রণাম করেন। রাণী বিমলাকে আদর করে বুকে তুলে নিলেন। মাতার আদেশ রামচন্দ্র উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি বিমলাকে গ্রহণ করলেন। বিমলা কঠোর তপস্যার দ্বারা স্বামীকে ফিরে পেলেন এবং সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করেন। প্রতাপদিত্য গ্রন্থের লেখক নিখিলনাথ রায় বলেন যে, রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করেননি। বিমলা মনের দুঃখে কাশী চলে যান। এ কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিমলার কাশি যাত্রা’র কথা লিখেছেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের লেখক ব্রজসুন্দর মিত্র বলেন যে, বিমলা কাশী চলে যান। বোহিণী রায় চৌধুরী, বৃন্দবন পুততুন্ড ও সত্যচরণ শাস্ত্রী লিখেছেন যে, রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করেছেন। ঘটক কারিকাদের বিবরণে দেখা যায় রামচন্দ্র বিমলাকে বিয়ে করেছেন। বৃন্দাবন পুততুন্ড বলেন যে, বিমলার গর্ভে কীর্তি নারায়ণ ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে বাসুদেব নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় প্রবাদ-রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করেছেন। কীর্তি নারায়ণ ও বাসুদেব বিমলার পুত্র। রামচন্দ্র দ্বিতীয় কোন বিবাহ করেননি। রামচন্দ্র যে প্রতাপাদিত্যের জামাতা তার অন্যতম প্রমাণ হলো ১৬১১ খ্রিঃ যশোর আক্রমণের সময় মোগল সুবেদার একই সাথে বাকলা আক্রমণ করেন, যাতে বাকলার রাজা তার শ্বশুর প্রতাপাদিত্যকে সাহায্য না করতে পারেন।

রামচন্দ্রের ভুলুয়া জয়

ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণ মানিক্যের সাথে চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের সন্দ্বীপ ও হাতিয়া নিয়ে বিরোধ ছিল। তাদের এই বিরোধ এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে নিয়ে চরমে পৌঁছে। ব্রাহ্মণের নাম দিগ্বিজয় নাথ। তিনি ভুলুয়ার রাজার পুরোহিত ছিলেন। দিগ্বিজয় তার পুত্রসহ শিকারপুরে মন্দিরে পূজা দিতে আসেন। কন্দর্প রারায়ণ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রাজার আহ্বানে তিনি বাবুগঞ্জের খানপুরায় বসতি স্থাপন করেন। তার বাড়ি এখনও গুরুর ভিটা নামে পরিচিত। বর্তমানে অধ্যাপক আবদুল মাজেদ হাওলাদারের বাড়ি এই গুরুর ভিটার ওপর অবস্থিত। লক্ষণ মানিক্য তার গুরুকে বাকলায় রেখে দেয়ার জন্য কন্দর্প নারায়নের ওপর অসন্তুষ্ট হন। তার মৃত্যুর পর লক্ষ্মণ মানিক্য পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে দিগ্বিজয় ভট্টাচার্য, তার পুত্র, গ্রামের সকল লোক ও তাদের মালামাল লুট করে ভুলুয়ায় নিয়ে যান। এই ঘটনা ভুলূয়ার লুট নামে পরিচিত। রামচন্দ্র ঘটনা শুনে খুব রাগন্বিত হলেন। তিনি দূত মারফত লক্ষ্মণ মানিক্যকে ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য লোককে ফেরত দেয়ার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। লক্ষণ মানিক্য বাকলা রাজার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তখন রামচন্দ্র তার সেনাপতি রঘুনন্দ ফৌজদার, নানা ফার্নান্ডেজ, জন গেরী, রামেশ্বর দত্ত, ভগবান দাশ, মদন সিংহ ও শরীররক্ষক রামমোহন মালের নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে ভুলুয়া বা বর্তমান নোয়াখালী যাত্রা করেন।

ভুলুয়া লুটের প্রতিশোধ নেযার জন্য রামচন্দ্র দুই দল পর্তুগীজ, একদল বাঙালী ও একদল বকসারী সৈন্য নিয়ে লক্ষ্মণ মানিক্যের রাজধানীর অনতিদূরে শিবির স্থাপন করেন। লক্ষ্মন মানিক্যের পিতা ছিলেন রাজবল্লভ। লক্ষ্মণমানিক্য একজন বীরযোদ্ধা ও বারভূঁইয়ার অন্যতম নায়ক ছিলেন। তিনি রামচন্দ্রের আগমনের কথা শুনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুই দলে যুদ্ধ শুরু হলো। রামচন্দ্রের সৈন্যরা লক্ষ্মন মানিক্যকে ঘিরে ফেলে। যুদ্ধ করতে করতে লক্ষ্মণ মানিক্য রামচন্দ্রের নৌকায় উঠে পড়েন এবং হঠাৎ পড়ে যান। রামমোহন মাল লক্ষণ মানিক্যকে শৃংখলাবদ্ধ করে ফেলেন। ভুলূয়ার বাহিনী পরাজয়বরণ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। রামচন্দ্র, মদন সিংহ, ফার্নান্ডেজ ও রামমোহন মাল লক্ষ্মন মানিক্যকে বন্দী করে বাকলায় নিয়ে আসেন। ভুলুয়া কিছুদিনের জন্য বাকলা রাজার অধীনে চলে যায়।

বিচারে লক্ষণ মানিক্যের ফাঁসি হলো। কিন্তু রাজমাতার নির্দেশে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ণি। একদিন রামচন্দ্র পুকুরের পাড়ে স্নানের জন্য তৈল মর্দন করছিলেন। লক্ষণ মানিক্য তখন নিকটবর্তী একটি নারিকেল গাছের সাথে বাঁধা ছিলেন। রামচন্দ্রকে হত্যা করার জন্য তিনি নারিকেল গাছটিকে আস্তে আস্তে ফেলে দেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে গাছটি রামচন্দ্রের উপর পড়েনি। রাজমাতা এ ঘটনা দেখে তখনই লক্ষ্মণ মনিক্যকে হত্যার নির্দেশ দেন। লক্ষণ মানিক্যের মস্তক দ্বিখণ্ডিত হলো। লক্ষণ মানিক্যের হত্যা নিয়ে ইতিহাসবিদরা রাজা রামচন্দ্রকে দোষারোপ করে থাকেন। ভুলুয়ার ইতিহাস লেখক বলেন যে, রামচন্দ্র ভুলুয়ায় এসে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং জল খেলার সময় তাকে কৌশলে বন্দী করে বাকলায় নিয়ে হত্যা করেন। ইতিহাসবিদ আনন্দনাথ রায় বলেন যে, লক্ষ্মণ মানিক্য মগ, পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেন। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। লক্ষ্মণ মানিক্যের সাথে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের সীমান্ত নিয়ে বহুদিন ধরে শত্রুতা ছিল। পরিশেষে ভুলুয়ার লুটকে উপলক্ষ্য করে ভুলুয়ার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লক্ষ্মণ মানিক্য পরাজয় বরণ করেন এবং তাকে বন্দী অবস্থায় রাজধানী, মাধবপাশায় হত্যা করা হয়া তিনি রাজা রামচন্দ্রকে হত্যা করার চেষ্টা না করলে তাকে হত্যা করা হতো না। লক্ষ্মণ মানিক্যের পরাজয় ও হত্যা বারভূঁইয়াদের শক্তিক দুর্বল করে দেয় এবং মগ-পর্তুগীজদের আক্রমন বৃদ্ধি পায়। লক্ষ্মণ মানিক্যের মৃত্যুর পর তার পুত্র অনন্তমানিক্য ভুলুয়ার রাজা হন।


মোগলদের সাথে যুদ্ধ ও চন্দ্রদ্বীপের স্বাধীনতার অবসান

রাজা মানসিংহের সাথে সাথে মৈত্রি চুক্তি করে কন্দর্প নারায়ণ রাজত্ব করতেন। এই চুক্তি ভেঙ্গে রাজা রামচন্দ্র সোনারগাঁওয়ের মুসা খাঁ ও যশোরের প্রতাপাদিত্যের মতো খুব সম্ভব ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে বাকলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রামচন্দ্র শ্বশুর প্রতাপাদিত্যের সাথে একত্রিত হয়ে মোগলদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বিরাট সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। বাকলার হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। অনেক পলাতক পাঠান রামচন্দ্রের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন মীরবহর কৃষ্ণ জীবন। শত শত কিস্তি নৌকা নির্মিত হয়। বরিশালের ঢালী, মাল, পাইক প্রভৃতি উপাধিধারী লোকদের পূর্বপুরুষ রামচন্দ্রের বাহিনীতে ছিল।

১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে জাহাঙ্গীরের সুবেদার ইসলাম খাঁ সেনাপতি এনায়েত খাঁ ও মির্জা নাথানের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী যশোর অভিযানে প্রেরণ করেন। অপর একটি বহিনী সৈয়দ হকিম, সৈয়দ কাশু ও ভূষনের রাজা শত্রুজিতের নেতৃত্বে বাকলায় প্রেরণ করেন। বাকলার রাজা রামচন্দ্র যাতে যুদ্ধে তার সৈন্যবহিনী দিয়ে প্রতাপাদিত্যকে যাতে সাহায্য করতে না পারে সে জন্য একই সাথে ইসলাম খাঁ যশোর ও বাকলা রাজ্য আক্রমণ করেন। ইসলাম খাঁ রামচন্দ্রকে আত্মসমর্পন ও মোগলদের অধীনতা স্বীকার করার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। রামচন্দ্র ইসলাম খাঁর পত্র প্রত্যাখান করে বাকলার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সৈন্য সমাবেশ করলেন। রামচন্দ্রের সৈন্যবহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল হলুদপুর, নারায়ণপুর, কাশীপুর, নথুল্লাবাদ, কাগাশুরা ও ক্ষুদ্রকাঠী। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোগলদের সাথে যুদ্ধ কোন স্থানে হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা যায়না। তবে যুদ্ধে কয়েক জায়গায় হয়েছে। নৌযুদ্ধ হয়েছে শায়েস্তাবাদ, বরিশাল ও জাহাপুর নদীতে। সুজাবাদ হতে ক্ষুদ্রকাঠি পর্যন্ত নদীর তীরে নৌবাহিনী কামানসহ প্রস্তুত ছিল। অশ্বারোহী, হস্তী ও পদাতিক বাহিনীর প্রধান যুদ্ধ হয়েছিল বাবুগঞ্জ থানার ক্ষুদ্রকাঠি ও খানপুরার নিকটস্থ সংগ্রামে।

রামচন্দ্র প্রায় এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে মোগলদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ন হন। পর্তুগীজদের সেনাপতি জন গেরী ভারী কামান ও বন্দুক নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ১০ হাজর সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সেনাপতি, নানা ফার্নান্ডেজ, মীরবহর জীবনকৃষ্ণ রায় প্রমুখ সেনাপতি তাদের স্ব স্ব বহিনী নিয়ে মোগল বহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজা রামচন্দ্র নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পাশেই প্রধানমন্ত্রী সারাই আচার্য রাজাকে পরামর্শ দিচ্ছেন। মোগলা সেনাপতি সৈয়দ হাকিম, সৈয়দ কাশু, মির্জা নুরুদ্দীন, রাজা শত্রুজিত ও ইসলাম কুলি নৌবহর , তিন হাজার বন্দুকধারী সৈন্য, কুড়িটি হাতি ও এক বিপুল বাহিনী নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী চন্দ্রদ্বীপ-বাকলার সৈন্য বাহিনীকে আক্রমন করে। ওলন্দাজ ও পর্তুগীজ মেনাদের কামান ও গোলার আঘাতে মোগল বহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। মোগলদের নৌবাহিনী রামচন্দ্রের বাহিনীর সাথে পেরে উঠতে পারেনি। মীরবহর জীবনকৃষ্ণ জাহাপুর ও কীর্তনখোলা নদীতে মোগল বাহিনীকে তীব্রভাবে আক্রমন করেন। রাজার হস্তী বহিনী মোগলদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। রামমোহন মাল অসীম সাহসে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

মোগল সেনাপতি সৈয়দ হাকিম ভেবেছিলেন রামচন্দ্র প্রথম দিনের যুদ্ধেই আত্মসমর্পন করবেন। কিন্তু কয়েকদিন যুদ্ধে করে দেখলেন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের বীর সেনাবাহিনী মোগল বাহিনীর চেয়ে সাহসী ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। তাই তিনি ও রাজা শত্রুজিত গোপনে রাজচন্দ্রের মাতাকে সন্ধির প্রস্তাব দিতে দূত প্রেরণ করেন। রাজমাতা মোগলদের ভক্ত। তিনি পুত্র রামচন্দ্রকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেন। রামচন্দ্র তার মাতাকে বললেন, বাকলা সেনাবাহিনীর জয় সুনিশ্চিত। সুতরাং মোগলদের নিকট আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি যুদ্ধ চালিযে যাবেন। রাজমাতা পুনরায় রামচন্দ্রকে বললেন, তিনি যদি যুদ্ধ বন্ধ না করেন তবে তিনি বিষপাণে আত্মহত্যা করবেন। ৭ দিন ধরে রামচন্দ্র অবিরাম যুদ্ধ করছেন। হাজার হাজার সৈন্য বাকলার স্বাধীনাতার যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। মাতৃভক্ত রামচন্দ্র বাধ্য হয়ে মোগল সেনাপতির নিকট সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন। এক সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সঙগ্রাম শেষ হলো। মোগল সেনাপতি রাজা রামচন্দ্রকে বন্দী করলেন। শত্রুজীত রামচন্দ্রকে নিয়ে ঢাকায় ইসলাম খাঁর নিকট যান। ইসলাম খা রামচন্দ্রকে তার নৌবহর ব্যয় নির্বাহের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেন। অবশিষ্ট অঞ্চল নতুন অনেককে জায়গীর হিসাবে প্রদান করেন। রামচন্দ্র মোগলের অধীন হয়ে যান এবং তার রাজ্য খন্ড-বিখন্ড হয়।

মোগল বাহিনীর সাথে রামচন্দ্রের এই যুদ্ধ ‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিত। বাবুগঞ্জ থানায় যে জায়গায় স্থলযুদ্ধ হয়েছিল সেই স্থানের নামকরণও হয়েছিল ‘সংগ্রাম’ নামে। সংগ্রাম নামের এই গ্রামটি ১৯০৩ সালের জরিপে ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামের মধ্যে লীন হয়ে যায়। তবে খানপুরা খাল থেকে বাবুগঞ্জ সার্কেল অফিস পর্যন্ত খালটিকে এখনো সংগ্রামের খাল বলা হয়। এই সংগ্রামের ফলে চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের তিনশো বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে উলফৎ গাজী মোগলদের সাহায্য করেছিল। তাই স¤্রাট জাহাঙ্গীর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে চন্দ্রদ্বীপ থেকে সৃষ্ট নাজিরপুর পরগনা প্রদান করেন। গৌরনদীর নলচিড়ার মিয়ারা উলফৎ গাজীর বংশধর। জাহাঙ্গীর চন্দ্রদ্বীপ থেকে সৃষ্ট আরেকটি পরগণা সেলিমাবাদ দান করেন মদনমোহন রায়কে। ১৬১১ থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপ স¤্রাট জাহাঙ্গীরের অধীন ছিল।

মগ পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে রামচন্দ্রের যুদ্ধ

রাজা রামচন্দ্র মগ পর্তুগিজদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছিলেন। পর্তুগীজদের সাথে রাজা পরমানন্দের মৈত্রী চুক্তি হয়েছিল। অথচ সেই পর্তুগিজরা ১৬০২ সালে কার্ভালোর নেতৃত্বে চন্দ্রদ্বীপের অংশ সন্দ্বীপ দখল করে নেয়। রামচন্দ্র তখন বিবাহ উপলক্ষে প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরীপুরে ছিলেন। তখন আরাকান রাজা যুদ্ধে কার্ভালোকে পরাজিত করে অগ্রসর হয় এবং বাকলার শাহবাজপুরে আক্রমণ ও লুটতরাজ করে পালিয়ে যায়। ১৬০৮ সালে পর্তুগিজ সেনাপতি গঞ্জালেস মগদের সাথে নিয়ে বাকলা আক্রমণ করে শাহবাজপুর ও পাতিলভাঙ্গা দখল করে নেয়। এমনকি তারা কালিজিরা নদী দিয়ে রাজধানী মাধবপাশার দিকেও অগ্রসর হয়। রাজা রামচন্দ্র তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে মগ-পর্তুগিজদেরকে তাড়িয়ে দেন। এই যুদ্ধে মগদের একখানা যুদ্ধ জাহাজ গুঠিয়ানদীর মোহনায় তলিয়ে যায়। কয়েক বছর পূর্বেও নাকি এই জাহাজের মাস্তুল দেখা যেত।


উপসংহার

রাজা রামচন্দ্র ১৫৯৮ থেকে ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন তবে পুরো সময় স্বাধীন রাজা হিসেবে নয়। ১৬১১ খ্রিঃ রামচন্দ্রের পরাজয়ের পর চন্দ্রদ্বীপ রাজা সরাসরি মোগল শাসনধীনে চলে যায় এবং অনেক পরগণায় বিভিক্ত হয়। তার মধ্যে শুধু চন্দ্রদ্বীপ পরগণা রামচন্দ্রের রাজত্ব রূপে থাকে। বাকিটা ইসলাম খা বা সম্রাট জাহাঙ্গীর অন্যদের মাঝে বন্টন করে দেন। উল্লেখ্য যে, আকবরের সময় বরিশাল বিভাগে মাত্র ৬টি পরগণা ছিল এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় ২৮টি পরগণা ছিল। স্বাধীন রাজা রামচন্দ্র শেষ জীবনে চন্দ্রদ্বীপ পরগণার জমিদার হিসাবে ১৬৬৮ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে মোগল স¤্রাটের অধীন জমিদার হলেও তাদের নামের সাথে ‘রাজা’র ব্যবহার বংশানুক্রমে স্থায়ী ছিল। তিনি বিচক্ষণ শাসক ছিলেন। টোডরমলের পদ্ধতিতে তিনি দেওয়ানি কার্য পরিচালনা করতেন। তার সময় বাকলা থেকে কাপড় ও লবণ রপ্তানি হতো।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খণ্ড)