মোগল আমলে প্রাচীন কীর্তি

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২১:২৮, ১৩ জুন ২০১৭ পর্যন্ত সংস্করণে ("বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোগল ও নবাবী আমলের অনেক প্রাচীন কীর্..." দিয়ে পাতা তৈরি)

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোগল ও নবাবী আমলের অনেক প্রাচীন কীর্তি বর্তমান আছে। অনৈক কীর্তি সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়েছে। প্রাচীন কীর্তিগুলোর মধ্যে মসজিদ, মন্দির, দুর্গ, ইটের নির্মিত দালান, রাস্তা, দীঘি প্রভৃতি প্রধান।

মসজিদ

গৌরনদী থানার কসবা মোগল আমলে একটি উন্নত মুসলিম জনপদ ছিল। কসবা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে অনেক মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। অধিকাংশ মসিজদ ধ্বংস হয়ে গেছে। এখনও কয়েকটি মসজিদ বর্তমান আছে। কসবা কাজীবাড়ীর সামনে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ আছে। গম্বুজটি কয়েক বছর পূর্বে ভেঙ্গে পড়েছে। কসবা হাটের দক্ষিণ পাশে একটি, কাহারবাড়ীর নিকটে একটি এবং খলিফাবাড়ীর নিকটে একটি মসজিদের ধ্বংসস্তুপ আছে। কমলাপুর গ্রামে তিন গম্বুজ ও তিন দরজা বিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। মসজিদটি অনেক কারুকার্য খচিত। বাউরগতি গ্রামে মিয়াবাড়ীতে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ, ইমামবাড়া ও দীঘি আছে। এই গ্রামের মুন্সীবাড়ীর নিকটে আর একটি মসজিদ আচে। নলচিড়া মিয়াবাড়ীতে এক গম্বু বিশিষ্ট একটি মসজিদ, নহবতখানা, ইমামবাড়া, ইটের নির্মিত দালান ও মাজার আছে। এ বংশের সেয়দ আলাউদ্দিন মনু মিয়া এগুলোর সংস্কার করেছেন। সুগন্ধিয়ার দাঊদ শাহের মাজারের উপরে একটি গম্বুজ ও চারটি মিনার আছে। কবরের উপরে ৭ ফুট দৈর্ঘ্য কৃষ্ণ পাথরের কোরানের আয়াত উৎকীর্ণ আছে। মাজারের পূর্ব পাশে দু’টি মসজিদ আছে। একটি মসজিদ ভেঙ্গে গেছে। মসজিদের সামনে বৈঠকখানা ছিল। মাজারের চারপাশে দেয়াল আছে। পটুয়াখালী জেলার বেতাগ থানার বিবিচিনি গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। মসজিদের একাংশ ভেঙ্গে পড়েছিল।১ ১৯৭৫ খ্রিঃ লেখক এ মসজিদের সংস্কার করেছে। নলছিটির শেহাঙ্গল গ্রামে কাজীবাড়ীতে শাহ সুজার আমলে নির্মিত একটি মসজিদ আছে। মসজিদের নিকেটই বিখ্যাত পীর চেরাগ আলমের মাজার আছে। স্বরূপকাঠি থানার শেহাঙ্গল গ্রামে শাহ কামালের নির্মিত এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। ঝালকাঠি থানার সুতালরী বন্দরে একটি মসজিদ ছিল। সুগন্ধার ভাঙ্গনে মসজিদটি প্রায় ২৫ বছর পূর্বে বিলীন হয়ে যায়। ১৭৩২ খ্রিঃ জনৈক গোলাম মোহাম্মদ এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের শিলালিপি ঢাকা জাদুঘরে রক্ষিত আছে। ফার্সী ভাষায় শিলালিপিতে লেখা আছে, ”মোহাম্মদ শাহ ধর্মরক্ষক ছিলেন; তার রাজত্বকালে পৃথিবী পরিত্রাণ লাভ করেছিল। গোলাম মোহাম্মদ খোদাতায়ালার প্রতি অনুগ্রহের নিদর্শনস্বরূপ এবং তার অনুগ্রহে এ মসজিদ নির্মাণ করেন।” হিজলা থানার তেঁতুলিয়া গ্রামে মীরের মসজিদ ও মাজার আছে। প্রায় ৪০ বছর পূর্বে মুন্সি রিয়াজ উদ্দীন মাটির ঢিবি খনন করে এ মসজিদটি আবিষ্কার করেন। অনেকে মনে করেন এখানে মীরকুতুব নামে একজন পীর বাস করতেন। তিনি মোগল কর্মচারী ও ধর্ম প্রচারক ছিলেন। পাশেই কাজী আউলিয়ার মাজার ও মসজিদ আছে। কাজীবাড়ীতে ভগ্ন দেয়াল আছে। নিকটেই কোটেশ্বর দুর্গ ছিল। কাজীরা মোগলদের কাজী ও দুর্গের রক্ষক ছিলেন। মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়া ইউনিয়নে শৌলদী গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। মসজিদের শিলালিপিতে লেখা আছে যে ”জনৈক মোহাম্মদ শফি বাংলা ১১৬১ সন মোতাবেক ১৭৫৪ খ্রিঃ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। উলানিয়া মিয়াবাড়ী ও বিদ্যালয়টি একটি বিরাট দীঘির পারে অবস্থিত। পূর্বে উলানিয়া দীঘিরপার নামে পরিচিত ছিল। দীঘির পারেই মসজিদ আছে। মসজিদটি মোগল আমলের নির্মিত বলে মনে হয়। চৌধুরীরা এ মসজিদের সংস্কার করেছেন। উলানিয়ার মিয়ারা ও তেঁতুলিয়ার জমাদাররা একই বংশ। তারা সংগ্রাম কেল্লার জমাদার মোহাম্মদ হানিফের বংশধর। ডহরপাড়া মাছিম শাহের দীঘির পারে একটি মাটির ঢিলা ছিল। কয়েক বছর পূর্বে এক পাগল একাকী মাটির ঢিলা খুঁড়ে একটি মসজিদ আবিষ্কার করেন। মাচিম শাহ এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মাধবপাশার রাজবাড়ির নিকটে বাদলা গ্রামে এক গম্বুজ শিকদারবাড়ীতে এক গম্বুজ বিশিষ্ট তিনটি মসজিদ আছে। কড়াপুরের মিয়াবাড়ীতে একটি দোতালা মসজিদ আছে। মসজিদের নিচে ৬টি দরজা, দোতলায় তিনটি দরজা, তিনটি গম্বুজ, ৮টি বড় ও ১২টি ছোট মিনার আছে। বুখাইনগরের জিবদলন গ্রামে একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংবসাশেষ আছে। বাউফল থানার ধুলিয়া গ্রামে কবিরাজ বাড়ীতে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ আছে। জনৈক গোলাম রছুল এ মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের দেয়ালে আলপনা ও ময়ূরের ছবি আঁকা আছে, মসজিদটি ধ্বংসের পথে। ভা-ারিয়া থানার নিকটে মিয়াবাড়ীতে একটি ও কাজী বাড়ীতে একটি মসজিদ আছে। নিকটেই একটি দীঘি ছিল। বানারীপাড়ার সৈয়দকাঠি ইউনিয়নে মসজিদবাড়ী, কোতোয়ালি থানার রুইয়া, হিজলা, বাকেরগঞ্জের রঙ্গশ্রী, মির্জাগঞ্জের ছৈলাবুনিয়া, আমড়াগাছিয়া, বেতাগীর জোবখালী প্রভৃতি স্থানে এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ আছে। আজ থেকে ২৫ বছর পূর্বে বরিশালের সুসাহিত্যিক মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী উজিরপুরের বিভিন্ন স্থানে ১১টি মসজিদের সন্ধান পেয়েছিলেন। গৌরনদী, বাকেরগঞ্জ, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জে কয়েকটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ আছে। বরিশালের বিভিন্ন স্থানে মোগল আমলে প্রায় দুই শত মসজিদ ছিল। ১৮ শতকে শিয়া প্রভাবে এ অঞ্চলে শতাধিক জোড় মসজিদ নির্মিত হয়। অনেক মসজিদ ভেঙ্গে গেছে। চাঁদপাশার আরজিকালিকাপুর গ্রামে জনৈক মোনাই মঙ্গল একটি সুন্দর জোড় মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি জঙ্গলাবৃত। আরজিকালিকাপুর লেখকের বাড়ির নিকটে ফকির বাড়িতে) বাঁশবাড়ি, কোতোয়ালি থানার আইচা, কর্ণকাঠি, মকর প্রতাপ, ভাটিখানা, রাজাপুর, বরুইয়া, বাকেরগঞ্জের জলিসা প্রভৃতি স্থানে এক গম্বুজবিশিষ্ট জোড় মসজিদ আছে। বাকলার পীর আউলিয়াদের মাজারগুলো সংস্কার করা হলেও এখনও এগুলোতে প্রাচীনতা বিদ্যমান আছে। হজরত দাউদ শাহ, শেখ মোশায়েক, শাহ চেরাগ আলম, সৈয়দ কুতুব শাহ, শাহ খুদগীর, বারআউলিয়া, শাহ কামাল, সৈয়দ ফকির, হজরত দুধ কুমার প্রমুখের মাজার মোগল স্থাপত্যের অপূর্ব নির্দশন।

মন্দির ও মঠ

মোগল আমলে বাকলা চন্দ্রদ্বীপে অসংখ্য মন্দির ও মঠ নির্মিত হয়েছ্ েএ জেলার মঠগুলোর মধ্যে মাহিলারা গ্রামে রূপরাম সরকারের নির্মিত মঠ বিখ্যাত। সরকারের মঠ ১৫০ ফুট উঁচু। মঠে পৌরণিক চিত্র খোদিত আছে। এ গ্রামের মদনমোহন ঘোষের বাড়িতে একটি মন্দির আছে।২ মন্দিরে ফুল ও রাম-লক্ষণের ছবি আছে। এ গ্রামের দাশগুপ্তের বাড়িতে ৪টি মঠ ও একটি মন্দির এবং গোকুল সেনের বাড়িতে একটি মঠ ও মন্দির আছে। এ গ্রামের প্রাচীনতম নিদর্শন রুদ্র সেনের দীঘির পাড়ে রাজাবাড়ি ও হাতিবাড়ি। গৌরনদী থানার নিকটে দেউলভিটা আছে। প্রাচীনকালে জনৈক ব্রাহ্মণ মায়ের ঋণমুক্ত হওয়ার জন্য দেউল নির্মাণ করেন। কিন্তু দেউলটি ভেঙ্গে যায়। এ স্থানের দেউলের ধ্বংসাশেষ আচে। অধুনা গ্রামে একটি প্রাচীন মঠ ও আশাপৈত্যের দীঘি আছে। এ গ্রামের সেনের বাড়িতে একটি মন্দির ও বাচৈর দীঘি আছে। বাটাজোড়ের দত্ত বাড়িতে নবাবী আমলের কোঠা ও গোসাইয়ের দালান আচে। শোলক গ্রামে নবাবী আমলে নির্মিত দালান, মঠ ও মন্দির আছে। গৈলা-ফুল্লশ্রী গ্রামে অনেক প্রাচীন দালান, মঠ, মন্দির ও দীঘি আছে। গৈলার পূর্বপাড়ায় মঠবাড়ীতে একটি খিলান দালান ছিল। দাসেরবাড়ির সামনে একটি দালানের ভগ্নাবশেষ ও বাড়ির চারদিকে মাটির নিচে দেয়ালের ভিত আছে। সম্ভবত এ বাড়িতে ছবি খাঁর দুর্গ ও বসতবাড়ি ছিল। ১৮ শতকের মধ্যভাগে রামদাস তার বাড়িতে কারুকার্য শোভিত বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেন। মুন্সীবাড়িতে নবাবী আমলের তিনটি মহল আছে। সিহিপাশা গ্রামে রাম কিশোরের মঠ আছে। চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের রাজধানী শ্রীপুর বা মাধবপাশা রাজপ্রাসাদ একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়িতে কাত্যায়নী, মদন গোপাল ও কালী মন্দির আছে। রাজবাড়ির চারদিকে কয়েকটি মঠ আছে। দক্ষিন পাশে একটি সুউচ্চ মন্দির আছে। বাড়ির সিংহদ্বার, নহবতখানা ও চিলছত্রের ধ্বংসাবশেষ আছে। কন্দর্প নারায়ণের রাজধানী রাজনগর, বিশারিকাঠি ও ক্ষুদ্রকাঠিতে রাজবাড়ির ধ্বংসাবশের নির্দশন আছে। বাবুগঞ্জের ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে আমতলীর নদীর তীরে নির্মিত কন্দর্প নারায়নের মঠটি নদীতে বিলীন হয়েছে। রামচন্দ্রের রাজধানী হোসেনপুরে দালান ও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে। রায়েরকাঠি জমিদার বাড়িতে মোগল ও নবাবী আমলের কয়েকটি দালান আছে। অনেক দালান ভেঙ্গে গেছে। নবরতেœর মন্দিরটি ভেঙ্গে গেছে। পঞ্চরতœ মন্দিরের তিনটি সুউচ্চ মন্দির আছে। রায়েরবাড়ি কালী মূর্তিটি রুন্দ্রনারায়ণ ১৬৪৩ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠা করেন এবং জয়নারায়ণ ১৭৩৭ খ্রিঃ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কীর্তিপাশা চৌধুরীবাড়িতে কয়েকটি দালান, শিব ও কালিমন্দির আছে। কলসকাঠির জমিদারবাড়িতে নীলামাধব, গনেশ, কালী, শিবের মন্দির ও দালান আছ্ েএ বাড়িতে আওরঙ্গজেব ও মুর্শিদকুলী খানের আমলের কয়েকটি দালান আছে। বাকেরগঞ্জের গারুরিয়া গ্রামে শায়েস্তানগর জমিদারদের স্থাপিত কালী, শিব, লক্ষèীনারায়ণ ও দেবমন্দির আচে। উত্তর শাহবাজপুরের জমিদার চাঁদ রায় ১৭ শতকে হিজলার গোবিন্দপুরে দালান ও মন্দির নির্মাণ করেন। তিনি বাসুদেবের মন্দির ও ৮০ হাত উঁচু কারুকার্যখচিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ও দালান নির্মাণ করেন। চাঁদ রায়ের এ সকল কীর্তি মেঘনা নদীতে বিলীন হয়েছ্ েপোনাবালিয়া, দেওরী, কেওরা, কুলকাঠি, বারৈকরণ ও সিদ্ধকাঠির চৌধুরীবাড়িতে নবাবী আমলের দালান, মন্দির ও মঠ আছে। রতনদিকালিকাপুরের জমিদার রামমোহন মালের বংশধরগণ উজিরপুরে বাস করতেন। তাদের বাড়িতে নবাবী আমলের কয়েকটি দালান, মন্দির ও মঠ আছে। নথুল্লাবাদ গ্রামে দক্ষিন চক্রম বিরূপাক্ষ ও কালীমন্দির আছে। বাকেরগঞ্জের গৌবিন্দপুরে সীতারামের মন্দির আছে। মন্দিরে খোদিত লেখার পাঠোদ্বার সম্ভব হয়নি। রহমতপুরের দেওয়ান বা চক্রবর্তীদের বাড়িতে নবাবী আমলের কয়েকটি দালান ও মন্দির আছে। রহমতপুর বাগানের নিকট মন্দির ছিল। মন্দিরটি দুই দশক পূর্বে ভেঙ্গে গেছে।

শাহ সুজার আমলের সুতালরী বন্দরের অন্যতম ধনী ভাগ্রমন্ত রায় তার মাতার সমাধির উপরে ১৫০ ফুট উঁচু মঠ নির্মাণ করেন। মঠের গায়ে শাহ সুজা লেখা ছিল। ভাগ্যমন্ত রায় দালান, নবরতœ ও মন্দির নির্মাণ করেন। প্রায় ৪৭ বছর পূর্বে সুতালরী মঠটি সুগন্ধা নদীতে বিলীন হয়েছে। খলিসাকোটা, গাভারামচন্দ্রপুর, বাগদা, দেহেরগতি, শোলক, প্রতাপপুর, বানারীপড়া, আমতলী, চলাভাঙ্গা, লক্ষ্মীপুর, লক্ষ্মীপাশা প্রভৃতি গ্রামে মোগল আমলের মন্দির আছে।

দুর্ঘ, কেল্লা ও দালান-কোঠা

মোগল আমলে বরিশাল বিভাগে অনেক দুর্ঘ নির্মিত হয়। দুর্গের মধ্যে ইটের নির্মিত দালান-কোঠা ছিল। বাকলার দুর্গগুলোর মধ্যে সুজাবাদের কেল্লা সুপরিচিত। ৭৭ একর ভূমির উপর সুজাবাদ কেল্লা নির্মিত হয়েছিল। হিজলা থানার গোবিন্দপুরের সংগ্রাম কেল্লা মোগলদের সর্ববৃহৎ নৌঘাঁটি ছিল। তিন মাইলব্যাপী সংগ্রাম কেল্লার ভিতরে ১২৮টি পুকুর ছিল। ১৮০২ খ্রিঃ পর্যন্ত সংগ্রাম কেল্লায় কয়েকটি কামান ছিল। গৌবিন্দপুরের তেঁতুলিয়ায় কোটেশ্বর নামে একটি দুর্গ ছিল। সংগ্রাম কেল্লা ও কোটেশ্বর মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। স¤্রাট আওরঙ্গজেবের সময় নির্মিত রাজাপুর থানার ইন্দ্রপাশায় দু’টি দুর্গ আছে। ঝালকাঠি থানায় রূপসিয়া গ্রামে সংগ্রাম শাহের দুর্গটি ধানসিঁড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে। নলছিটি থানার সুবিদপুর গ্রামে পাশাপাশি দু’টি উঁচু মাটির দুর্গ আছে। মনে হয় মগ জাতি ও দুর্গ নির্মাণ করেছিল। আমতলী থানার চাওরা ইউনিয়নে পাতাকাটা গ্রামে সুউচ্চ মাটির ঢিবি আছ্ েএটি দুর্গ হতে পারে। মিঃ রেনেলের ১৭৬৪-৭২ খ্রিস্টাব্দের মানচিত্রে রামনাবাদ নদীর তীরে কন্দর্প নারায়ণের নির্মিত দুটি মাটির দুর্গ দেখা যায়। বর্তমানে দুর্গের কোন চিহ্ন নেই। আগুনমুখা নদীতে প্রায় এক শ’ বছর পূর্বে দুর্গ দুটি বিলীন হয়ে যায়। রাজা রামচন্দ্র ও কীর্তি নারায়ণ গুঠিয়া, রায়পুরা, জাগুয়া, কাগাশুরা, নথুল্লাবাদ, হলুদপুর, রহমতপুর, কাশীপুর, রাজাপুর প্রভৃতি স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এ দুর্গগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। চাখারের কোটবাড়ীতে মজুমদারদের দুর্গ ছিল। চন্দ্রদ্বীপের রাজা কন্দর্প নারায়ণ, রামচন্দ্র রায়, কীর্তি নারায়ণ ও উদয় নারায়ণ অনেক দালান, মন্দির ও মঠ নির্মাণ করেন। তারা অসংখ্যা দীঘি খনন করেন। তাদের সাথে ছবি খাঁ ও বুরুম খার নাম স্মরনীয় হয়ে আছে। ছবি খাঁ ১৬১৮ খ্রিঃ বাকলা সরকারের ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে আসেন। তিনি ১৭ শতকে এ অঞ্চলে জাঙ্গাল ও পুল নির্মাণ এবং দীঘি খনন করেন। এ অঞ্চলে ছবি খাঁর কীর্তির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।৩ বুরুম খাাঁ ১৮ শতকের প্রথমভাগে সরকার বাকলায় আগমন করেন। তার প্রকৃত নাম বৈরম খাঁ হতে পারে। অনেকে বলেন তিনি আগাবাকেরের কর্মচারী ছিলেন। আবার কেউ বলেন বাকেরগঞ্জের বারআউলিয়ার দরগার উত্তর পাশে বুরুম খাঁর দীঘি তার অমর কীর্তি। তিনি চানপুরার গজনী দিঘিও খনন করেন। কাঁঠালিয়া থানার আওরাবুনিয়ার নিকটে কলাকোপা গ্রামে তার নির্মিত দালান নদীর ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে। বাকেরগঞ্জ বন্দরে বুজুর্গ উমেদ খাঁ নির্মিত গোলাবাড়িরর ধ্বংসাবশেষ আছে। নলচিড়ার সৈয়দ কুতুব শাহ অনেক মসজিদ নির্মাণ ও দীঘি খনন করেন। গৌরনদী, হিজলা, মেহেন্দিগঞ্জ ও মুলাদী থানায় তার অনেক কীর্তি ছিল।

দীঘি

বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে মোগল আমলের প্রায় দুই হাজার দীঘি ছিল। নদী ও খালের জল লবণাক্ত থাকায় পানীয়জলের জন্য চন্দ্রদ্বীপ রাজা, মোগল কর্মচারী ও ভূস্বামীর অসংখ্যা দীঘি খনন করেন। অনেক দিনের অব্যবহৃত দীঘিগুলোকে এ অঞ্চলে আন্ধি বলে। দীঘিগুলোর মধ্যে পটুয়াখালীর কারখানা, বাকরগঞ্জের কবিরাজের দীঘি, বুরুম খাঁর দীঘি, দুর্গাপাশার কুলীরমার দীঘি, নলছিটির হাবৎপুরের রাজার দীঘি, কোতোয়ালি থানার গজনীর দীঘি, উজিরপুরের শোলকের মলুয়ার দীঘি, সাহজিরার দত্ত খাঁর দীঘি, ধামুরার বাচৈর দীঘি, গৌরনদীর ছবি খাঁর পার, হিজলা থানার তেঁতুলিয়ার জমাদার বাড়িরর দীঘিটি মনে হয় শায়েস্তা খানের সময় সংগ্রাম কেল্লার জমাদার মোহাম্মদ হানিফ খনন করেছেন। মোহাম্মদ হানিফ জমাদার বাড়িতে বাস করতেন। মোগল আমলে গোবিন্দপুরে সৈন্য ও জনগণের জন্য কয়েক শ’ দীঘি খনন করা হয়েছিল। ১৬ ও ১৭ শতকে গোবিন্দপুর ও তেঁতুলিয়া একটি বিখ্যাত শহর ও মোগলদের বৃহত্তম সেনানিবাস ছিল। গোবিন্দপুর, গোয়াল ভাওর, কিস্তিপুর ও তেঁতুলিয়ার শতাধিক ঐতিহাসিক কীর্তিসহ মেঘনা নদীতে বিলীন হয়েছে। এখন অবশিষ্ট গোয়ালভাওর ও তেঁতুলিয়া গ্রামে ১০টি দীঘি আছে। শায়েস্তাবাদের রাজাপুর গ্রামের ৩৬০টি দীঘি নদীতে ভেঙ্গে গেছে। ছবি খাঁ এ জেলায় কয়েক শ দীঘি খনন করেন নবাব কর্মচারী মলুয়া রাজা তার নামে দীঘি খনন করেন। মগের আক্রমণের সময় নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি পরিবারের লোকজন নিয়ে মলুয়ার দীঘিতে আত্মহত্যা করেন। দাউদ শাহ, শাহ কামাল, খুদগীর প্রমুখের দীঘি সম্পর্কে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে যে, অনেক সময় রান্নার জন্য সোনার পাত্র পাওয়া যেত। একদিন এক দুষ্ট লোক একটি পাত্র চুরি করে নিয়ে যায়। তারপর আর পাত্রগুলো দীঘির পারে আসেনি।

কামান ও মুদ্রা

বাকেরগঞ্জে অনেকগুলো কামান ছিল। সংরক্ষণের অভাবে কামানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। মাধবপাশা, সুজাবাদ, সংগ্রাম কেল্লা ও নলচিড়ার মিয়াবাড়িতে কামান ছিল। বর্তমানে নলচিড়া মিয়াবাড়িতে একটি ছোট কামান আছে। কামানটি চার হাত লম্বা ও ১২ ইঞ্চি প্রস্থ। এ বাড়ির দীঘিতে আরও কামান আছে বলে মনে হয়। ভুরঘাটা পুলের নিকট মাটির নিচে দু’খানা ১২ হাত লম্বা ও ধানডোবার বিলে ৯ হাত লম্বা একখানি তরবারি পাওয়া যায়। বাকেরগঞ্জ-পটুয়াখালীর বিভিন্ন স্থান মোগল যুদের মুদ্রা পাওয়া গেছে। ১৯৪১ খ্রিঃ নাজিরপুর থানার শাঁখারিকাঠির মুন্সী কমিরউদ্দিন মোগলের নিকট পিরোজপুরের এসডিও সাদাত হোসেন স¤্রাট আকবরের ১৫৯৩ ও ১৫৯৫ খ্রিঃ ৫টি মুদ্রা ক্রয় করেন। বাউফল থানার ধুলিয়া গ্রামের ফ্যালান হাজীর বাড়িতে ইটের ভিতর আরবী অক্ষরে লেখা রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া যায়। মোমিনপুরের ভিটাবাড়ী চাষ করার সময় দশক দুই পূর্বে স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। শরিকুল বন্দরের সুলতানী ও মোগল যুগের মুদ্রা পাওয়া যায়। এ অঞ্চলে কয়েকটি পরিবার মোগল আমলের মুদ্রা (গুপ্তধন) পেয়ে অনেক ভূ-সম্পত্তির মালিক হয়েছে।

শহর ও অন্যান্য

ডি ব্যারোসের মানচিত্রে দেখা যায় ১৬ ও ১৭ শতকে সুন্দরবন অঞ্চলে ৫টি শহর ছিল।পাঁচটি শহরের মধ্যে ডা-পারা ও টিপুরিয়া বাকলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। বাউফল থানার দাসপাড়াকে পর্তুগীজরা ডা-পাড়া উচ্চারণ করেছে।৪ ১৫ শতক হতে ১৭ শতক পর্যন্ত দাসপাড়া একটি উন্নত শহর ও সামুদ্রিক বন্দর ছিল। কালাইয়া নদীর দক্ষিণ কূলে এবং বাউফল বন্দরের পূর্ব পারে দাসপাড়া শহর ও বন্দর ছির। দাসপাড়ার মাটির নিচে প্রাচীন দালানের ভগ্নাবশেষ আছে। চারদিকে পুরনো ইট পাওয়া যায়। এ শহরে পর্তুগীজরা বাকলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোক বন্দী করে এনে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিত। ১৭ শতকে বাউফল বন্দর দাস ক্রয়-বিক্রয়ের কেন্দ্র ছিল বলে দাসপাড়া নামকরণ হয়েছে। টিপুরিয়া ত্রিপুরা বা কুমিল্লা হতে পারে না। কারণ ত্রিপুরা সুন্দরবন থেকে অনেক অভ্যন্তরে। ডি ব্যারোসের মানচিত্রের অবস্থান থেকে মনে হয় টিপুরিয়া বরিশালের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত ছিল। মোগল আমলে গৌরনদীর কসবা ও হিজলার গোবিন্দপুরে শহর ছিল। ১৭ শতকে গোবিন্দপুর, গোয়ালভাওর, তেঁতুলিয়া, কিস্তিপুর ও পোমা গ্রাম নিয়ে একটি শহর গড়ে ওঠে। মেঘনা ও পদ্মা নদীর সঙ্গমস্থলে এ শহর অবস্থিত ছিল। শহর ও বন্দরের নাম খুব সম্ভব তেঁতুলিয়া ছিল। তেঁতুলিয়া তখন একটি ছোট নদী ছিল। তেঁতুলিয়ার তীরে শহরের অবস্থান থেকে নামকরণ হয় তেঁতুলিয়া বা পর্তুগীজ ভাষায় টিপুরিয়া। গোবিন্দপুর, কিস্তিপুর, পোমা প্রভৃতি গ্রাম মেঘনা নদীতে ভাঙ্গনের সময় শতাধিক ইটের নির্মিত দালানের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। ভাঙ্গনের সময় মনে হতো এক মৃত শহর মেঘনায় তলিয়ে যাচ্ছে। গলাচিপার কালা রাজার বিলের মধ্যে জঙ্গলাবৃত দালানের ধ্বংসাাবশেষ ও দীঘি আছে। কাঁঠালিয়া ও ভান্ডারিয়ার রামপুর, চেচরী ও কৈখালী বিলে দালানের ধ্বংসাবশেষ ও দীঘি আছে। ১৭ শতকে মগ-পর্তুগীজদের আক্রমণে এ অঞ্চল জনশূন্য হয়ে পড়ে। মোগল আমলে বরগুনা, বামনা, পাথরঘাটা ও মঠবাড়িয়ার দু’-একটি স্থান ছাড়া কোথাও জনবসতি ছিল না। মঠবাড়িয়া খাস কাছারির নিকটে ১৯ শতকের প্রথম ভাগে আবাদের সময় একটি মঠ আবিষ্কৃত হয়। রামনা গ্রামে দুটি প্রাচীন দীঘির চিহ্ন আচে। আমতলী থানার ফকিরখালী গ্রামে একটি দীঘি ও মাটির টিলা আছে। হয়ত এখানে কোন ফকির বাস করত। নিকটবর্তী কালীবাড়ী গ্রামে মন্দির ছিল। বানারীপাড়া থানার বলদিয়া বিলে উমরেরবাড়ী বা উমরেরপার আছে। প্রায় ১০০ বছর পূর্বে বিলের ৫ হাত নিটে ইটের ঘাটলা পাওয়া যায়। এখানে জনৈক উমরের বাড়ি ছিল। বলদিয়ায় একসময় জনবসতি ছিল। প্রাকৃতিক কারণে বিলে পরিণত হয়। পূর্বে এ বিলে নৌকার মাস্তুল দেখা যেত। গৌরনদীর ধানডোবার বিলেও জাহাজের মাস্তুল দেখা যায়। বেতাগী থানার মোকামিয়া, করুণা, লক্ষ্মীপুরা, আমতলী থানার গুলিসাখালী, বিঘাই, গোছখালী, গলাচিপা, বাউফল থানার মঠবাড়ি, বাকেরগঞ্জের চর আউলিয়াপুর, গোবিন্দপুর প্রভৃতি স্থানে প্রাচীন কীতি ছিল। বর্তমানে সেগুলোর কোন চিহ্ন নেই। ভগ্ন মসজিদ, মন্দির, মঠ ও দালানের ইট দিয়ে এ অঞ্চলে অনেকে রাস্তা ও বাড়ি নির্মাণ করেছে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাচীন কীর্তি কে নির্মাণ করেছেন তা কেউ বলতে পারে না। তাদের পূর্বপুরুষদের আগমনের পূর্বে এ সকল কীর্তি বর্তমান ছিল। মগ-পর্তুগীজদের আক্রমণের ফলে জেলার দুই-তৃতীয়াংশ জনশূন্য হয়েছিল। ১৮ শতকের প্রথমভাগে আবাদ শুরু হলে জঙ্গলের মধ্যে অনেক মন্দির, মসজিদ, মঠ, প্রাচীন বাড়ি ও দীঘি পাওয়া যায়।

স্থাপত্য শিল্প

মোগল শাসনকালে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে নতুন ধরনের স্থাপত্য শিল্প প্রচলিত হয়। এটা মোগল স্থাপত্য শিল্প নামে পরিচিত। দিল্লী, আগ্রা ও ঢাকার স্থাপত্য শিল্পের অনুকরণে বাকলার মসিজদ, দুগ, মন্দির ও দালান নির্মিত হয়। জমকালো গম্বুজ, খিলানের কারুকার্য ও বৃত্তাংশ খচিত স্তুম্ভ মোগল যুগে নির্মিত মসজিদগুলোর বৈশিষ্ট্য। বাকলার স্থাপত্য শিল্পে ইরান ও দেশীয় স্থাপত্যের প্রভাব বিদ্যমান আছে। সুন্দরী, পশুরি, গোলপাতা, বাঁশ, খড় প্রভৃতি দিয়ে এ অঞ্চলে দোচালা, চৌচালা ও আটচালা ঘর নির্মিত হয়। দোচালা ঘরের পদ্ধতি বাকলায় সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য এ ঘরকে বাঙ্গালা বলে। এ অঞ্চরে মসজিদ ও মন্দিরের দেশীয় দোচালা ও চৌচালা ঘরের অনুকরণ করা হতো। বড় চৌচালা মন্দিরের উপরে চারকোণে চারটি এবং মধ্যস্থলে একটি চূড়া দেয়া হতো। এরূপ মন্দিরের নাম পঞ্চরতœ। উক্ত পাঁচটি চূড়া ব্যতীত বারান্দার চারকোণে চারটি চূড়া থাকত। এ মন্দিরের নাম নবরতœ। এরূপ কারুকার্য দেশীয় স্থাপত্যের বিশেষত্ব। রায়েরকাঠির নবরতœ মন্দির মোগল ও দেশীয় স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। বাকলা বা বরিশালের মসজিদগুলো মোগল শিল্পের অনুকরণে নির্মিত হলেও দেশীয় স্থাপত্যের প্রভাব আছে। হিন্দু মন্দিরের মতো এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ ও এ অঞ্চলে বেশি। বাকলার শ্রমিক ও কারিগররা এ সকল মসজিদ ও মন্দির নির্মাণ করেন। অবশ্য ঢাকা ও দিল্লী থেকে আগত দক্ষ কারিগররা তাদের সাহায্য করেছেন। স্থানীয় চুন-সুরকি দ্বারা তারা দালান, মসজিদ ও মন্দির নির্মাণ করেছেন। বাকলার শামুক ও ঝিনুক দিয়ে চুন তৈরি হতো। এ অঞ্চলের স্থাপত্যে বাকলার শিল্পীদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে।৫


তথ্য নির্দেশ

১. Dr. A. H. Dani, Muslim Architecture in Bengal ২. রোহিণী রায় চৌধুরী ৩. The District Gazetter of Bakerganj ৪. District Gazetter of Patukhali ৫. Preliminary Archeological Survey of Barisal Division.