রাজা রামচন্দ্রের বিয়ে

Barisalpedia থেকে

চন্দ্রদ্বীপের রাজা রামচন্দ্রের সাথে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের মেয়ে বিমলার বিয়ের ঘটনাটি ঐতিহাসিকভাবে কৌতূহলপ্রদ। এই বিয়ের ঘটনাবলির একাংশ নিয়ে এমনকি রবীন্দ্রনাথ প্রায় তিন শ বছর পরে লিখেছেন তার উপন্যাস ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’।

রাজা কন্দর্প নারাযণ জীবিতকালে তার পুত্র রামচন্দ্রের সাথে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিমলার সহিত বিয়ে ঠিক করেন। রামচন্দ্র ও বিমলা শিশু বিধায় বিবাহের কাজ কন্দর্প নারায়নের জীবৎকালে সমাপ্ত করা সম্ভব করা হয়নি। ১৬০২ খ্রিঃ রাজমাতার নির্দেশে বিয়ের তারিখ ঘোষণা করা হলো। বাকরা ও ঈশ্বরীপুর বিয়ের আনন্দে জনগণ মুখরিত হলো। প্রধান শরীররক্ষক রামমোহন মাল, সেনাপতি রঘুনন্দ, ফার্নেন্ডেজ, প্রধান ভাড় রামাইঢুঙ্গীসহ অনেক আত্মীয়স্বজন ও অমাত্য ৬৪ দাঁড়ের নৌকায় যশোরের রাজধানী ঈশ্বরীপুর অভিমুখে রওনা দেন। তারা গুঠিয়া, সুগন্ধা, পিরোজপুরের দামোদর, খুলানার ভৈরব ও কাপোতাক্ষ হয়ে কোষ নৌকায় প্রদাপাদিত্যের রাজধানীতে পৌঁছেন। খুলনা জোলার সাতক্ষীরা মহকুমার শ্যামনগর থানার ঈশ্বরীপুরে প্রতাপাদিত্যের রাজবাড়ী। প্রতাপাদিত্য তার পাত্রমিত্র নিয়ে রামচন্দ্র ও তার সাথে আগত বরযাত্রীদের সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। রাজা রমচন্দ্রের সাথে প্রতাপাদিত্যের কন্যা বিমলার বিবাহকার্য সমাধা হলো। আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া পালনান্তে বর-কনে মহাসমারোহে বাসরঘরে নেয়া হলো। কিন্তু একটি সামান্য ঘটনা দুই রাজপরিবারের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে। রামচন্দ্রের ভাড় রামাইঢুঙ্গী স্ত্রীবেশে অন্তঃপুরে প্রবেশ করে প্রতাপদিত্যের স্ত্রী শরৎকুমারীর সাথে ভাঁড়ামি করে। রামাই ভাঁড়ের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রতাপাদিত্য এই ঘটনা জানতে পেরে জামাতা রামচন্দ্র ও রামাই ভাড়ের শিরচ্ছেদের আদেশ দেন। রাণী এই আদেশ শুনে ভীত হয়ে পড়েন। তিনি পুত্র উদয়াদিত্য ও কন্যা বিমলাকে রামচন্দ্রের জীবননাশের সংবাদ জানিয়ে দেন। বিমলা স্বামীকে তার প্রাণনাশের সংবাদ দেন। উদয়দিত্য, রাণী শরৎকুমারী ও রামমোহন মাল রামচন্দ্রের প্রাণরক্ষার জন্য প্রচেষ্টা চালান। প্রতাপাদিত্য রামচন্দ্র যাতে পালিয়ে না যেতে পারেন তার জন্য সমস্ত পথ বন্ধ করে দেন। উদয়াদিত্য সেদিন যশোরে নাচ দেখতে যাবার ভান করে রামচন্দ্রকে পালকির মশালধারী নিয়োগ করেন। রামমোহন মাল রামচন্দ্রকে ঘাড়ে করে রাজপ্রাসাদের দোতলা থেকে বিমলার সহায়তায় নিচে নামিয়ে আনেন। উয়াদিত্য ও তার বন্ধু সীতারাম রামচন্দ্র ও তার সাথীদের রাজবাড়ি হতে নৌকায় পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। ৬৪ দাঁড়ের নৌকায় আরোহণ করে রামচন্দ্র রাতের অন্ধকারে বাকলায় রওনা দেন। কিন্তু নদীতে বড় বড় গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। রামমোহন মাল গাছের ওপর দিয়ে নৌকা টোনে যমুনা নদী অতিক্রম করে ভৈরব নদীতে পাড়ি দেন। নদীতে পড়ে রামচন্দ্রের সেনাপতি রঘুনন্দ ও নানা ফার্নান্ডেজ কামানের শব্দ করেন। প্রতাপাদিত্য বুঝতে পারলেন রামচন্দ্র পালিয়েছে। রামচন্দ্র নিরাপদে বাকলায় পৌঁছেন। কথিত আছে রামমোহন মাল একা নাকি নৌকা টেনে এনেছেন। অনেক ইতিহাসবিদ এ কাহিনীকে ভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন। তাদের মতে, বাকলা রাজ্য দখল করার জন্য প্রতাপাদিত্যে রামচন্দ্রকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। প্রতাপাদিত্যর জীবনী লেখক হরিষচন্দ্র তর্কালঙ্কারের মতে, রামচন্দ্র পর্তুগীজদের ভয়ে যশোরে পালিয়ে যান। প্রতাপাদিত্য এ সুয়োগে তাকে হত্যা করে বাকলা দখল করার পরিকল্পনা করেন। ইতিহাসবিদ সতীশ মিত্র এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু প্রতাপাদিত্যের চরিত্র নিষ্ঠুর ছিল। তিনি পিতৃব্য বসন্ত রায় ও পর্তুগীজ সেনাপতি কার্ভালোকে হত্যা করেন। ১৬০২ খ্রিঃ আরাকান রাজা বাকলা আক্রমণ করে। এ সুযোগে হয়ত প্রতাপাদিত্য জামাতাকে হত্যা করে বাকলা রাজ্য দখল করতে চেয়েছিলেন।

রামচন্দ্র নববধূকে নিয়ে আসতে না পেরে মনোক্ষুণ্ন হলেন। তার ইচ্ছা ছিল বিমলাকে নিয়ে নতুন রাজধানী শ্রীপুর বা মাধবপাশায় বসবাস করবেন। তিনি শম্ভুচন্দ্র ঘোষের দৌহিত্রীর পাণি গ্রহণ করার দিন ধার্য করেন। ওদিকে প্রতাপাদিত্য নিজের ভুল বুঝতে পেরে কন্যা বিমলাকে অনেক উপঢৌকনসহ বাকলায় প্রেরণ করেন। বিমলা কোষা নৌকায় উদয়াদিত্যের সাথে হোসেনপুরে পৌঁছেন এবং মাঝির ঘাটের পশ্চিম পাড়ে নৌকা নোঙ্গর করেন। যে স্থানে নৌকা নোঙ্গর করেন সে স্থানে রানীপুর বলে প্রসিদ্ধ। বিমলার নৌকা হোসেনপুর থেকে কালীজিরা ও রাজার বেড়ের মিলন স্থানে নোঙ্গর করে। উদয়াদিত্য ছদ্মবেশে রাজধানীতে গিয়ে রামচন্দ্রের বিয়ের আয়োজন দেখতে পান। তিনি বিমলাকে নিয়ে যশোর ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু বিমলা রাজি হলেন না। উদয়াদিত্য ফিরে গেলেন। বিমলা যেখানে নৌকা নোঙ্গর করেছেন সেখানে শত শত লোক আসতে থাকে। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সেখানেক হাট বসে গেল। জনগণ হাটের নাম দিল বৌঠাকুরানীর হাট। বৌঠাকুরানীর হাট নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ রচনা করেন। অবশ্য বৌঠাকুরানী উপন্যাসের অনেক চরিত্র ও কাহিনী কাল্পনিক। বিমলা বৌঠাকুরানীর হাটে চার মাস অতিবাহিত করলেন, তব রাজা রামচন্দ্র তাকে গ্রহণ করলেন না। রানীর সাথে আগত কুলীনগণ বাড়ৈখালী, রৈভদ্রদী ও গুঠিয়ায় বসতি স্থাপন করেন।

রাণী রাজার বেড় হয়ে লাখুটিয়ার নদীতে বজরা নোঙ্গর করেন। লাখুটিয়া তখন ছোট নদী। এখানে লক্ষ লক্ষ টিয়া বাস করত। লক্ষ টিয়া হতে লাখুটিয়া হয়েছে। রাণী জনগণের জলকষ্ট নিবারণের জন্য সার্সী গ্রামে লাখুটিয়া রায়েরবাড়ীর দক্ষিণ পাশে এক বিরাট দীঘি খনন করেন। বিমলা দরিদ্রের দান করেও সুনাম অর্জন করেন। রাজমাতা পুত্রবধূর প্রশংসা শুনে আনন্দিত হন। তিনি রামচন্দ্রকে বিমলাকে গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেন। রাজমাতা নিজে লাখুটিয়ায় এসে বিমলার সাথে সাক্ষাত করেন। বিমলা অনেক স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে রাজমাতাকে প্রণাম করেন। রাণী বিমলাকে আদর করে বুকে তুলে নিলেন। মাতার আদেশ রামচন্দ্র উপেক্ষা করতে পারলেন না। তিনি বিমলাকে গ্রহণ করলেন। বিমলা কঠোর তপস্যার দ্বারা স্বামীকে ফিরে পেলেন এবং সুখী দাম্পত্য জীবন যাপন করেন। প্রতাপদিত্য গ্রন্থের লেখক নিখিলনাথ রায় বলেন যে, রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করেননি। বিমলা মনের দুঃখে কাশী চলে যান। এ কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিমলার কাশি যাত্রা’র কথা লিখেছেন। চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের লেখক ব্রজসুন্দর মিত্র বলেন যে, বিমলা কাশী চলে যান। বোহিণী রায় চৌধুরী, বৃন্দবন পুততুন্ড ও সত্যচরণ শাস্ত্রী লিখেছেন যে, রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করেছেন। ঘটক কারিকাদের বিবরণে দেখা যায় রামচন্দ্র বিমলাকে বিয়ে করেছেন। বৃন্দাবন পুততুন্ড বলেন যে, বিমলার গর্ভে কীর্তি নারায়ণ ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে বাসুদেব নারায়ণ জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় প্রবাদ-রামচন্দ্র বিমলাকে গ্রহণ করেছেন। কীর্তি নারায়ণ ও বাসুদেব বিমলার পুত্র। রামচন্দ্র দ্বিতীয় কোন বিবাহ করেননি। রামচন্দ্র যে প্রতাপাদিত্যের জামাতা তার অন্যতম প্রমাণ হলো ১৬১১ খ্রিঃ যশোর আক্রমণের সময় মোগল সুবেদার একই সাথে বাকলা আক্রমণ করেন, যাতে বাকলার রাজা তার শ্বশুর প্রতাপাদিত্যকে সাহায্য না করতে পারেন।