মোগলদের বিরুদ্ধে চন্দ্রদ্বীপের স্বাধীনতা যুদ্ধ

Barisalpedia থেকে

চন্দ্রদ্বীপের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ অনিুষ্ঠিত হয় ১৬১১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এটি ছিল রাজা রামচন্দ্রের নেতৃত্বে মোগলদের বিরুদ্ধে চন্দ্রদ্বীপের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ।


যুদ্ধের পটভূমি

রাজা মানসিংহের সাথে সাথে মৈত্রি চুক্তি করে কন্দর্প নারায়ণ রাজত্ব করতেন। এই চুক্তি ভেঙ্গে রাজা রামচন্দ্র সোনারগাঁওয়ের মুসা খাঁ ও যশোরের প্রতাপাদিত্যের মতো খুব সম্ভব ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে বাকলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। রামচন্দ্র শ্বশুর প্রতাপাদিত্যের সাথে একত্রিত হয়ে মোগলদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বিরাট সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন। বাকলার হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান তার সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। অনেক পলাতক পাঠান রামচন্দ্রের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন মীরবহর কৃষ্ণ জীবন। শত শত কিস্তি নৌকা নির্মিত হয়। বরিশালের ঢালী, মাল, পাইক প্রভৃতি উপাধিধারী লোকদের পূর্বপুরুষ রামচন্দ্রের বাহিনীতে ছিল।


যুদ্ধের আয়োজন

১৬১১ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে জাহাঙ্গীরের সুবেদার ইসলাম খাঁ সেনাপতি এনায়েত খাঁ ও মির্জা নাথানের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী যশোর অভিযানে প্রেরণ করেন। অপর একটি বহিনী সৈয়দ হকিম, সৈয়দ কাশু ও ভূষনের রাজা শত্রুজিতের নেতৃত্বে বাকলায় প্রেরণ করেন। বাকলার রাজা রামচন্দ্র যাতে যুদ্ধে তার সৈন্যবহিনী দিয়ে প্রতাপাদিত্যকে যাতে সাহায্য করতে না পারে সে জন্য একই সাথে ইসলাম খাঁ যশোর ও বাকলা রাজ্য আক্রমণ করেন। ইসলাম খাঁ রামচন্দ্রকে আত্মসমর্পন ও মোগলদের অধীনতা স্বীকার করার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। রামচন্দ্র ইসলাম খাঁর পত্র প্রত্যাখান করে বাকলার স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সৈন্য সমাবেশ করলেন। রামচন্দ্রের সৈন্যবহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল হলুদপুর, নারায়ণপুর, কাশীপুর, নথুল্লাবাদ, কাগাশুরা ও ক্ষুদ্রকাঠী। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দে মোগলদের সাথে যুদ্ধ কোন স্থানে হয়েছে তা সঠিকভাবে বলা যায়না। তবে যুদ্ধে কয়েক জায়গায় হয়েছে। নৌযুদ্ধ হয়েছে শায়েস্তাবাদ, বরিশাল ও জাহাপুর নদীতে। সুজাবাদ হতে ক্ষুদ্রকাঠি পর্যন্ত নদীর তীরে নৌবাহিনী কামানসহ প্রস্তুত ছিল। অশ্বারোহী, হস্তী ও পদাতিক বাহিনীর প্রধান যুদ্ধ হয়েছিল বাবুগঞ্জ থানার ক্ষুদ্রকাঠি ও খানপুরার নিকটস্থ সংগ্রামে।

রামচন্দ্র প্রায় এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে মোগলদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ন হন। পর্তুগীজদের সেনাপতি জন গেরী ভারী কামান ও বন্দুক নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য ১০ হাজর সৈন্য নিয়ে এগিয়ে গেলেন। সেনাপতি, নানা ফার্নান্ডেজ, মীরবহর জীবনকৃষ্ণ রায় প্রমুখ সেনাপতি তাদের স্ব স্ব বহিনী নিয়ে মোগল বহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজা রামচন্দ্র নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। পাশেই প্রধানমন্ত্রী সারাই আচার্য রাজাকে পরামর্শ দিচ্ছেন। মোগলা সেনাপতি সৈয়দ হাকিম, সৈয়দ কাশু, মির্জা নুরুদ্দীন, রাজা শত্রুজিত ও ইসলাম কুলি নৌবহর , তিন হাজার বন্দুকধারী সৈন্য, কুড়িটি হাতি ও এক বিপুল বাহিনী নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামী চন্দ্রদ্বীপ-বাকলার সৈন্য বাহিনীকে আক্রমন করে। ওলন্দাজ ও পর্তুগীজ সেনাদের কামান ও গোলার আঘাতে মোগল বহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। মোগলদের নৌবাহিনী রামচন্দ্রের বাহিনীর সাথে পেরে উঠতে পারেনি। মীরবহর জীবনকৃষ্ণ জাহাপুর ও কীর্তনখোলা নদীতে মোগল বাহিনীকে তীব্রভাবে আক্রমন করেন। রাজার হস্তী বহিনী মোগলদের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। রামমোহন মাল অসীম সাহসে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।


যুদ্ধে চন্দ্রদ্বীপের অনুকূল অবস্থা

মোগল সেনাপতি সৈয়দ হাকিম ভেবেছিলেন রামচন্দ্র প্রথম দিনের যুদ্ধেই আত্মসমর্পন করবেন। কিন্তু কয়েকদিন যুদ্ধে করে দেখলেন বাকলা চন্দ্রদ্বীপের বীর সেনাবাহিনী মোগল বাহিনীর চেয়ে সাহসী ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। তাই তিনি ও রাজা শত্রুজিত গোপনে রাজচন্দ্রের মাতাকে সন্ধির প্রস্তাব দিতে দূত প্রেরণ করেন। রাজমাতা মোগলদের ভক্ত। তিনি পুত্র রামচন্দ্রকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেন। রামচন্দ্র তার মাতাকে বললেন, বাকলা সেনাবাহিনীর জয় সুনিশ্চিত। সুতরাং মোগলদের নিকট আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি যুদ্ধ চালিযে যাবেন। রাজমাতা পুনরায় রামচন্দ্রকে বললেন, তিনি যদি যুদ্ধ বন্ধ না করেন তবে তিনি বিষপাণে আত্মহত্যা করবেন। ৭ দিন ধরে রামচন্দ্র অবিরাম যুদ্ধ করছেন। হাজার হাজার সৈন্য বাকলার স্বাধীনাতার যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন। মাতৃভক্ত রামচন্দ্র বাধ্য হয়ে মোগল সেনাপতির নিকট সন্ধির প্রস্তাব পাঠালেন। এক সপ্তাহব্যাপী রক্তক্ষয়ী সঙগ্রাম শেষ হলো। মোগল সেনাপতি রাজা রামচন্দ্রকে বন্দী করলেন। শত্রুজীত রামচন্দ্রকে নিয়ে ঢাকায় ইসলাম খাঁর নিকট যান। ইসলাম খা রামচন্দ্রকে তার নৌবহর ব্যয় নির্বাহের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু অঞ্চল নির্দিষ্ট করে দেন। অবশিষ্ট অঞ্চল নতুন অনেককে জায়গীর হিসাবে প্রদান করেন। রামচন্দ্র মোগলের অধীন হয়ে যান এবং তার রাজ্য খন্ড-বিখন্ড হয়।


উপসংহার

মোগল বাহিনীর সাথে রামচন্দ্রের এই যুদ্ধ ‘সংগ্রাম’ নামে পরিচিত। বাবুগঞ্জ থানায় যে জায়গায় স্থলযুদ্ধ হয়েছিল সেই স্থানের নামকরণও হয়েছিল ‘সংগ্রাম’ নামে। সংগ্রাম নামের এই গ্রামটি ১৯০৩ সালের জরিপে ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামের মধ্যে লীন হয়ে যায়। তবে খানপুরা খাল থেকে বাবুগঞ্জ সার্কেল অফিস পর্যন্ত খালটিকে এখনো সংগ্রামের খাল বলা হয়। এই সংগ্রামের ফলে চন্দ্রদ্বীপ রাজাদের তিনশো বছরের স্বাধীনতার ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে উলফৎ গাজী মোগলদের সাহায্য করেছিল। তাই সম্রাট জাহাঙ্গীর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে চন্দ্রদ্বীপ থেকে সৃষ্ট নাজিরপুর পরগনা প্রদান করেন। গৌরনদীর নলচিড়ার মিয়ারা উলফৎ গাজীর বংশধর। জাহাঙ্গীর চন্দ্রদ্বীপ থেকে সৃষ্ট আরেকটি পরগণা সেলিমাবাদ দান করেন মদনমোহন রায়কে। ১৬১১ থেকে ১৬২৭ সাল পর্যন্ত চন্দ্রদ্বীপ সম্রাট জাহাঙ্গীরের অধীন ছিল।



তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস। ভাস্কর প্রকাশনী, ২০১০।