রামচন্দ্র ও লক্ষণ মাণিক্য যুদ্ধ

Barisalpedia থেকে

ঐতিহাসিকভাবে চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্র বসুর সাথে ভুলুয়া অর্থাৎ নোয়াখালির রাজা লক্ষণ মাণিক্যের এক যুদ্ধ হয়েছিল সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে। যুদ্ধটি বেধেছিল এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে পাওয়ার মতো তূচ্ছ বিষয় নিয়ে।

ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণ মানিক্যের সাথে চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের সন্দ্বীপ ও হাতিয়া নিয়ে বিরোধ ছিল। তাদের এই বিরোধ এক ব্রাহ্মণ পন্ডিতকে নিয়ে চরমে পৌঁছে। ব্রাহ্মণের নাম দিগ্বিজয় নাথ। তিনি ভুলুয়ার রাজার পুরোহিত ছিলেন। দিগ্বিজয় তার পুত্রসহ শিকারপুরে মন্দিরে পূজা দিতে আসেন। কন্দর্প রারায়ণ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রাজার আহ্বানে তিনি বাবুগঞ্জের খানপুরায় বসতি স্থাপন করেন। তার বাড়ি এখনও গুরুর ভিটা নামে পরিচিত। বর্তমানে অধ্যাপক আবদুল মাজেদ হাওলাদারের বাড়ি এই গুরুর ভিটার ওপর অবস্থিত। লক্ষণ মানিক্য তার গুরুকে বাকলায় রেখে দেয়ার জন্য কন্দর্প নারায়নের ওপর অসন্তুষ্ট হন। তার মৃত্যুর পর লক্ষ্মণ মানিক্য পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে দিগ্বিজয় ভট্টাচার্য, তার পুত্র, গ্রামের সকল লোক ও তাদের মালামাল লুট করে ভুলুয়ায় নিয়ে যান। এই ঘটনা ভুলূয়ার লুট নামে পরিচিত। রামচন্দ্র ঘটনা শুনে খুব রাগন্বিত হলেন। তিনি দূত মারফত লক্ষ্মণ মানিক্যকে ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য লোককে ফেরত দেয়ার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। লক্ষণ মানিক্য বাকলা রাজার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তখন রামচন্দ্র তার সেনাপতি রঘুনন্দ ফৌজদার, নানা ফার্নান্ডেজ, জন গেরী, রামেশ্বর দত্ত, ভগবান দাশ, মদন সিংহ ও শরীররক্ষক রামমোহন মালের নেতৃত্বে এক বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে ভুলুয়া বা বর্তমান নোয়াখালী যাত্রা করেন।

ভুলুয়া লুটের প্রতিশোধ নেযার জন্য রামচন্দ্র দুই দল পর্তুগীজ, একদল বাঙালী ও একদল বকসারী সৈন্য নিয়ে লক্ষ্মণ মানিক্যের রাজধানীর অনতিদূরে শিবির স্থাপন করেন। লক্ষ্মন মানিক্যের পিতা ছিলেন রাজবল্লভ। লক্ষ্মণমানিক্য একজন বীরযোদ্ধা ও বারভূঁইয়ার অন্যতম নায়ক ছিলেন। তিনি রামচন্দ্রের আগমনের কথা শুনে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন। দুই দলে যুদ্ধ শুরু হলো। রামচন্দ্রের সৈন্যরা লক্ষ্মন মানিক্যকে ঘিরে ফেলে। যুদ্ধ করতে করতে লক্ষ্মণ মানিক্য রামচন্দ্রের নৌকায় উঠে পড়েন এবং হঠাৎ পড়ে যান। রামমোহন মাল লক্ষণ মানিক্যকে শৃংখলাবদ্ধ করে ফেলেন। ভুলূয়ার বাহিনী পরাজয়বরণ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। রামচন্দ্র, মদন সিংহ, ফার্নান্ডেজ ও রামমোহন মাল লক্ষ্মন মানিক্যকে বন্দী করে বাকলায় নিয়ে আসেন। ভুলুয়া কিছুদিনের জন্য বাকলা রাজার অধীনে চলে যায়।

বিচারে লক্ষণ মানিক্যের ফাঁসি হলো। কিন্তু রাজমাতার নির্দেশে তার মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়ণি। একদিন রামচন্দ্র পুকুরের পাড়ে স্নানের জন্য তৈল মর্দন করছিলেন। লক্ষণ মানিক্য তখন নিকটবর্তী একটি নারিকেল গাছের সাথে বাঁধা ছিলেন। রামচন্দ্রকে হত্যা করার জন্য তিনি নারিকেল গাছটিকে আস্তে আস্তে ফেলে দেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে গাছটি রামচন্দ্রের উপর পড়েনি। রাজমাতা এ ঘটনা দেখে তখনই লক্ষ্মণ মনিক্যকে হত্যার নির্দেশ দেন। লক্ষণ মানিক্যের মস্তক দ্বিখণ্ডিত হলো। লক্ষণ মানিক্যের হত্যা নিয়ে ইতিহাসবিদরা রাজা রামচন্দ্রকে দোষারোপ করে থাকেন। ভুলুয়ার ইতিহাস লেখক বলেন যে, রামচন্দ্র ভুলুয়ায় এসে সন্ধির প্রস্তাব দেন এবং জল খেলার সময় তাকে কৌশলে বন্দী করে বাকলায় নিয়ে হত্যা করেন। ইতিহাসবিদ আনন্দনাথ রায় বলেন যে, লক্ষ্মণ মানিক্য মগ, পর্তুগীজদের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দেন। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। লক্ষ্মণ মানিক্যের সাথে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের সীমান্ত নিয়ে বহুদিন ধরে শত্রুতা ছিল। পরিশেষে ভুলুয়ার লুটকে উপলক্ষ্য করে ভুলুয়ার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লক্ষ্মণ মানিক্য পরাজয় বরণ করেন এবং তাকে বন্দী অবস্থায় রাজধানী, মাধবপাশায় হত্যা করা হয়া তিনি রাজা রামচন্দ্রকে হত্যা করার চেষ্টা না করলে তাকে হত্যা করা হতো না। লক্ষ্মণ মানিক্যের পরাজয় ও হত্যা বারভূঁইয়াদের শক্তিক দুর্বল করে দেয় এবং মগ-পর্তুগীজদের আক্রমন বৃদ্ধি পায়। লক্ষ্মণ মানিক্যের মৃত্যুর পর তার পুত্র অনন্তমানিক্য ভুলুয়ার রাজা হন।