মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী

Barisalpedia থেকে

মুক্তিযুদ্ধে পটুয়াখালী ছিল ৯ম সেব্টরের একটি সাব-সেক্টর। পটুয়াখালী ও বরগুনা মহকুমা নিয়ে পটুয়াখালী সাবসেক্টর গঠিত ছিল। ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম পটুয়াখালীর কমান্ডার এবং জহির শাহ আলমগীর টুআইসি বা সহঅধিনায়ক ছিলেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতি

কয়েকটি উপদলকে একত্রিত করে মেহেদী অস্ত্র সংগ্রহ করেন। বেতাগীর ছাত্রলীগ নেতা হুমায়ুন কবীর হিরু আনসারদের নিকট থেকে কয়েকটি রাইফেল উদ্ধার করে মেহেদীকে দেন। মির্জাগঞ্জের হারুন-অর-রশিদ কয়েকটি অস্ত্র নিয়ে মেহেদীর সাথে যোগ দেন। বরগুনার ছাত্রলীগ নেতা সিদ্দিক, দীলিপ, রশীদ, হোগলাপাতির কামাল, জামাল প্রমুখ ক্যাপ্টেন মেহেদীর নেতৃত্বে চলে আসেন। তারা সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য মুজিবনগর চলে যান। মেহেদী অস্ত্র আনার জন্য ৩০ আগস্ট জহির শাহ আলমগীর ও আউয়ালকে ভারতে পাঠিয়ে দেন। তিনি নিজে সুন্দরবন গমন করে ক্যা. জিয়াউদ্দীন এর ক্যাম্প হতে অস্ত্র নিয়ে আসেন। বামনা থানার বুকাবুনিয়া স্কুলে পটুয়াখালী সাব-সেক্টরের প্রধান ক্যাম্প ছিল। ক্যা. মেহেদী ৫ জন কমান্ডার নিয়োগ করেন- আমতলী-খেপুপাড়া জন্য সুবেদার হাতেম, বামনার জন্য সুবেদার আবদুল মজিদ, পাথরঘাটায় পুলিশ কাসেম, ও বেতাগীর জন্য মোতালিব । জুন মাস হতে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ও দালাল হত্যা করে। বেতাগী থানার কয়েকজন কুখ্যাত দালাল মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ দেয়। পটুয়াখালীর দক্ষিণ অঞ্চল মুক্ত ছিল। পাকবাহিনী উপকূলে যায়নি। বামনার সুবেদার হাতেম খেপুপাড়া ও আমতলরি কমান্ডার। তালতলীর আগাঠাকুর পাড়ায় তার ক্যাম্প ছিল। দালালের সহযোগিতায় পাক সেনারা নভেম্বর মাসে হঠাৎ আগাঠাকুর পাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প আক্রমণ করলে সুবেদার হাতেম তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালান। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। উভয় পক্ষে হহাহত হয়। পাকবাহিনী ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আহত অবস্থায় বন্দি করে পটুয়াখালী নিয়ে আসে এবং ১৯ নভেম্বর তাদের ডিসের লঞ্চঘাটে হত্যা করে। আলতাফ হায়দার ও হারুন-উর-রশিদ হিরুর নেতৃত্ত্বে মুক্তিবাহিনী মির্জাগঞ্জ থানা আক্রমণ করে অস্ত্র নিয়ে নেন এবং কয়েকজন রাজাকার হত্যা করেন। কমান্ডার নুরুল হুদা তার বাহিনী নিয়ে মুজিবনগর থেকে নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে পটুয়াখালী আগমন করেন এবং পটুয়াখালী জেলায় অভিযান চালান। পটুয়াখালী জেলার কমান্ডারগণ: ১. পটুয়াখালী- গাজী দেলওয়ার হোসেন নূরুল হুদা; ২. মির্জাগঞ্জ- আলতাফ হায়দার, ৩. বাউফল- পঞ্চম আলী, ৪.গলাচিপা- আবদুর রব ও নূরুল হুদা, ৫. খেপুপাড়া-আমতলী- সুবেদার হাতেম আলী, ৬. বরগুনা- সিদ্দিকুর রহমান, আবদুর ছাত্তার ও জুলফিকার জুলফু, ৭. বেতাগী- আবদুল মতলেব, ৮. বামনা- আবদুল মজিদ, ও ৯. পাথরঘাটা- আবুল কাসেম। নবম সেক্টর কমান্ডারের আহ্বানে ক্যাপ্টেন মেহেদী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর গমন করেন এবং নবম সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডারদের অধিবেশনে যোগ দেন। তাঁর আবর্তমানে জহির শাহ আরমগীর মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যান। পটুয়াখালী জেলায় মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের সাথে কয়েকটি সংঘর্ষ পরিচালনা করেন। তারা খেপুপাড়া, বাউফল, গলাচিপা, বামনা, পাথরঘাটা, মির্জাগঞ্জ আক্রমণ করে অস্ত্র উদ্ধার করেন। তাদের হাতে অনেক রাজকার ও শান্তি কমিটির সদস্য নিহত হয়। ছাত্র নেতা গাজী দেলওয়ার তার বহিনী নিয়ে পটুয়াখালীতে পটুয়াখালী শহরের নিকট কয়েকটি আক্রমণ চালিয়ে পাক বাহিনীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করেন। মৌকরণের কাজী মোতালেব পটুয়াখালীর সাবেক এমপিএ রাজা মিয়ার হত্যাকারী সুবেদারকে মৌকরণের বাজার হতে ধরে হত্যা করেন। পটুয়াখালীর কয়েকটি যুদ্ধ ও সংঘর্ষ নিম্নরূপ।

কালীশূরী-চাঁদকাঠি যুদ্ধ

বাউফলের সুবেদার পঞ্চম আলী জুন মাসে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন। তিনি অনেক পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার হত্যা করে পাকসেনাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেন। তিনি কালীশূরী বন্দরের নিকট একটি লঞ্চ আক্রমণ করে কয়েকজন পাকসেনা, পুলিশ হত্যা করে ও অস্ত্র উদ্ধার করেন। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাকসেনারা কালীশূরী বন্দরটি পুড়ে দেয়। কালীশূরী বন্দরে ছিল পাকসেনা ও রাজাকারদের ক্যাম্প। পঞ্চম আলী ক্যাম্প আক্রমণ করে কয়েকজন পাকসেনা ও রাজাকার হত্যা করেন। কালিশূরী বন্দরের নিকট ভাতশালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধার ঘাঁটি ছিল। কমান্ডার ছিলেন সেনাবাহিনীর সুবেদার পঞ্চম আলী। ১৯৭১ সারের ১১ সেপ্টেম্বর কালিশূরী বন্দরের হাটবার ৫০ জন পাকিস্তান সেনা ও রাজাকারের দল কালিশূরী বন্দর পোড়াতে আসে। প্রথমে হাট সংলগ্ন সাজজাল বাড়িতে আগুন দেয়। এ সময় কমান্ডার পঞ্জম আলী তার বাহিনী নিয়ে উত্তর দিক থেকে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বাকবাহিনী কুমারখালী খালের হোগলা বনে অবস্থন নেয়। তারা মেশিনগান ও মর্টার দিয়ে মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী ও গ্রামবাসী জয় বাংলা ¯েœাগান দিয়ে পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে। ৭ ঘন্টা যুদ্ধ চলে। কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। তারা রাতের আঁধারে রাজাকার কমান্ডার মান্নান দারোগার সহায়তায় বাউফল থানায় আশ্রয় নেয়। চাঁদকাঠির যুদ্ধে পাকবাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ পটুয়াখালী পৌঁছে। চাঁদকাঠি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন- সুবেদার পঞ্চম আলী, ধুলিয়া; আওলাদ হোসেন, কালিশূরী; মকিম আলী, ধুলিয়া; কলম খাঁ, দাশপাড়া; মিয়া খাঁ, দাশপাড়া; ফজলুল হক, কনকাদিয়া; জসিম উদ্দিন, কমলাপুর; মোঃ আলম, ধুলিয়া; হাবিবুর রহমান, কাউখালী; মনোয়ার হোসেন, কাউখালী; আলী হোসেন, মমিনপুর; মতিয়ুর রহমান, কমলাপুর; সোলায়মান, মুমনপুর; হামেজ আলী, দুমকি; দেলওয়ার শরীফ, মুরাদিয়া; আউয়াল, দুমকী; রাজ্জাক মৃধা, মুরাদিয়া; এসএম ফরিদ, কালিশূরী; ও সালাম, মুরাদিয়া। চাঁদকাঠি যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের মনোবল বৃদ্ধি পায়। পাকবাহিনী পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কয়েক দিন পর কালিশূরী বন্দর পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। ধুলিয়া গ্রামের পাকবাহিনীর দালাল ছত্তার মওলানাকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করে তার লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখে। এ সংবাদ পেয়ে পাকবাহিনী ধুলিয়া গ্রামে এসে ৬০ জন গ্রামবাসীকে তেঁতুলিয়া নদীর তীরে দাঁড় করে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়।

পানপট্টির যুদ্ধ

পটুয়াখালী অঞ্চলে গলাচিপার আবদুর রব সুন্দরবনের সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়াউদ্দীনের নিকট হতে অস্ত্র এনে দল গঠন করেন এবং অন্যান্য দলকে অস্ত্র সরবারাহ করেন। কমান্ডার নুরুল হুদা ও শওকত মুজিবনগর হতে একটি দল নিয়ে গলাচিপা পৌঁছেন এবং পানপট্টি কমিউনিটি সেন্টারে ক্যাম্প স্থাপন করেন। ২৬ নভেম্বর মেজর ইয়ামিন পটুয়াখালী হতে এক বিরাট বাহিনী নিয়ে পানপট্টি আক্রমণ করে। নুরুল হুদা ও আবদুর রব হাদের বাহিনী নিয়ে পাক সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকেন। তাদের সহযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন শওকত, খোকন, মোস্তফা, রতন, ভূদেব, গোমেজ প্রমুখ। সকাল হতে বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। পাক সেনাদের অনেকে নিহত ও আহত হয়। পরিশেষে মেজর ইয়ামিন তার বাহিনী নিয়ে পানপট্টি থেকে পালিয়ে পটুয়াখালী ফিরে আসে। পানপট্টি যুদ্ধে প্রমাণিত হলো যে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী হয়েছে।


পটুয়াখালী মুক্ত ৮ ডিসেম্বর

২৭ নভেম্বর পানপট্টির যুদ্ধের পর কমান্ডার নুরুল হুদা ও আবদুর রব বাউফল ও গলাচিপা থানা দখল করে। এদিকে গাজী দেলওয়ার বেটি নামে একটি বিদেশী জাহাজ দখল করেন। নৌবাহিনীর শাহজাহান বেটি যুদ্ধ জাহাজ হিসেবে ব্যবহার করেন। সুবেদার হাতেম, গাজী দেলওয়ার, মোয়াজ্জম খেপুপাড়া থানা আক্রমণ করেন এবং সারারাত যুদ্ধের পর থানার দারোগা আত্মসমর্পণ করে। সুবেদার হাতেম ১৩ ডিসেম্বর কুয়াকাটার নিকট পাক-সেনাদের জাহাজ এম এল বারকী আক্রমণ করেন ৩৭ জন পাকসেনা বন্দি করে এবং অনেক অস্ত্র উদ্ধার করেন। যশোর পতনের পর পাক সেনারা একজন লেফটেন্যান্টের নেতৃত্বে পালিয়ে কুয়াকাটা পৌঁছে। সকল পাক সেনাকে ২৫ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সিরাজ উদ্দীন আহমেদের সাথে সাথে বন্দি সেনাদের পটুয়াখালীতে সাক্ষাৎ হয়। আলতাফ হায়দার ও হারুন-অর-রশিদ ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখে মির্জাগঞ্জ থানা দখল করেন। যশোর ক্যান্টনমেন্ট পতনের পরে পাক সেনারা পালাতে থাকে। মেজর ইয়মিন ৬ ডিসেম্বর পটুয়াখালী শহর ত্যাগ করে বরিশাল চলে যায়। ৮ ডিসেম্বর নুরুল হুদার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পটুয়াখালী শহর দখল করে। পটুয়াখালীবাসী ২৬ এপ্রিলের বেদনা ভুলে হাজারো কণ্ঠে স্লোগান দিল- জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, জয় পটুয়াখালীর বীর মুক্তিযোদ্ধা।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (দ্বিতীয় খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১৫

          ২। মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মনজুর। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চল। গতিধারা, ঢাকা। ২০১৬