মুন্সী মুহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন

Barisalpedia থেকে
Spadmin (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:০৬, ২৬ জুলাই ২০২০ পর্যন্ত সংস্করণে (" ঊনবিংশ শতকের বাঙ্গালি মুসলমানদের মাঝে অগ্রগণ্য সাহিত্য..." দিয়ে পাতা তৈরি)

(পরিবর্তন) ←পুর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ→ (পরিবর্তন)

ঊনবিংশ শতকের বাঙ্গালি মুসলমানদের মাঝে অগ্রগণ্য সাহিত্যিক ও সম্পাদক ছিলেন মুন্সী মুহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন। জন্ম: ১৮৬২ সাল। মৃত্যু: ১৯৩৩। গ্রাম: কাউনিয়া, বরিশাল শহর, বরিশাল।


শিক্ষাজীবন

বাল্যকালে পিতৃহীন মুন্সি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন ১২৮৩ বঙ্গাব্দে কুমিল্লার অধীন বাজাপ্তী গাজীপুর সার্কেল স্কুল থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পীর, মুরিদি ও শিক্ষকতা ছিল তাঁদের বংশজাত পেশা। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের পিতৃব্যের আশ্রয়ে থেকে বরিশাল বঙ্গবিদ্যালয়ে প্রাথমিক অধ্যয়ন। কিছুকাল পরে কুমিল্লা জেলার রূপসা গ্রামের জমিদার ও লেখিকা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর স্বামী চৌধুরী মোহাম্মদ গাজীর বাড়িতে নীত হন। সেখানে আরবি ও ফারসি অধ্যয়ন করেন। এরপর বাজাপ্তী গাজীপুর সার্কেল স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে বাঙ্গালা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ত্রিপুরা জেলায় (বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা) প্রথম হন।


সম্পাদনা ও সাংবাদিকতা

এরপর রূপসার পাঠশালায় শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। এখানে ‘মুসলমান (১৮৮৪) নামক পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত। পরে ঢাকায় ‘শ্রীমন্ত সওদাগর’ নামক একটি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হন। এরপর ‘নবসুধাকর’ (সাপ্তাহিক, ১৮৮৬) পত্রিকার সম্পাদক হন। এ সময় ‘ইসলাম প্রচারক’ (১৮৯১) নামক অপর একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন। ১৯০৬-এ তাঁর সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক সোলতান’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। শেষ জীবনে ‘নবযুগ’ ও ‘বয়াত বন্ধু’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। মুন্সী রেয়াজুদ্দীন আহমদের ভাষাজ্ঞান ছিল তীক্ষ্ম। তিনি এক সময় বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’ গ্রন্থের কয়েকটি অসঙ্গতি নির্দেশ করে পত্র লিখেন, বিদ্যাসাগর তা যথারীতি সংশোধন করে তাঁর পত্রের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলেন।


রচনাবলী

রচিত উল্লেখযোগ্য ধর্মতত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ ‘তোফাতুল মুসলেমিন’। অন্যান্য গ্রন্থ: বোধোদয়তত্ত্ব, গ্রীস তুরস্ক যুদ্ধ, হযরত মোহাম্মদ মোস্তফার জীবনচরিত (১৯২৭), পাক পাঞ্জাতন, হযরত ফাতেমা জোহরা (রাঃ), হক নসিহত, জঙ্গে রাম ও ইউনান, জোলেখা, বৃহৎ হীরকখনি, উপদেশ রতœাবলী, জোবেদা খানমের রোজনামচা, আমিরজানের ঘরকন্না, বিলাসী মুসলমান (১৯০৯), কৃষকবন্ধু কাব্য, আমার সংসার জীবন, মুসলমান সাহিত্যের ইতিহাস, মোসলেম পাক প্রণালী ইত্যাদি।


মূল্যায়ন

মুন্সি রেয়াজুদ্দিন সাহিত্যিক হিসেবে যত বড় তার চেয়ে বড় বাঙ্গালি মুসলমানদের মাতৃভাষা ও মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে তাঁর প্রচেষ্টা ও কৃতিত্ব। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে বিভিন্ন জেলায় কিছু বাঙ্গালি মুসলমান মিশনারিদের প্রচার ও প্রলোভনে খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। এমনকি মুন্সি জমিরুদ্দিনের মতো লোকও ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। ধর্মভিত্তক সা¤্রাজ্যবাদিতার এই প্রবণতা রোধে মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে জাতীয় ঐতিহ্য ও আলোকিত চিন্তা সাধারণের মাঝে পৌঁছে দেয়ার ব্রত নিয়ে যে তিনজন লেখক ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে জীবন পণ করেছিলেন তাঁরা হলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক পন্ডিত রেয়াজুদ্দিন আহমদ মাশহাদী, পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট নিবাসী মুন্সী শেখ আব্দুর রহিম ও বরিশালের সন্তান মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন আহমদ। তাঁরা বিভিন্ন ইসলামী প-িতদের বই বাংলায় অনুবাদ করে ‘এসলাম তত্ত’¡ নাম দিয়ে প্রকাশ শুরু করেন। ‘এসলাম তত্ত্ব’ খ-াকারে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতো বলে ইহাকে অনেকে মাসিক পত্রিকা মনে করতেন। ‘এসলাম তত্ত্বের’ বিক্রয়লব্ধ অর্থে এবং টাঙ্গাইলের করটিয়ার জমিদার মাহমুদ আলী খান ও বর্ধমানের কুসুম গ্রামের জমিদার মুন্সী মোহাম্মদ এবরাহিমের অর্থানুকুল্যে শেখ আব্দুর রহিম এবং মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দিন ১৮৮৯ সালের আশ্বিন মাসে ‘সুধাকর’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। ‘সুধাকর’ বাংলায় মুসলমানদের সাহিত্য সাধনায় একটি অসাধারণ জোয়ার এনেছিল। ‘সুধাকরের’ সাহিত্য কর্মীদের সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাই লিখেছেন- ‘বাংলায় মুসলিম জাতীয় সাহিত্য সৃষ্টির নেশায় এঁরা যেমন করে মেতেছিলেন এবং প্রাণঢালা সাধনা করেছিলেন, এঁদের আগে তেমন আর কাউকে দেখা যায় না’ (৯৫)। বিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের যে জাগরণ তার ভিত্তিভূমি রচনায় ‘সুধাকর’ প্রবর্তক বরিশালের সন্তান মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীনের অবদান স্থায়ীভাবে স্মরণীয়। সুধাকর-ভিত্তিক সাহিত্য ধারা প্রবর্তনে মুন্সী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীনের সুদূর প্রসারী অবদানের তুলনায় নিজস্ব সাহিত্যকর্মের মাধমে তাঁর অবদান কিছুটা নিষ্প্রভ। তবে তাঁর লিখিত ১৭খানা গ্রন্থের মধ্যে স্মৃতিকথা জাতীয় গ্রন্থ ‘আমার সংসার জীবন’ ও ‘মুসলিম সাহিত্যের ইতিহাস’ ইতিহাস চর্চায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।


মৃত্যু

১৯৩৩ সালে কোলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।



তথ্যসূত্র: রুসেলি রহমান চৌধুরী। বরিশালের প্রয়াত গুণীজন। ইউনিভার্সিটি বুক পাবলিশার্স, ঢাকা। ২০০৬।