"মীননাথ"-এর বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

Barisalpedia থেকে
("মীননাথ তথা মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নাথপন্থী বৌদ্ধদের আদি গ..." দিয়ে পাতা তৈরি)
 
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত ২টি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
 
মীননাথ তথা মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নাথপন্থী বৌদ্ধদের আদি গুরু। নাথপন্থার চুরাশি সিদ্ধাচার্যের শীর্ষজন। আবার একইসাথে তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ তথা বরিশালের তথা বাংলা ভাষার প্রথম কবি।  
 
মীননাথ তথা মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নাথপন্থী বৌদ্ধদের আদি গুরু। নাথপন্থার চুরাশি সিদ্ধাচার্যের শীর্ষজন। আবার একইসাথে তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ তথা বরিশালের তথা বাংলা ভাষার প্রথম কবি।  
  
== তিব্বতীয় গ্রন্থ অনুসারে তার পরিচিতি ==
+
== তিব্বতীয় গ্রন্থ অনুসারে মীননাথের পরিচিতি ==
  
 
Masters of Mahamudra: Songs and Histories of the Eighty-Four Buddhist Siddhas নামে একখানি মূল্যবান পশ্চিমা বই রয়েছে। বইটি ১৯৮৫ সালে State University of New York Press, Albany থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে নাথপন্থার ৮৪ জন সিদ্ধার জীবন সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। সিদ্ধাগণের জীবন সম্পর্কিত তথ্যের জন্য লেখক ব্যবহার করেছেন তিব্বতীয় ভাষায় লিখিত Grub thob brgyad bcu tsa bzhi’i lo rgyus (Legends of the Eightyfour Mahasiddhas) নামক বইটি। এই বইয়ে চন্দ্রদ্বীপের সন্তান মীননাথের সম্পর্কে  নিচের কথাগুলো লিখিত রয়েছে।
 
Masters of Mahamudra: Songs and Histories of the Eighty-Four Buddhist Siddhas নামে একখানি মূল্যবান পশ্চিমা বই রয়েছে। বইটি ১৯৮৫ সালে State University of New York Press, Albany থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে নাথপন্থার ৮৪ জন সিদ্ধার জীবন সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। সিদ্ধাগণের জীবন সম্পর্কিত তথ্যের জন্য লেখক ব্যবহার করেছেন তিব্বতীয় ভাষায় লিখিত Grub thob brgyad bcu tsa bzhi’i lo rgyus (Legends of the Eightyfour Mahasiddhas) নামক বইটি। এই বইয়ে চন্দ্রদ্বীপের সন্তান মীননাথের সম্পর্কে  নিচের কথাগুলো লিখিত রয়েছে।
১৬ নং লাইন: ১৬ নং লাইন:
 
মীনপা পুরো গল্পটি বললেন। উপস্থিত জনতা তার কাছ থেকে জানলো তিনি কোন রাজার সময়ে মাছের পেটে হারিয়ে গিয়েছিলেন। রাজার নাম জেনে তারা হিসেব করে দেখলো যে তিনি বারো বছর মাছের পেটে ছিলেন। জনতা তাঁর নাম দিলো মীনপা অর্থাৎ ‘মৎস্য-সিদ্ধা’। তারা তাঁকে মাথা নুয়ে প্রণাম জানালো। তারা তাঁকে নৈবেদ্য দিলো। মীনপা যখন মাটির ওপর নাচছিলেন তখন তাঁর পা মাটিতে গেড়ে যাচ্ছিলো। যখন তিনি পাথরের ওপর নাচছিলেন তখনো পাথরে তাঁর পায়ের চিহ্ন খোদাই হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো তাঁর পায়ের নিচে পাথর যেন কাদার মতো। এ ঘটনার ব্যখ্যায় মীনপা গাইলেন: সৌভাগ্য উঠে এসেছে আমার অতীত জীবনের পুণ্য থেকে/ এবং যা শিখেছি তার প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থেকে/ আশ্চর্য এ ক্ষমতা পুণ্যের ফসল/ মানুষের মানস যে কি অমূল্য রত্ন
 
মীনপা পুরো গল্পটি বললেন। উপস্থিত জনতা তার কাছ থেকে জানলো তিনি কোন রাজার সময়ে মাছের পেটে হারিয়ে গিয়েছিলেন। রাজার নাম জেনে তারা হিসেব করে দেখলো যে তিনি বারো বছর মাছের পেটে ছিলেন। জনতা তাঁর নাম দিলো মীনপা অর্থাৎ ‘মৎস্য-সিদ্ধা’। তারা তাঁকে মাথা নুয়ে প্রণাম জানালো। তারা তাঁকে নৈবেদ্য দিলো। মীনপা যখন মাটির ওপর নাচছিলেন তখন তাঁর পা মাটিতে গেড়ে যাচ্ছিলো। যখন তিনি পাথরের ওপর নাচছিলেন তখনো পাথরে তাঁর পায়ের চিহ্ন খোদাই হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো তাঁর পায়ের নিচে পাথর যেন কাদার মতো। এ ঘটনার ব্যখ্যায় মীনপা গাইলেন: সৌভাগ্য উঠে এসেছে আমার অতীত জীবনের পুণ্য থেকে/ এবং যা শিখেছি তার প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থেকে/ আশ্চর্য এ ক্ষমতা পুণ্যের ফসল/ মানুষের মানস যে কি অমূল্য রত্ন
 
মীনপা তাঁর পাঁচশো বছরের পরবর্তী জীবন জুড়ে এ ক্ষমতা মানুষের উপকারেই শুধু ব্যবহার করেছেন। মীনপা আরো দুই নামে পরিচিত: বজ্রপদ ও অচিন্ত্যপা। প্রথমে তিনি অর্জন করেছিলেন অলৌকিক ক্ষমতা, পরে এ পথে আরো অগ্রসর হতে হতে সশরীরে আরোহণ করলেন ডাকিনীর স্বর্গে।
 
মীনপা তাঁর পাঁচশো বছরের পরবর্তী জীবন জুড়ে এ ক্ষমতা মানুষের উপকারেই শুধু ব্যবহার করেছেন। মীনপা আরো দুই নামে পরিচিত: বজ্রপদ ও অচিন্ত্যপা। প্রথমে তিনি অর্জন করেছিলেন অলৌকিক ক্ষমতা, পরে এ পথে আরো অগ্রসর হতে হতে সশরীরে আরোহণ করলেন ডাকিনীর স্বর্গে।
 
  
 
== মীননাথের সাধনা ==
 
== মীননাথের সাধনা ==
২৩ নং লাইন: ২২ নং লাইন:
  
  
== ঐতিহাসিকভাবে মীননাথ ==
+
== ধর্মগুরু মীননাথ ==
  
 
ঐতিহাসিকভাবে মীনপা কে ছিলেন তা নির্ণয় করা কঠিন। যেহেতু মীন কিংবা মৎস্যেন্দ্রনাথ কিংবা মচ্ছেন্দ্রনাথ একই অর্থ দেয় সেহেতু অনুমিত হয় এই তিন নামে একজন সিদ্ধাকেই বোঝায়। তিনি বাঙালি ছিলেন, জেলে ছিলেন, সরাসরি শিবের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছেন, নিজে সাধনা শিখিয়েছেন কামরূপে এবং বিখ্যাত গোরক্ষ তার শিষ্য ছিলেন। এছাড়াও  দেখা যায় গুরু মীননাথ একইসাথে শৈব ও শাক্তদেরও গুরু। এসময় পর্যন্ত সাধনায় শাখা বা গোষ্ঠীবিভেদ ছিল না, ফলে সিদ্ধারা বৌদ্ধ দীক্ষা এবং শাক্তও শৈব দীক্ষা একই সাথে বা একের পর এক গ্রহণ করতে পারতেন। এর ফলে গোত্র পরম্পরায় কিছুটা আধ্যাত্মিক বিনিময় থাকলেও সাধনপন্থা আলাদাই রয়ে গেছে।
 
ঐতিহাসিকভাবে মীনপা কে ছিলেন তা নির্ণয় করা কঠিন। যেহেতু মীন কিংবা মৎস্যেন্দ্রনাথ কিংবা মচ্ছেন্দ্রনাথ একই অর্থ দেয় সেহেতু অনুমিত হয় এই তিন নামে একজন সিদ্ধাকেই বোঝায়। তিনি বাঙালি ছিলেন, জেলে ছিলেন, সরাসরি শিবের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছেন, নিজে সাধনা শিখিয়েছেন কামরূপে এবং বিখ্যাত গোরক্ষ তার শিষ্য ছিলেন। এছাড়াও  দেখা যায় গুরু মীননাথ একইসাথে শৈব ও শাক্তদেরও গুরু। এসময় পর্যন্ত সাধনায় শাখা বা গোষ্ঠীবিভেদ ছিল না, ফলে সিদ্ধারা বৌদ্ধ দীক্ষা এবং শাক্তও শৈব দীক্ষা একই সাথে বা একের পর এক গ্রহণ করতে পারতেন। এর ফলে গোত্র পরম্পরায় কিছুটা আধ্যাত্মিক বিনিময় থাকলেও সাধনপন্থা আলাদাই রয়ে গেছে।
৩১ নং লাইন: ৩০ নং লাইন:
 
তারানাথ তাঁর মীনপা কাহিনিতে কিছু ভিন্ন কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যমতে মহাদেব উমাকে তাঁর ধর্ম শিখাচ্ছিলেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে উমাগিরি নামে এক পাহাড়ে। মীনপা তখন মাছের পেটে নদীতে পাশে এক জায়গায় চুপটি মেরে ছিলেন। মহাদেবের শিক্ষা ছিল মানস-শক্তির (প্রাণ) প্রবাহরূপে। তারপরে অবশ্য তারানাথ তাঁর গল্পে এক জেলেকে নিয়ে আসেন। জেলে উক্ত মাছ ধরে পেট কেটে একটি ছেলে পান। ছেলেটিকে নিয়ে তিনি গুরু চারপাতির কাছে যান। গুরুর দীক্ষায় জেলে পরিণত হন মীনপা রূপে এবং ছেলেটি পরিণত হয় মচ্ছেন্দ্রপা রূপে। মীনপা পরে হালিপা, মালিপা ও তিবোলিপার গুরু হন এবং মচ্ছেন্দ্রপা গোরক্ষ ও চৌরঙ্গীর গুরু রূপে আবির্ভুত হন। হতে পারে এভাবে তারানাথ মীনপা ও মচ্ছেন্দ্রনাথ নামের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।  
 
তারানাথ তাঁর মীনপা কাহিনিতে কিছু ভিন্ন কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যমতে মহাদেব উমাকে তাঁর ধর্ম শিখাচ্ছিলেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে উমাগিরি নামে এক পাহাড়ে। মীনপা তখন মাছের পেটে নদীতে পাশে এক জায়গায় চুপটি মেরে ছিলেন। মহাদেবের শিক্ষা ছিল মানস-শক্তির (প্রাণ) প্রবাহরূপে। তারপরে অবশ্য তারানাথ তাঁর গল্পে এক জেলেকে নিয়ে আসেন। জেলে উক্ত মাছ ধরে পেট কেটে একটি ছেলে পান। ছেলেটিকে নিয়ে তিনি গুরু চারপাতির কাছে যান। গুরুর দীক্ষায় জেলে পরিণত হন মীনপা রূপে এবং ছেলেটি পরিণত হয় মচ্ছেন্দ্রপা রূপে। মীনপা পরে হালিপা, মালিপা ও তিবোলিপার গুরু হন এবং মচ্ছেন্দ্রপা গোরক্ষ ও চৌরঙ্গীর গুরু রূপে আবির্ভুত হন। হতে পারে এভাবে তারানাথ মীনপা ও মচ্ছেন্দ্রনাথ নামের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।  
  
পরবর্তী সময়ের নেপালী পুরাণে দেখা যায় বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি শিবকে যোগ শিখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই মচ্ছেন্দ্ররূপে মানুষের আকারে শুনতে আসলেন শিব তাঁর জ্ঞান উমাকে কিভাবে দিচ্ছেন। এরপর মচ্ছেন্দ্র যখন যোগিনীদের সাথে কামরূপ বা শ্রীলঙ্কা চলে যান তখন নেপালে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাজা জানতেন নেপালের একমাত্র সিদ্ধা মচ্ছেন্দ্রই শুধু ফসলের জন্য বৃষ্টি আনতে পারবেন। তাই তিনি তাঁর এক মন্ত্রী পাঠিয়ে দিলেন মচ্ছেন্দ্রের কাছে। মচ্ছেন্দ্র মন্ত্রীর আর্জি কবুল করলেন। তিনি বললেন তিনি এক মৌমাছি রূপে কিছুদিনেই দেশে যাবেন। সময়মতো এক রাতে তিনি ঠিকই আসলেন। মৌমাছিটি ধরে ফেলা হলো এবং প্রচুর বৃষ্টি হলো। রাজা মন্ত্র দিয়ে তাঁর একটি মূর্তি নির্মাণ করলেন। এটি নেপালের রক্ষার প্রতীকরূপ দেবতা হয়ে গেল। কাঠমা-ু ভ্যালিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরে মচ্ছেন্দ্রনাথের একটি মূর্তি রয়েছে। এমূর্তিকে ‘করুণাময়’, ‘লোকনাথ’, ‘অবলোকিতেশ্বর’ ইত্যাদি নামে পূজো দেয়া হয়। নেপালে আরো বলা হয় মচ্ছেন্দ্র এখানে প্রথম ধানের বীজ আশীর্বাদরূপে দান করেছেন।  
+
পরবর্তী সময়ের নেপালী পুরাণে দেখা যায় বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি শিবকে যোগ শিখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই মচ্ছেন্দ্ররূপে মানুষের আকারে শুনতে আসলেন শিব তাঁর জ্ঞান উমাকে কিভাবে দিচ্ছেন। এরপর মচ্ছেন্দ্র যখন যোগিনীদের সাথে কামরূপ বা শ্রীলঙ্কা চলে যান তখন নেপালে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাজা জানতেন নেপালের একমাত্র সিদ্ধা মচ্ছেন্দ্রই শুধু ফসলের জন্য বৃষ্টি আনতে পারবেন। তাই তিনি তাঁর এক মন্ত্রী পাঠিয়ে দিলেন মচ্ছেন্দ্রের কাছে। মচ্ছেন্দ্র মন্ত্রীর আর্জি কবুল করলেন। তিনি বললেন তিনি এক মৌমাছি রূপে কিছুদিনেই দেশে যাবেন। সময়মতো এক রাতে তিনি ঠিকই আসলেন। মৌমাছিটি ধরে ফেলা হলো এবং প্রচুর বৃষ্টি হলো। রাজা মন্ত্র দিয়ে তাঁর একটি মূর্তি নির্মাণ করলেন। এটি নেপালের রক্ষার প্রতীকরূপ দেবতা হয়ে গেল। কাঠমা-ু ভ্যালিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরে মচ্ছেন্দ্রনাথের একটি মূর্তি রয়েছে। এমূর্তিকে ‘করুণাময়’, ‘লোকনাথ’, ‘অবলোকিতেশ্বর’ ইত্যাদি নামে পূজো দেয়া হয়। নেপালে আরো বলা হয় মচ্ছেন্দ্র এখানে প্রথম ধানের বীজ আশীর্বাদরূপে দান করেছেন। মীনপার প্রধান শিষ্য গোরক্ষ ‘নাথ যোগী সম্প্রদায়’-এর প্রতিষ্ঠাতা গুরু ছিলেন। মীনপা এভাবে নাথ সম্প্রদায়ের আদি মানবগুরু রূপে উপাসিত।
 +
 
 +
 
 +
== ঐতিহাসিভাবে মীননাথ ==
 +
 
 +
ডঃ মুহম্মদ মহীদুল্লাহ অনেক তথ্যের বিশ্লেষণ করে মীননাথকে বাংলা ভাষার প্রথম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মীননাথের আবির্ভাবকাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। ফরাসী পন্ডিত শিলবেইন লেবির মতে, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫৭ খ্রিঃ রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপাল গমন করেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তুলনামূলক ভাষা আলোচনা করে মীননাথকে সপ্তম শতকের কবি বলে মনে করেন। কিন্তু ডঃ প্রবোধ চন্দ্র বাগচী মীননাথকে এগারো শতকের লোক বলেছেন। তাকে পাল রাজা রামপালের (১০৭৭ খ্রিঃ ১১২০ খ্রিঃ) সমসাময়িক মনে করা হয়। বলা হয় তার মূল নাম মীননাথ নাথ গুপ্ত। ‘গোরক্ষ বিজয়ে’ মীননাথের এক জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া যায়- “বদনে জন্মিলে শিব যোগীরূপ ধরি।/ শিবেতে উত্তম জটা শ্রবণেতে কোড়ি॥/ নাভিতে জন্মিল মীনগুরু ধন্বন্তরি।/ সাক্ষাতে সিদ্ধার ভেস অনন্ত মুরারী।”
 +
‘কৌলজ্ঞান নির্ণয়ে’ মীননাথকে ‘চন্দ্রদ্বীপ বিনির্গত’ বলা হয়েছে। কথিত আছে মীননাথ তার পান্ডুলিপিসহ সন্দ্বীপ চলে যান। হয়ত হিন্দুধর্মের অত্যাচারে মীননাথ সন্দ্বীপ হয়ে ময়নামতি এবং পরে নেপালে চলে যান। অনেকে মনে করেন মীননাথ সন্দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু একথা সত্য নয়। ১১শ’ ও ১২শ’ শতকে সন্দ্বীপে বৌদ্ধ সভ্যতার কোন নিদর্শন দেখা যায় না।
  
মীনপার প্রধান শিষ্য গোরক্ষ ‘নাথ যোগী সম্প্রদায়’-এর প্রতিষ্ঠাতা গুরু ছিলেন। মীনপা এভাবে নাথ সম্প্রদায়ের আদি মানবগুরু রূপে উপাসিত। যেহেতু গোরক্ষের বাস ছিল সম্ভবত দশম শতাব্দীতে সেহেতু অনুমিত হয় যে, মীনপার সময়কালটিও দশম শতাব্দী বা নবম শতাব্দীর শেষভাগ।
 
  
 +
----
 
তথ্যসূত্র: ধানসিড়ি। সংখ্যা ৬। বর্ষ  ২০১৩
 
তথ্যসূত্র: ধানসিড়ি। সংখ্যা ৬। বর্ষ  ২০১৩

২৩:৫৩, ৫ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে সম্পাদিত বর্তমান সংস্করণ

মীননাথ তথা মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন নাথপন্থী বৌদ্ধদের আদি গুরু। নাথপন্থার চুরাশি সিদ্ধাচার্যের শীর্ষজন। আবার একইসাথে তিনি ছিলেন চন্দ্রদ্বীপ তথা বরিশালের তথা বাংলা ভাষার প্রথম কবি।

তিব্বতীয় গ্রন্থ অনুসারে মীননাথের পরিচিতি

Masters of Mahamudra: Songs and Histories of the Eighty-Four Buddhist Siddhas নামে একখানি মূল্যবান পশ্চিমা বই রয়েছে। বইটি ১৯৮৫ সালে State University of New York Press, Albany থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। এ বইয়ে নাথপন্থার ৮৪ জন সিদ্ধার জীবন সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। সিদ্ধাগণের জীবন সম্পর্কিত তথ্যের জন্য লেখক ব্যবহার করেছেন তিব্বতীয় ভাষায় লিখিত Grub thob brgyad bcu tsa bzhi’i lo rgyus (Legends of the Eightyfour Mahasiddhas) নামক বইটি। এই বইয়ে চন্দ্রদ্বীপের সন্তান মীননাথের সম্পর্কে নিচের কথাগুলো লিখিত রয়েছে।

মীননাথ তথা মীনপা ছিলেন এক বাঙ্গালি জেলে বা ধীবর। তার গুরু ছিলেন স্বয়ং মহাদেব। তিনি অর্জন করেছিলেন সিদ্ধি অর্থাৎ এক জাদুর ন্যায় শক্তি। কামরূপ থেকে কাছেই বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে তিনি মাছ ধরতেন এবং অন্য জেলেদের সাথে সে মাছ বিক্রি করতেন কাছের কোনো বাজারে। একদিন তিনি বড়শিতে মাংস গেথে ফেললেন সমুদ্রে। বড়শি গিললো এক বিশাল মাছ। কিশাল দৈত্যাকার মাছ টেনে নিলো বড়শিওয়ালাকে এবং গিলে ফেললো তাকেও। কিন্তু বড়শিওয়ালা মীনপার কর্মনির্ধারিত জীবন ছিল অনেক দীর্ঘ। যেহেতু সে জীবন তার এখনই শেষ হওয়ার নয় সেহেতু তার জীবন চলতে থাকলো মাছের উদরেই। এ সময় মহাদেবের স্বগীয় স্ত্রী উমাদেবী স্বামীর কাছে শিখতে চাইলো তাঁর ধর্ম। মহাদেব চাচ্ছিলেন না এই জিনিস তিনি এমন কোনো জায়গায় বসে শেখান যেখানে অন্য কেউ শুনে ফেলতে পারে এবং শিখে ফেলতে পারে তাঁর চর্চা। ফলে সাগরের তলে উমা একটি ঘর বানালেন এবং মহাদেব সেখানে তাঁর পাঠদান শুরু করলেন।

মীনপা যে মাছের পেটে আটকা ছিলেন ঘটনাক্রমে সে মাছটি মহাদেবও উমার সাগরতলের বাড়ির পাশেই বিশ্রাম নিচ্ছিলো। ফলে বাঙ্গালি নবী ইউনুস বা জোনাহ মাছের পেটে বসে নিশ্চিন্ত পেয়ে গেলেন উমাকে দেয়া মহাদেবের সকল শিক্ষা। উমার যখন শুনতে শুনতে তন্দ্রা পাচ্ছিলো মহাদেব জানতে চাচ্ছিলেন উমা জেগে আছে কিনা। মীনপা মাছের পেটে বসে বলে দিলেন তিনি সজাগ আছেন। মহাদেব বুঝলেন উত্তরটি উমাই দিয়েছিলেন এবং তিনি তাঁর পুরো পাঠদান শেষ করলেন। মহাদেবের টাঠদান শেষ হলো, উমা জেগে উঠলেন এবং বললেন ‘আমি জেগে উঠেছি, এবার আবার বলো’। মহাদেব আবাক হয়ে বললেন ‘আমি তো সব বলে ফেলেছি’। উমা বললেন ‘আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম’। ‘তাহলে কে আমার প্রশ্নে কে উত্তর দিয়েছিল?’ মহাদবে জানতে চাইলেন। ‘আমি জানি না, আমি কোনো উত্তর দেইনি’ উমা বললেন। এবার মহাদেব তাঁর তৃতীয় নেত্র উন্মীলন করলেন এবং দেখলেন মাছের পেটে শুয়ে আছে মীনপা। ‘অবশ্যই এই লোকটি এখন আমার শিষ্য’ ভাবলেন মহাদেব, ‘তাকে দীক্ষা দিতে হবে’।

মীনপা দীক্ষা নিলেন এবং বারো বছর মাছের পেটে সাধনা করলেন। বারো বছর শেষে শ্রী তাপরী নামে এক জেলে ধরলেন মীনপাকে পেটে আটকে রাখা মাছটি। মাছের অত্যধিক ওজন দেখে ভাবলেন পেটে সোনারূপা কিছু একটা হবে। এই ভেবে বাড়ি এনে মাছের পেট কাটলেন। ভিতর থেকে বের হলেন মীনপা। ‘তুমি কে?’ তাপরী ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলো।

মীনপা পুরো গল্পটি বললেন। উপস্থিত জনতা তার কাছ থেকে জানলো তিনি কোন রাজার সময়ে মাছের পেটে হারিয়ে গিয়েছিলেন। রাজার নাম জেনে তারা হিসেব করে দেখলো যে তিনি বারো বছর মাছের পেটে ছিলেন। জনতা তাঁর নাম দিলো মীনপা অর্থাৎ ‘মৎস্য-সিদ্ধা’। তারা তাঁকে মাথা নুয়ে প্রণাম জানালো। তারা তাঁকে নৈবেদ্য দিলো। মীনপা যখন মাটির ওপর নাচছিলেন তখন তাঁর পা মাটিতে গেড়ে যাচ্ছিলো। যখন তিনি পাথরের ওপর নাচছিলেন তখনো পাথরে তাঁর পায়ের চিহ্ন খোদাই হয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো তাঁর পায়ের নিচে পাথর যেন কাদার মতো। এ ঘটনার ব্যখ্যায় মীনপা গাইলেন: সৌভাগ্য উঠে এসেছে আমার অতীত জীবনের পুণ্য থেকে/ এবং যা শিখেছি তার প্রতি নিষ্ঠা ও একাগ্রতা থেকে/ আশ্চর্য এ ক্ষমতা পুণ্যের ফসল/ মানুষের মানস যে কি অমূল্য রত্ন মীনপা তাঁর পাঁচশো বছরের পরবর্তী জীবন জুড়ে এ ক্ষমতা মানুষের উপকারেই শুধু ব্যবহার করেছেন। মীনপা আরো দুই নামে পরিচিত: বজ্রপদ ও অচিন্ত্যপা। প্রথমে তিনি অর্জন করেছিলেন অলৌকিক ক্ষমতা, পরে এ পথে আরো অগ্রসর হতে হতে সশরীরে আরোহণ করলেন ডাকিনীর স্বর্গে।

মীননাথের সাধনা

উমার উদ্দেশ্যে মহাদেবের শিক্ষাটি কী ছিল? আর সেখান থেকে মীনপা কী শিখলেন? পুরোটিই চিন্তা বা দার্শনিক অনুধ্যানের বিষয়। মীনপার কাহিনি বলে যে, শিষ্যের শিক্ষাগ্রহণে উদ্যোগ ও সফলতা অনেকটাই একটি দৈব ও ভাগ্যপ্রসুত বিষয়। কিন্তু ভারতীয় ও তিব্বতীয়দের মাঝে দৈব বা ভাগ্যপ্রসুত বিষয়ের অস্তিত্ব দুর্লভ। এই দুই সমাজেই বিশ্বাস করা হয় মানুষের জীবনের প্রতিটি ঘটনা অতীতের কোনো কর্মের ফল। হতে পারে কোটি কোটি বছরেরও আগের কোনো ঘটনার ফল হিসেবে আজকের ঘটনাটি ঘটতে পারে। সমুদ্রের মৎস্য আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত (কোরাণ ও বাইবেল দুই জায়গায়ই ইউনুস [আঃ] বা জোনার কাহিনি প্রচলিত আছে)। এই পটভূমিতে মীনপার মাছের পেটে বেঁচে থাকার বিষয়টি অতীতের পুণ্যে বর্তমানের সৌভাগ্য। তাঁর একটি পুণ্যের শরীর থাকার সুবাদে তিনি দেখছেন গুরু নিজেই তাঁকে দীক্ষায় টেনে নিয়েছেন। মীনপার সৌভাগ্য এই বিশ্বব্রহ্মা-রূপ সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা এক আংটির সন্ধানে সফল হয়ে আধ্যাত্মিক আলো অর্জন করে তিনি ফিরে এসেছেন আবার পাড়ে- জীবনে। দশ বছরের সাধনায় তার তরলে (পানিতে) যাপিত অনিশ্চয়তার জীবন শেষ। মাছ থেকে বের হয়ে আসা মানুষ অর্থাৎ মৎস্য-মানুষ রূপেও রয়েছে প্রতীকী অর্থ। মাছের সাতার শ্রমহীন অর্থাৎ আয়াসহীন, মাছের ঘুম নেই- তন্দ্রা নেই, সে পানিতে থাকে কিন্তু পানি তাকে ভেজায় না, কখনো শ্রমে ঘেমে খাবার খুঁজে ফেরে না অথচ অভুক্তও থাকে না, জীবনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বাঁচতে হয় না এবং কারোর সাথে সংঘর্ষে-সংগ্রামেও লিপ্ত হতে হয় না। এই হলো মাছের জীবন এবং তিব্বতীয়দের কাছে এই মাছ পবিত্রতার প্রতীক। সাধনায় এমন জীবনই আরাধ্য। ফলত মৎস্য-প্রভু বা সমার্থক নামে মৎস্যেন্দ্রনাথ কিংবা মচ্ছেন্দ্রনাথ হতে পারে যোগসাধনায় সিদ্ধ যেকোনো সাধক ‘অবধূতি’ কিংবা ‘অচিন্ত্যপা’র উপাধি।


ধর্মগুরু মীননাথ

ঐতিহাসিকভাবে মীনপা কে ছিলেন তা নির্ণয় করা কঠিন। যেহেতু মীন কিংবা মৎস্যেন্দ্রনাথ কিংবা মচ্ছেন্দ্রনাথ একই অর্থ দেয় সেহেতু অনুমিত হয় এই তিন নামে একজন সিদ্ধাকেই বোঝায়। তিনি বাঙালি ছিলেন, জেলে ছিলেন, সরাসরি শিবের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছেন, নিজে সাধনা শিখিয়েছেন কামরূপে এবং বিখ্যাত গোরক্ষ তার শিষ্য ছিলেন। এছাড়াও দেখা যায় গুরু মীননাথ একইসাথে শৈব ও শাক্তদেরও গুরু। এসময় পর্যন্ত সাধনায় শাখা বা গোষ্ঠীবিভেদ ছিল না, ফলে সিদ্ধারা বৌদ্ধ দীক্ষা এবং শাক্তও শৈব দীক্ষা একই সাথে বা একের পর এক গ্রহণ করতে পারতেন। এর ফলে গোত্র পরম্পরায় কিছুটা আধ্যাত্মিক বিনিময় থাকলেও সাধনপন্থা আলাদাই রয়ে গেছে।

বঙ্গে মচ্ছেন্দ্র ছিলেন ‘কৌল’, ‘নাথ’ ও ‘কানফাটা’ যোগীদের আদি গুরু। বাঁহাতি বাঙ্গালি ‘শাক্ত’ যাদেরকে ‘যোগিনী-কৌল’ অথবা ‘সাধনামৃত’ বলা হয় তারা মীন বা মচ্ছেন্দ্রকে ‘ভৈরব-শিব’ নামে তাদের আদি গুরু হিসেবে জানে। তাদের গ্রন্থ ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’-এ বর্ণিত আছে সেই ধর্ম যা মহাদেব উমাকে শিখিয়েছিলেন। ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’-এ বলা আছে যে মচ্ছেন্দ্র এটা শিখেছিলেন। তবে মহাদেব যে এই জ্ঞান উমার অনুরোধে উমাকে বিতরণ করেছিলেন তা ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’-এ বলা নেই। অন্য এক কাহিনিতে আছে মহাদেবের ছেলে কার্তিক ইঁদুর রূপে এই জ্ঞান চুরি করেছিলেন এবং সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। মচ্ছেন্দ্র সাগর থেকে উহা উদ্ধার করেন। ‘শক্তি’র পথ ‘কৌল-মার্গ’এর গন্তব্য বা লক্ষ্য হলো ‘কূল’ (শক্তি) ও ‘অকূল’ (শিব) এর মিলন। এই গন্তব্যে পৌঁছা যায় যোগিনীদের আচার সহযোগিতায়।

তারানাথ তাঁর মীনপা কাহিনিতে কিছু ভিন্ন কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যমতে মহাদেব উমাকে তাঁর ধর্ম শিখাচ্ছিলেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে উমাগিরি নামে এক পাহাড়ে। মীনপা তখন মাছের পেটে নদীতে পাশে এক জায়গায় চুপটি মেরে ছিলেন। মহাদেবের শিক্ষা ছিল মানস-শক্তির (প্রাণ) প্রবাহরূপে। তারপরে অবশ্য তারানাথ তাঁর গল্পে এক জেলেকে নিয়ে আসেন। জেলে উক্ত মাছ ধরে পেট কেটে একটি ছেলে পান। ছেলেটিকে নিয়ে তিনি গুরু চারপাতির কাছে যান। গুরুর দীক্ষায় জেলে পরিণত হন মীনপা রূপে এবং ছেলেটি পরিণত হয় মচ্ছেন্দ্রপা রূপে। মীনপা পরে হালিপা, মালিপা ও তিবোলিপার গুরু হন এবং মচ্ছেন্দ্রপা গোরক্ষ ও চৌরঙ্গীর গুরু রূপে আবির্ভুত হন। হতে পারে এভাবে তারানাথ মীনপা ও মচ্ছেন্দ্রনাথ নামের ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন।

পরবর্তী সময়ের নেপালী পুরাণে দেখা যায় বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি শিবকে যোগ শিখিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই মচ্ছেন্দ্ররূপে মানুষের আকারে শুনতে আসলেন শিব তাঁর জ্ঞান উমাকে কিভাবে দিচ্ছেন। এরপর মচ্ছেন্দ্র যখন যোগিনীদের সাথে কামরূপ বা শ্রীলঙ্কা চলে যান তখন নেপালে এক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। রাজা জানতেন নেপালের একমাত্র সিদ্ধা মচ্ছেন্দ্রই শুধু ফসলের জন্য বৃষ্টি আনতে পারবেন। তাই তিনি তাঁর এক মন্ত্রী পাঠিয়ে দিলেন মচ্ছেন্দ্রের কাছে। মচ্ছেন্দ্র মন্ত্রীর আর্জি কবুল করলেন। তিনি বললেন তিনি এক মৌমাছি রূপে কিছুদিনেই দেশে যাবেন। সময়মতো এক রাতে তিনি ঠিকই আসলেন। মৌমাছিটি ধরে ফেলা হলো এবং প্রচুর বৃষ্টি হলো। রাজা মন্ত্র দিয়ে তাঁর একটি মূর্তি নির্মাণ করলেন। এটি নেপালের রক্ষার প্রতীকরূপ দেবতা হয়ে গেল। কাঠমা-ু ভ্যালিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরে মচ্ছেন্দ্রনাথের একটি মূর্তি রয়েছে। এমূর্তিকে ‘করুণাময়’, ‘লোকনাথ’, ‘অবলোকিতেশ্বর’ ইত্যাদি নামে পূজো দেয়া হয়। নেপালে আরো বলা হয় মচ্ছেন্দ্র এখানে প্রথম ধানের বীজ আশীর্বাদরূপে দান করেছেন। মীনপার প্রধান শিষ্য গোরক্ষ ‘নাথ যোগী সম্প্রদায়’-এর প্রতিষ্ঠাতা গুরু ছিলেন। মীনপা এভাবে নাথ সম্প্রদায়ের আদি মানবগুরু রূপে উপাসিত।


ঐতিহাসিভাবে মীননাথ

ডঃ মুহম্মদ মহীদুল্লাহ অনেক তথ্যের বিশ্লেষণ করে মীননাথকে বাংলা ভাষার প্রথম কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। মীননাথের আবির্ভাবকাল নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। ফরাসী পন্ডিত শিলবেইন লেবির মতে, মৎস্যেন্দ্রনাথ ৬৫৭ খ্রিঃ রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপাল গমন করেন। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তুলনামূলক ভাষা আলোচনা করে মীননাথকে সপ্তম শতকের কবি বলে মনে করেন। কিন্তু ডঃ প্রবোধ চন্দ্র বাগচী মীননাথকে এগারো শতকের লোক বলেছেন। তাকে পাল রাজা রামপালের (১০৭৭ খ্রিঃ ১১২০ খ্রিঃ) সমসাময়িক মনে করা হয়। বলা হয় তার মূল নাম মীননাথ নাথ গুপ্ত। ‘গোরক্ষ বিজয়ে’ মীননাথের এক জন্মবৃত্তান্ত পাওয়া যায়- “বদনে জন্মিলে শিব যোগীরূপ ধরি।/ শিবেতে উত্তম জটা শ্রবণেতে কোড়ি॥/ নাভিতে জন্মিল মীনগুরু ধন্বন্তরি।/ সাক্ষাতে সিদ্ধার ভেস অনন্ত মুরারী।” ‘কৌলজ্ঞান নির্ণয়ে’ মীননাথকে ‘চন্দ্রদ্বীপ বিনির্গত’ বলা হয়েছে। কথিত আছে মীননাথ তার পান্ডুলিপিসহ সন্দ্বীপ চলে যান। হয়ত হিন্দুধর্মের অত্যাচারে মীননাথ সন্দ্বীপ হয়ে ময়নামতি এবং পরে নেপালে চলে যান। অনেকে মনে করেন মীননাথ সন্দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু একথা সত্য নয়। ১১শ’ ও ১২শ’ শতকে সন্দ্বীপে বৌদ্ধ সভ্যতার কোন নিদর্শন দেখা যায় না।



তথ্যসূত্র: ধানসিড়ি। সংখ্যা ৬। বর্ষ ২০১৩