"মোগল আমলে বাকলার সামাজিক অবস্থা"-এর বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

Barisalpedia থেকে
(" == শাসন ব্যবস্থা == ১৫৭৬ খ্রিঃ সম্রাট আকবর বাংলাদেশ দখল করে..." দিয়ে পাতা তৈরি)
 
(পাতা খালি করা হয়েছে)
 
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
  
== শাসন ব্যবস্থা ==
 
 
১৫৭৬ খ্রিঃ সম্রাট আকবর বাংলাদেশ দখল করেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে মোগল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। বারভূঁইয়ারা ১৫৭৬-১৬১২ খ্রি. পর্যন্ত স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করেন। ১৬১২ খ্রি. সুবাদার ইসলাম খাঁ বারভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৬১১ খ্রি. চন্দ্রদ্বীপে রাজা রামচন্দ্র রায় মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে অপূর্ব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করেন। তার স্বদেশপ্রেমিকতা ও স্বাধীনতা বোধ বরিশাল বিভাগের জনগণের মনে চিরদিন উজ্জ্বল রেখাপাত করবে। ১৫৭৬-১৬১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা জগদানন্দ, কন্দর্প নারায়ণ ও রামচন্দ্র বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ স্বাধীনভাবে শাসন করেন। তাদের প্রধান দেওয়ান ছিলেন সরাই আচার্য্য এবং প্রধান সেনাপতি ছিলেন রঘুনন্দ ফৌজদার। শাসন কার্যে তারা সেন ও মোগল উভয় পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। রাজা কন্দর্প নারায়ণের সাথে রাজা মানসিংহের বন্ধুত্ব হলে সরকার বাকলায় টোডরমলের রাজস্ব জরিপ শুরু হয় এবং মোগল কর্মচারী কানুনগো জীম্মন খাঁ বাকলার রাজা রামচন্দ্রের সাথে সাক্ষাত করেন। রাজা রামচন্দ্রের পরাজয়ের পর বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ মোগল শাসনাধীনে চলে যায় এবং এ অঞ্চলের ১৬১২ খ্রিঃ হতে মোগল শাসন শুরু হয়। ১৬১২-১৭৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ মোগল এবঙ ১৭৪০-১৭৪৬ খ্রিঃ পর্যন্ত নবাবী শাসন অধীনে ছিল। মোগল আমলে সুবাদার সুবেবাংলার প্রধান শাসনকর্তা ছিলেন। নবাবী আমলে বাংলার কোন সুবাদার ছিল না। নবাব তার কর্মচারীদের নিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতেন। সুবাদার ও নবাবের অধীনে দেওয়ান, মীর বকসী, মীর বহর, মুফতি, কাজী প্রভৃতি কর্মচারী ছিল। স¤্রাট আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডরমল বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেন। সরকারকে কয়েকটি পরগণা, পরগণাকে কতকগুলো মহল ও মহলকে কতকগুলো মৌজা বা কিসমতে ভাগ করা হয়। পরগণা বাকলা-ইসলামপুর, শ্রীরামপুর, ইদিলপুর ও শাহজাদপুর নিয়ে সরকার বাকলা গঠিত হয়। পরগণা সেলিমাবাদ সরকার খলিফাতাবাদের অধীন এবং শাহবাজপুর পরগণা সরকার ফতেহাবাদের অধীনে ছিল। ভোলা মহকুমা, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও মুলাদী সরকার ফতেহাবাদ ও পিরোজপুর, কাউখালী, নাজিরপুর, স্বরূপকাঠি, রাজাপুর ঝালকাঠির কতকাংশ সরকার খলিফাতাবাদের অন্তর্ভূক্ত ছিল। পটুয়াখালী জেলা ও বাকেরগঞ্জ জেলার অধিকাংশ সরকার বাকলার অধীন ছিল। প্রত্যেক সরকার একজন ফৌজদারের শাসনাধীনে ছিল। ফৌজদার সরকারের শাসন ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করত। খুব সম্ভব ছবি খাঁ স¤্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাকলার ফৌজদার ছিলেন। তিনি ১৬১৮ খ্রি. বাকলায় আগমন করেন এবং দীর্ঘদিন ধরে এ অঞ্চল শাসন করেন। মনে হয় ছবি খাঁর মৃত্যুর পর তার পুত্র ও পৌত্র তার জনকল্যাণমূলক কাজের ধারা অব্যাহত রাখেন। তার পরে কোন ফৌজদার বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে স্থায়ীভাবে বাস করছেন কিনা তা জানা নেই। কয়েকজন মোগল ও নবাব কর্মচারী সাময়িকভাবে বাকলায় অবস্থান করেন। শাহবাজ খাঁ, বুজুর্গ উমেদ খাঁ, আগাবাকের খাঁ, আগাসাদেক খাঁ, বৈরাম খাঁ বা বুরুম খাঁ প্রমুখ বিভিন্ন সময় বাকলা শাসন করেন। তাদের মধ্যে আগাবাকের দীর্ঘদিন বাকলার শাসন কার্য পরিচালনা করেন। মজুমদাররা সরকারের রাজস্বের দায়িত্বে ছিলেন। চাখারের মেহেদী ও শরফুদ্দীন মজুমদার মোগল স¤্রাট ও নবাবের পক্ষে সরকার বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের জমিদারদের নিকট হতে কর আদায় করতেন। কসবা, গোলাবাড়ী বা বাকেরগঞ্জ ও চাখার মোগল কর্মচারীদের শাসনকেন্দ্র ছিল।
 
 
মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলাকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করেন। সরকার বাকলা ও বাজুয়া চাকলা জাহাঙ্গীর নগর এবং সরকার খলিফাতাবাদ ও ফতেহাবাদ চাকলা যশোরের অধীনে ছিল। ফৌজদার চাকলার শাসনকর্তা ছিলেন। বাকলার ফৌজদারা প্রায়ই ঢাকায় বসবাস করতেন। আমিন পরগণার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি আমিন, কানুনগো, সিকদার প্রমুখ কর্মচারী নিয়ে রাজস্ব আদায় করতেন। চৌকিদার ও দফাদাররা মহল্লার শান্তি রক্ষা করতেন। মুর্শিদ কুলী খাঁ ও পরবর্তী নবাবরা বিদ্রোহী প্রজাদের দমন ও শান্তি রক্ষার জন্য কয়েকজন সর্দার নিযুক্ত করেন। নলছিটি থানার নান্দিকাঠির জনাব সদর উদ্দীন উকিলের পূর্বপুরুষ মহদি খাঁ নবাব কর্তৃক সর্দার নিযুক্ত হয়ে বাকলায় আগমন করেন। গাভা, চাঙ্গুরিয়া, সুগন্ধিয়া, জুজখোলা, বাকেরগঞ্জ প্রভৃতি স্থানের সরদার পরিবারদের পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে সর্দার নিযুক্ত হন। সর্দাররা জায়গীর ভোগ করতেন।
 
 
কেল্লা বা দূর্গের দায়িত্বে থাকতেন মীরবহর, বক্সী, জমাদার, লস্কর, পাইক প্রমুখ কর্মচারী। গোবিন্দপুরের সংগ্রাম ক্লোর জমাদার ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ। তিনি তেঁতুলিয়ার জমাদারবাড়িতে বসতি স্থাপন করেন। জমাদাররা তার বংশধর। এ বংশের মোহাম্মদ তকি ১৯ শতকের প্রথম ভাগে তেঁতুলিয়া হতে উলানিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তকির বংশদররা উলানিয়া মিয়াবাড়িতে বাস করে। সুজাবাদের কেল্লার দায়িত্বে অনেক কর্মচারী ছিলেন। খুব সম্ভব ১৬৫৮ খ্রি. শাহ সুজা আওরঙ্গজেবের নিকট পরাজয় বরণ করে অনেক কর্মচারী নিয়ে সুজাবাদে আশ্রয় নেন। তিনি আরাকানে পালিয়ে গেলে সুজাবাদের অনেক কর্মচারী থেকে যায়। ঝালকাঠির পাকমহলের মীর বহর, শিরযুগ ও শেহাঙ্গলের খাঁ, সুজাবাদের মীর ও আসমান সিহ, কাউনিয়ার খাঁ, আমিরাবাদের খাঁ প্রভৃতি পরিবারের পূর্বপুরুষ শাহ সুজার কর্মচারী ছিলেন। কথিত আছে মীর জুমলার সৈন্যরা শিরযুগের খাঁদের পূর্বপুরুষ কালু খাঁকে শিরচ্ছেদ করে। শিরযুগের মোল্লাবাড়িতে কালু খাঁর কবর আছে। সুজার সাথে আগত কর্মচারীরা এ অঞ্চলে খুব সম্মানিত ছিলেন এবং তারা শাসন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেন। নবাবী শাসন আমলে এ জেলার অনেক হিন্দু পরিবার ফার্সী ভাষায় শিক্ষা লাভ করে নবাবের অধীনে চাকরি করতেন। বানারীপাড়ার গুহ, মাহিলারার সরকার, বাটাজোড়ের দত্ত, চাঁদশীর বসু, বাগদার সমদ্দার, খলিসাকোঠার রায়, গৈলার মুন্সী প্রভৃতি পরিবারের পূর্বপুরুষ নবাব কর্মচারী ছিলেন।
 
 
বাকলার মোগল কর্মচারীরা প্রায়ই ঢাকা থাকতেন। মাঝে মাঝে তারা বাকলায় আসতেন। তারা এ অঞ্চলের অর্থ দিয়ে ঢাকা ও দিল্লীতে বিলাসী জীবন যাপন করতেন। মোগল কর্মচারীরা শাসন ক্ষেত্রে যেমন সুনাম অর্জন করেছেন তেমনি অনেক কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রজা পীড়নের অভিযোগ আছে। বুজুর্গ উমেদ খাঁ ও আগাসাদেকের বিরুদ্ধে উৎপীড়নের অভিযোগ আছে। আগাসাদেক খাঁ অন্যায়ভাবে বাকেরগঞ্জের দয়াল চৌধুরীকে হত্যা ও তার পরিবারকে ধ্বংস করেছে। অনেক কর্মচারী এ অঞ্চলে স্ত্রী নিয়ে আসেনি। তারা স্থানীয় হিন্দুদের মেয়ে অনেক সময় জোর করে বিয়ে করতেন। অনেক মোগল ও নবাব কর্মচারী বরিশালের বিভিন্ন স্থানে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। বরিশালের মীরবহর, ফৌজদার, দেওয়ান, বকসী, মজুমদার, সরকার, কানুনগো, সিকদার, গোতার, তরফদার, দস্তিদার, লস্কর, পাইক, জমাদার প্রভৃতি উপাধিধারীদের পূর্বপুরুষ মোগল ও নবাব কর্মচারী ছিলেন।
 
 
 
== ভূমি ব্যবস্থা ==
 
 
মোগল যুগে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ছিল। রাজত্বের ওপর রাজা নির্ভরশীল ছিলেন। উৎপাদিত ফসলেরা এক-তৃতীয়াংশে বা এক-চতুর্থাংশ রাজকোষে জমা দিতে হতো। ফসল, মুদ্রা ও কড়ির মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করা যেত। তখন বাকলার অর্থনীতি মুদ্রা ভিত্তিক ছিল না। সুতরাং ফসলের দ্বারা বেশির ভাগ রাজস্ব আদায় হতো। গ্রামে কড়ির প্রচলন বেশি ছিল। ১৮০০ খ্রিঃ পর্যন্ত বাকলায় কড়ির প্রচলন ছিল। আবুল ফজলের আইন-ইআকবরী, মিঃ গ্রান্ট ও ব্লকম্যানের বিবরণে বাকলার ভূমি ব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ আছে। আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডরমল ১৫৮২-৮৭ খ্রিৎ বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ভূমি ব্যবস্থা সম্পাদনা করেন। জীম্মন খাঁ নামে একজন মোগল কর্মচারী এ অঞ্চলে জরিপ ও রাজস্ব নির্ধারণ করেন। টোডরমলের ভূমি ব্যবস্থাই বাকলায় মোগলদের প্রথম ভূমি ব্যবস্থা। বর্তমান বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালী ৩টি সরকারের অধীনে ছিল। জেলার পশ্চিমাশং সরকার ফতেহাবাদ এর মধ্যে ও দক্ষিন ভাগ সরকার বাকলার অধীন ছিল। সরকার বাকলার অধীনে ৪টি পরগণা ছির। ১. বাকলা-ইসলামপুর-রাজস্ব ১,০৮,৬৯৯ টাকা ২. শ্রীরামপুর-৬৩০০ টাকা ৩. ইদিলপুর-৩৮,৮৩৫ টাকা এবং ৪. শাহাবাজপুর-২৬৫২০ টাকা। বাকলার খাসভূমির মোট রাজস্ব ছিল-১,৭৬,৩৫১ টাকা। সেলিমাবাদ পরগণা সরকার খলিফাতাবাদের অধীন ছিল। রাজস্ব ছিল ৪,২১২ টাকা। শাহবাজপুর সরকার ফতেহাবাদের অধীন ছিল। রাজস্ব ছিল ৮,৩০৪ টাকা। এ ছাড়া জায়গীর রাজস্ব ছিল। স¤্রাট আকবরের সময় বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালীর খলসা জায়গীর ও জমিদারী-এ তিন প্রকারের ভূমি ছিল। খলসা ভূমির রাজস¦ সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা আদায় করত অথবা ইজারা দিত। জায়গীর কর্মচারীদের প্রদান করা হতো। তারা রাজস্ব আদায় করে কিয়দংশ রাজকোষে জমা দিত। রাজস্বের প্রধান উৎস ছিল জমিদারী। নির্দিষ্ট হারে পরগণার জমিদারী বন্দোবস্ত দেয়া হতো। শাহ সুজার আমলে ১৬৫৮ খ্রি. দ্বিতীয় ভূমি বন্দোবস্ত করা হয় এবং বাকলায় সরকার মুরাদখানা এবং পরগণা আকলা গোচারণ ভূমি ও পরগণা বানজার (বনভূমি) সৃষ্টি করা হয়। মুর্শিদ কুলি খাঁর আমলে ১৭২২ খ্রি. ও নবাব সুজাউদ্দৌলার আমলে ১৭২৮ খ্রি. তৃতীয় ভূমি সংস্কার করা হয়। ১৭২৮ খ্রি. বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে ১৭টি পরগণা, ৫৯টি মহল ও ২৭ জন জমিদার ছিল। ১৭২৮ খ্রি. ভূমি রাজস্ব ছিল ২,৯০,১১১ টাকা।১
 
 
১৭২৮ খ্রিঃ ভূমি বন্দোবস্ত
 
পরগণা         রাজস্ব 
 
সরকার বাকলা ইদিলপুর         ৪৭৭০৪ টাকা
 
ইদ্রাকপুর         ১০৮০৭ ”
 
বীরমোহন         ৫২৮৮ ”
 
বাংড়োরা         ১১০৪৪ ”
 
চন্দ্রদ্বীপ         ৬৬০৮ ”
 
জাহাপুর         ৬৭১ ”
 
মইজরদী         ৬২৫৭ ”
 
নাজিরপুর         ৬৮৯ ”
 
রামনগর         ১০৯৫ ”
 
শ্রীরামপুর         ৮৬০৫ ”
 
সুলতানাবাদ         ৩৬৩ ”
 
শায়েস্তানগর         ৩৯৫৬ ”
 
        ----
 
                                                        ১,৩২,০৪৮ টাকা
 
 
সরকার বাজুয়া         বুজুর্গ উমেদপুর         ৮৬৮৯ টাকা
 
        খাঞ্জাবাহাদুর নগর ৯ ”
 
        জাফরাবাদ ৪০ ”
 
        রফিনগর ১২৫”
 
        শায়েস্তাবাদ ৭২৬ ”
 
----
 
                                                        ৯৫৮৯ টাকা
 
 
সরকার ফতেহাবাদ                 উত্তর শাহবাজপুর ৭০৩০ টাকা
 
        দক্ষিণ শাহবাজপুর ৩৪৩২ ”
 
 
সরকার খলিফাতাবাদ সেলিমাবাদ                 ৪৩১৬৬ ”
 
 
১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের পর গিরদেবন্দর, তপ্পে সেলিমাবাদ, রতনদী-কালিকাপুর, আলিনগর, আবদুলপুর, আজিমপুর, হাবিবপুর ও আওরঙ্গপুর পরগণা সৃষ্টি হয়। ১৭২৮ খ্রি. খলসা ভূমি হতে ৫৬৫০৫ টাকা এবং জায়গীর হতে ১,৫৯৬০৯ টাকা রাজস্ব আদায় হতো। শাহবাজপুর ও সেলিমাবাদ নামক মহল ভূমি রাজস্ব ব্যতীত অনেক নওয়ারা, হিস্যাজাত, লাখেরাজ ও নিষ্কর ভূমি ছিল। চন্দ্রদ্বীপ রাজা ১৬১২ খ্রি. হতে মোগল স¤্রাটের পক্ষে মগ-পর্তুগীজদের দমনের জন্য নৌকা, নাবিক সরবরাহ ও সেনাবাহিনী রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। স¤্রাট নৌবাহিনীর ব্যয়ভার বহনের জন্য চন্দ্রদ্বীপ রাজাকে নওয়ারা ভূমি প্রদান করেন। রাজা নিজেও নৌবাহিনী নিয়ে মোগল বাহিনীর সাথে মগদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেন এবং এ জন্য স¤্রাট তাকে হিস্যাজাত ভূমি প্রদান করেন। রাজাকে নওয়ারা ও হিস্যাজাত ভূমির জন্য কর দিতে হতো না। হাবেলী সেলিমাবাদ পরগণার জমিদার পোনাবালিয়ার চৌধুরীরাা হিস্যাজাত ভূমি ভোগ করতেন। তারা স¤্রাটের পক্ষে সৈন্য নিয়ে মগ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালী জেলায় ১১৪৩টি লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। দরগা, মসজিদ, মন্দির, দুর্গ প্রভৃতির সংরক্ষণের জন্য খাদেম, সেবায়েত ও কর্মচারীরা লাখেরাজ সম্পত্তি ভোগ করতেন। পীর, আউলিয়া, ব্রাহ্মণ, মোগল ও নবাবের কর্মচারীরা নিষ্কর ভূমি লাভ করেন। কসবার দুধকুমার, দাউদ শাহ, চেরাগ আলম প্রমুখ আউলিয়ার মাজারে বাতি দেয়া ও সংরক্ষণের জন্য মোগল স¤্রাট লাখেরাজ সম্পত্তি প্রদান করেন।
 
 
১৬১১ খ্রি. রামচন্দ্রের পরাজয়ের পর চন্দ্রদ্বীপ রাজা সরাসরি মোগল শাসনধীনে চলে যায় এবং অনেক পরগণায় বিভিক্ত হয়। আকবরের সময় বরিশাল বিভাগে মাত্র ৬টি পরগণা ছিল এবং নবাব সিরাজউদ্দৌলার সময় ২৮টি পরগণা ছিল। সব পরগণা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য থেকে সৃষ্ট। চন্দ্রদ্বীপ পরগণা মাধবপাশার রাজার অধীনে ছিল। চন্দ্রদ্বীপের পরে সেলিমাবাদ দ্বিতীয় বৃহত্তম পরগণা। রায়েরকাঠির রায়েরা এ পরগণার জমিদার ছিলেন। ইদিলপুর বা আদিলপুর একটি প্রাচীন পরগণা। এ পরগণার জমিদার ছিলেন ইদিলপুরের চৌধুরী বংশ। উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার ছিলেন চাঁদ রায় ও তার বংশধররা। ভূষণ উল্লা ও বিজলী নারায়ণ দক্ষিন শাহবাজপুরের প্রথম জমিদার। তাদের পরে শ্রীপুরের জমিদার আবু সাইদের স্ত্রী সারতাজ বিবি এ পরগণার মালিক হন। সৈয়দ আবদুল্লাহ চৌধুরী ও বরিশালের খানমবাড়ির মেহেরুন্নেসা সুলতানাবাদ পরগণার ভূস্বামী ছিলেন। জাহাপুরে ও আজিমপুরের জমিদার ছিলেন মুলাদীর ইচরি ও তেরচরের দত্ত, চৌধুরীরা। চৌধুরীদের পূর্বপুরুষ ভগবান দাশ দিল্লী থেকে চন্দ্রদ্বীপে আসেন। তার পুত্র রামেশ্বর দত্ত চন্দ্রদ্বীপ রাজার সেনাপতি ছিলেন। শায়েস্তাবাদের মীর আসাদ আলী শায়েস্তাবাদ পরগণা, গৈলার দাশেরা বাঙ্গড়োরা, রতেœশ্বর রায় রতনদী কালিকাপুর ও পোনাবালিয়ার চৌধুরী বংশ তপ্পে সেলিমাবাদ পরগণার জমিদার ছিলেন। স¤্রাট জাহাঙ্গীরের উজির উলফত গাজীর নামে নাজিরপুর, সুজাউদ্দিনের সেনাপতি মীর হাবিবের নামে হাবিবপুর, শায়েস্তাখানের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁর নামে বুজুর্গ উমেদপুর, রাজা বল্লভের কর্মচারী রামনারায়ণের পুত্রের নামে রামনগর পরগণা সৃষ্টি হয়। আওরঙ্গজেবের নামে আওরঙ্গপুর ও তার পৌত্র আজিম শাহের নামে আজিমপুর ও দরবেশ মাহমুদ ইদ্রাকের নামে ইদ্রাকপুর পরগণা সৃষ্টি হয়।
 
 
চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের আমলে রাজা ভূমির মালিক ছিল এবং প্রজারা রাজার অধীনে ভূমি চাষ করত। মোগল শাসন সুদৃঢ় হলে এ অঞ্চলে সামন্তপ্রথা শক্তিশালী হতে থাকে এবং কৃষকরা ভূমিদাসে পরিণত হতে থাকে। সুবাদার মুর্শিদকুলী খাঁ রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারদের ওপর নির্যাতন চালায়। কর্মচারীরা কৃষকদের আরও নির্মমভাবে অত্যাচার করে রাজস্ব আদায় করত। রাজস্ব আদায়ের জন্য অনেক সময় কর্মচারীরা প্রজাদের স্ত্রী-কন্যা নিলামে বিক্রি দিত।
 
 
== সামাজিক জীবন ==
 
 
মোগল শাসন ব্যবস্থা বাকলার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাকলা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য মোগল সা¤্রাজ্যভুক্ত হওয়ায় এ অঞ্চলের সাথে ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর ভারতের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। অনেক পীর-দরবেশ ও তাদের ভক্তরা আরব, ইরান, ইরাক থেকে বাকলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আগমন করেন। অনেক অমুসলমান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। মোগলদের সাথে পরাজিত হয়ে শত শত পাঠান বরিশালে বসতি স্থাপন করে। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার চেয়ে এ জেলায় পাঠান বংশোদ্ভূত লোকের সংখ্যা বেশি। বরিশালের জনগণ যে দুর্ধর্ষ ও সাহসী তার অন্যতম কারণ পাঠানদের প্রভাব। তৎকালীন শেখ, সৈয়দ ও পাঠান মুসলমানরা সমাজে প্রভাবশালী ছিল। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা হলেও তারা বাকলার ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে গ্রহণ করে। ফলে তারা দুই/তিন পুরুষের মধ্যে বাঙ্গাল বা বাকলার লোক বলে স্বীকৃতি লাভ করে।
 
রাজা রামচন্দ্রের পরাজয়ের পর বাকলা হিন্দু সমাজে ভাঙ্গন দেখা দেয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তারা অনেকে ফার্সী ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করে মোগল সরকার ও নবাবদের অধীনে চাকরিগ্রহণ করে এবং অনেকে জমিদারী প্রাপ্ত হন। এ জেলার অধিকাংশ জমিদার ছিলেন ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য। ২৮টি পরগণার মধ্যে শুধু নাজিরপুর, শায়েস্তাবাদ, দক্ষিণ শাহবাজপুর ও সুলতানাবাদ ব্যতীত অন্যান্য পরগণার জমিদার ছিলেন হিন্দুরা। মোগল ও নবাবী আমলে বাকলায় হিন্দু সমাজ মুসলমানদের তুলনায় প্রভাবশালী ছিল। স্থানীয় কোন মুসলমান উচ্চপদে চাকরি করত না। তাদের মধ্যে কোন জমিদার ছিল না। হিন্দু কৃষক ও মুসলমান কৃষক উভয় শ্রেণী সমাজে অনাদৃত ও অবহেলিত ছিল। অভিজাত হিন্দু ও মসুলমান সমাজে সম্মানিত ও প্রভাবশালী ছিল। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাকলার জনসংখ্যা ৮ লক্ষের বেশি ছিল না। নবাবী আমলে এ অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যা সমান ছিল। বাকলায় হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করত। মোগল ও নবাবী আমলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোন দাঙ্গা হয়েছে এমন কোন উদাহরণ নেই। তাদের অপূর্ব মিলনের ফলে এক বাঙালী সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। পীর আউলিয়াদের সুফী মতবাদ ও শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম মোগল আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে এবং গ্রামের সাধারণ মানুষ ধর্মের গ-ি পেরিয়ে এ অঞ্চলকে হিন্দু-মুসলমানের মিলন ক্ষেত্রে পরিণত করে।২
 
 
বাকলার জনগণের প্রধান খাদ্য ছিল মাছ ভাত। সুলতানী ও মোগল আমলে ডালের প্রচলন দেখা যায়। কাঁচাকলা, বেতাগ, ডাল, পুঁইশাক, কলার মোচা, বেগুন, কচু, মুলা, পটোল প্রভৃতি তরকারি খেত। চিনি, ছানা, দধি, মাখন, মিষ্টি, মুড়ি, চিড়া, মাছের বিভিন্ন ব্যঞ্জনের প্রচলন ছিল। গরু, খাসি, মেষ, পাখি, মোরগ প্রভৃতির মাংস খাওয়া হতো। ম্যানরিক লিখেছেন “গরিব লোকেরা ভাত, লবণ, শাক ও সামান্য তরকারির ঝোল খেত। কদাচিৎ দধি ও সস্তা মিষ্টি জুটত, মাছও খুব সুলভ ছিল না। পান্তাভাতের জল গরিবদের প্রধান খাদ্য ছিল।” মোগল আমলে বাকলায় তামাক সেবন শুরু হয়। পুরুষেরা ছোট ধুতি পরত। তাদের মাঠে কাজ করতে হতো। তাই তারা লেংটি পরত। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্য লম্বা ধুতি পরিধান করত। কারণ তাদের মাঠে কাজ করতে হতো না। ধনী মুসলমানরা লম্বা কোর্তা ও পাগড়ি পরত। মুসলমান চাষী ও জেলেরা হিন্দুদের মতো লেংটি পরত। মেয়েরা সোনা, রুপা ও হাতির দাঁতের অলঙ্কার ব্যবহার করত। নারী সমাজ অল্প লেখাপড়া শিখত। বহু বিবাহের প্রচলন ছিল। মেয়েদের স্বাধীনতা ছিল না। দাস প্রথার প্রচলন ছিল।
 
 
মোগল আমলে অভিজাত শ্রেণীর নৈতিক চরিত্র উন্নত ছিল না। কৃষক-শ্রমিক শ্রেণী হতে তারা বিচ্ছিন্ন ছিল। সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তার অভাব ছির। খাদ্যদ্রব্য সস্তা হলেও সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্ট লেগে থাকত। মহামারী, দুর্ভিক্ষ ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় হাজার হাজার লোক মারা যেত। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হতো। বাকলার দক্ষিণাঞ্চলের জনগণের জীবন ছিল অভিশপ্ত। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে হাজার হাজার মানুষ বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেত। একদিকে ঘূর্ণিঝড়, অন্যদিকে মগ-পর্তুগীজ জলদস্যুরা বাকলার সমাজজীবনকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। আর এই প্রতিকূল পরিবেশের সাথে সংগ্রাম করে বাকলার জনগণকে বেঁচে থাকতে হয়েছে।
 
 
== ভাষা ও সাহিত্য ==
 
 
মোগল আমল বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ। বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে এ যুগে উল্লেখযোগ্য কোন কবি-সাহিত্যিক দেখা যায় না। তবে এ যুগে যে সাহিত্য সাধনা হয়নি তেমন নয়। এ যুগের লেখা সংরক্ষরণের অভাবে হারিয়ে গেছে। ১৭ ও ১৮ শতকে এ অঞ্চলে পুঁথি সাহিত্য রচিত হয়েছে। চাখারের আমির আলী ১৮ শতকের মধ্যভাগে রসুলের মেরাজ গমন নামে একখানা পুঁথি রচনা করেন। মোগল আমলে বাকলার লোকায়ত বাংলা ভাষা উন্নত ছিল। ১৭৪৭ খ্রিঃ চন্দ্রদ্বীপ রাজা উদয় নারায়ণের ভূমিদান পত্র থেকে সে যুগের বাকলার উন্নত বাংলা ভাষার পরিচয় পাওয়া যায়।
 
 
“ইয়াদিকীদ্দ শরণ ও মঙলালয় মহামহিম শ্রীযুক্ত রাজোদয় নারায়ণ মহাশয়ানং শ্রীসূর্যদেব চক্রবর্তী সুচরিতেষু নমষ্কারা কার্যাঞ্চাগে পরগণে চন্দ্রদ্বীপ গয়রহ সরকার বাকলায় শ্রী রাজোদয় নারায়ণ রায়ের ধর্ষ্মেচরাজদী জোয়ারে সোয়াকানি জমি তোমার ব্রহ্মত্র দিল। জমি আমল করিয়া দপ্তরে আপন নাম ব্রহ্মোত্রর লিখাইয়া পুত্র পৌত্রাদিক্রমে ভোগ করিয়া আর্শীবাদ করিতে রহ। ইতি ১১৫৪ সন।”
 
 
সংস্কৃত ভাষা চর্চার জন্য বাকলা বঙ্গ বিখ্যাত ছিল। নলচিড়া, শিকারপুর, ফুলশ্রী, ইদিলপুর, উজিরপুর, মাধবপাশা প্রভৃতি স্থানে সংস্কৃত চতুষ্পাঠী ও টোল ছিল। অন্য অঞ্চল থেকে ছাত্ররা এসে বাকলায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করে কবিরতœ, কবিকণ্ঠহার প্রভৃতি উপাধি লাভ করত।     
 
 
 
== অর্থনৈতিক অবস্থা ==
 
 
সুলতানী আমলে বাকলা ধনে-সম্পদে ভরপুর ছিল। মোগল ও নবাবী আমলে এ সম্পদ আরও বৃদ্ধি পায়। সম্পদের লোভে দেশী-বিদেশী বণিকরা বাকলায় ছুটে আসে। একদিকে মোগল কর্মচারী, জমিদার অন্যদিকে জলদস্যুরা বাকলার সম্পদ শোষন করে নিয়ে যায়। সুবাদার শায়েস্তা খান ২২ বছরে ৩৮ কোটি এবং সুজাউদদৌলা ১২ বছরে ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা বাংলাদেশ থেকে দিল্লী প্রেরণ করেন। শায়েস্তা খানের দৈনিক আয় ছিল ২ লক্ষ টাকা এবং ব্যয় ছিল এক লক্ষ টাকা। বাকলার জনগণ বিদেশীদের সাথে বাণিজ্য করে যে রৌপ্য ও স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করে তা রাজস্ব আদায়ের নামে জমিদার ও কর্মচারীরা নিয়ে যায়। ফলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পায়। বাংলা ছিল সম্পদের স্বর্গরাজ্য এবং বাকলা বাংলার সবচেয়ে সম্পদশালী এলাকা ছিল। মিঃ মানরিক বলেছেন “এতদিন মিসর পৃথিবীতে ধনী দেশ বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সে নীল নদকে ছাড়িয়ে গেছে। এ দেশে প্রবেশের হাজার পথ আছে কিন্তু বের হবার কোন পথ নেই। ১৫৮৪ খ্রিঃ র‌্যালফ ফিচ বাকলার ঐশ্বর্য সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বাকলার অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক ছিল। এখানে প্রচুর চাল উৎপন্ন ও ইক্ষু চাষ হতো। খেজুরের রস ও ইক্ষু থেকে চিনি উৎপন্ন হতো। ঘরে ঘরে কার্পাস তুলা উৎপন্ন হতো। উজিরপুর ও মাধবপাশায় উৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি হতো। শাহবাজপুর, নেয়ামতি, খলসাখালী (গলাচিপা) মনপুরা ও সেলিমাবাদে লবণ উৎপন্ন হতো। মাধবপাশা, পাংশা ও নলচিড়ায় কাগজ উৎপন্ন সূক্ষ্ম কাগজ উৎপন্ন হতো। এ অঞ্চলে প্রচুর চুন পাওয়া যেত এবং অন্যান্য অঞ্চলে চুন রপ্তানি হতো। বাকলার চাল, চিনি, কাপড়, সুতা ও লবণ রপ্তানি করে প্রচুর দেশী-বিদেশী মুদ্রা পাওয়া যেত। দ্রব্যমূল্য খুব কম ছিল। পর্যটক ম্যানরিক ১৬৪০ খ্রিঃ লিখেছেন যে, নামমাত্র মূল্যে তিনি ও তার সাথীরা তৃপ্তির সাথে পর্যাপ্ত আহার করেছেন। গোলাম হোসেন সলীম লিখেছেন যে, মাসিক এক টাকা আয় হলে একজন লোক দু’বেলা খুব ভালভাবে খেতে পারত। একজন মজুর মাসে দেড় টাকা উপার্জন করত। একখানা মোটা কাপড়ের দাম ছিল ১৮৭ কড়ি বা আধা পয়সা। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে টাকায় যথাক্রমে ১ মণ ১০ সের উৎকৃষ্ট চাল, ৭ মণ ২০ সের মোটা চাল, ৩ মণ গম, ২১ সের তেল এবং ১০ সের ঘি পাওয়া যেত। এত প্রাচুর্যের মধ্যেও কৃষক, জেল ও তাঁতীদের জীবনযাত্রা উন্নত মানের ছিল না। লেংটি কাপড়, একটি কুঁড়েঘর ও আহারের জন্য এক খ- ভূমি তাদের সম্বল ছিল।৩
 
 
 
== ইতিহাসের ইঙ্গিত ==
 
 
বাকলা চন্দ্রদ্বীপ বা বরিশাল বিভাগের ইতিহাস ১৭৫৭ খ্রিঃ পর্যন্ত আলোচিত হলো। এ সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে আমরা রাজ-রাজা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ, বাকলার জমিদার প্রভৃতি আলোচনা করেছি কিন্তু উপকরণের অভাবে সমাজের গণমানুষের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরতে পারিনি।
 
 
মোগল আমলে বাঙালীর জাতীয় জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়। সুলতানী আমলে বাঙ্গালা একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়। মোগল আমলে রাষ্ট্রীয় ঐক্য সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে বাঙালী জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। ধর্মীয় প্রভেদ থাকলেও ভাষা ও সংস্কৃতি জীবনে জাতীয় চেতনাবোধ সৃষ্টি হয়। বল্লালী কুলীনন্যত্ব প্রাপ্ত কায়স্থ, ব্রাহ্মণ এবং আরব-ইরানের শেখ, সৈয়দ ও পাঠানদের বাকলা ভূখ-ে অপূর্ব মিলন হয়। তারা সংস্কৃত, আরবী, ফার্সী ভাষার সাথে এ অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে আপন করে গ্রহণ করে। কিন্তু তাদের মদ্যে শ্রেণী চেতনার চেয়ে বর্ণ চেতনা প্রবল ছিল। কৃষক, জেলে, তাঁতী প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান অভিজাত হিন্দু-মুসলমান শ্রেণী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধা দাসজীবন যাপন করত। অভিজাত শ্রেণী কৃষি ও গ্রামভিত্তিক সমাজ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। চন্দ্রদ্বীপ রাজপরিবার ধর্মীয়অনুশাসন ও সামন্ত জীবনে আচ্ছন্ন ছিল। তারা জনগণকে নিয়ে মগ পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। মোগল ও নবাবের কর্মচারীরা বিলাস জীবন যাপন করত। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা কোন পথ নির্দেশ দিতে পারেনি। স্থানীয় অভিজাত শ্রেণী ইউরোপীয় জাগরণ সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল। ফার্সী ও সংস্কৃত প-িতরা ১৭ ও ১৮ শতকের জ্ঞানবিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ধর্মীয় কুসংস্কার সমাজ জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মন্টেস্কু, রুশো, বলটেয়ার, হবস ও লক যখন মানুষের স্বাধীনতা, মানবতার জয়গান ও মুক্তির কথা শুনাতেন তখন আমাদের অভিজাত শ্রেণী ধর্ম ও বর্ণের নামে সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে স্লেচ্ছ ও আতরাফ আখ্যা দিয়ে শোষণ করত। ইউরোপে যখন মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণে ব্যস্ত, তখন বাকলার সমাজ তালপাতায় বা তুলট কাগজে মনসা, কৃষ্ণলীলা, সত্যপীর, গাজীকালু প্রভৃতি চর্চায় নিমগ্ন ছিল। উত্তর আমেরিকা যখন ব্রিটিশের শৃঙ্খল থেকে মুুক্তিলাভ করার জন্য প্রবল আন্দোলন গড়ে তুলছে, তখন আমাদের ধনিক, বণিক ও জমিদারা বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার জন্য ইংরেজ বনিকদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
 
 
অনেক ঐতিহাসিক ও বিদেশী পর্যটক মন্তব্য করেছেন মোগল ও নবাবী আমলে বাঙালীদের চরিত্র নি¤œমানের ছিল। ১৬২৮ খ্রি. মি. সেবাষ্টিয়ান ম্যানরিক লিখেছেন যে, বাঙালীরা ভীরু ও উদ্যমহীন, পরের পা চাটতে অভ্যস্ত। তাদের মধ্যে একটি ছড়া প্রচলিত আছে মারে ঠাকুর না মারে কুকুর, যে মারতে পারে তাকে ঠাকুরের মতো মান্য করে আর যে না মারে তাকে কুকুরের মতো ঘৃণা করে। স¤্রাট বাবর তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, বাঙালীরা ক্ষমতার পূজারী। চরিত্রহীনতা, মনুষ্যত্বের অভাব, স্বার্থপরতার চরম বিকাশ, সাধারণ মানুষের রাজনীতির বিষয়ে ঔদাসীন্য, অসত্য, বিশ্বাসঘাতকতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা প্রভৃতি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালীর স্বভাব প্রকৃতি ছিল। পলাশীর পরাজয় কোন আকষ্মিক ঘটনা নয়, বহুদিন হতেই এর বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছিল। সুবিধাবাদী সমাজের প্রতিনিধি মীর জাফর, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ প্রমুখ ইংরেজ কোম্পানির সাথে একত্রিত হয়ে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। বাংলার অধিকাংশ জমিদার সেদিন ষড়যন্ত্রকারীদের পক্ষে ছিল। চন্দ্রদ্বীপ, রায়েরকাঠি, পোনাবালিয়া, ইদিলপুর, রতনদি কালিকাপুর প্রভৃতি পরগণার জমিদাররা রাজবল্লভের পক্ষ অবলম্বন করে প্রকারান্তরে সিরাজউদ্দৌলার বিরোধিতা করেছিল। একমাত্র নলচিড়ার জমিদার ও চাখারের মজুমদাররা নবাবের পক্ষে ছিলেন। তাই পলাশী প্রান্তরের একদল পরাজিত সৈনিক নলচিড়য়ায় আশ্রয় নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
 
 
কৃষক, শ্রমিক, জেলে ও তাঁতীরা সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তারা ছিল সহজ ও সরল। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণী তাদের পদানত করে রেখেছিল। তাই কৃষক সমাজ রাষ্ট্র বিপ্লবের প্রতি উদাসীন থাকত। পলাশীর পরাজয় তাদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। নেতৃত্বের অভাবে সমাজ একবার পিছিয়ে পড়লে সে সমাজে পরিবর্তন আনতে শত শত বছর লেগে যায়। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতি সে ভুলের মূল্য দিচ্ছে শতাব্দীকাল ধরে। বার বার সমাজে বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় না। ১৮ শতকে সমাজে যখন বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল তখন বাংলাদেশে বীরপুরুষের অভাবে কোন পরিবর্তন সাধিত হয়নি। এ সময় বাংলার অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিকাশ না ঘটায় সমাজ কৃষিভিত্তিক ও গ্রামীণ থেকে যায়। এই ঐতিহাসিক ভুল বাঙালীদের মধ্যে আজও তেমন কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি।
 
 
 
== তথ্য নির্দেশ ==
 
 
১. রোহিণী রায় চৌধুরী, বাকলা
 
২. খোষাল চন্দ্র রায়, বাখরগঞ্জের ইতিহাস
 
৩. H. Beveridge, District of Bakerganj
 

০৭:৪২, ২৬ জুলাই ২০১৭ তারিখে সম্পাদিত বর্তমান সংস্করণ