মহেন্দ্রনাথ দত্ত

Barisalpedia থেকে

মুদ্রণশিল্পের ক্ষেত্রে এবং পুস্তক প্রকাশনার জগতে খ্যাতনামা ব্যক্তি, পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত প্রকাশনাসংস্থা ‘সাহিত্য সংসদ’ এর প্রতিষ্ঠাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম (২.৮.১৮৯৯-১৮.১০.১৯৮৭) বরিশাল সদরের কাশীপুর গ্রাম। পিতা রাজকুমার দত্ত; মাতা জ্ঞানদা দেবী।


শিক্ষা

মহেন্দ্রনাথ এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বরিশালে রায়পাশা গ্রামের (মাতুলালয়) পাঠশালায়। পরে লোকের বাড়িতে থেকে এবং ছাত্র পড়িয়ে কলসকাঠি গ্রামের স্কুল থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আই.এ. পড়ার সময় ১৭.১২.১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স অফ ওয়েল্স-এর ভারতবর্ষে আগমনের বিরুদ্ধে ‘কালা দিবস’ পালনকালে অপর চারজন যুবকের সঙ্গে তিনি ব্রিটিশ পতাকা ‘ইউনিয়ন জ্যাক’ পুড়িয়ে চোদ্দো মাস সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করেন। তার আগে স্বরাজ অফিসের (তদানীন্তন কংগ্রেস অফিস) হযে রাজনৈতিক বই বিক্রি করতেন।

কর্মজীবন

১৯২৩ খৃস্টাব্দে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কর্পদকশূন্য অবস্থায় পড়েন। লোকের বাড়ি বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করার একটি অস্থায়ী কাজ জোটালেন। এসময় সরস্বতী লাইব্রেরির অন্যতম মালিক অরুণচন্দ্র গুহ বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য কলকাতায় একটি ছাপাখানা স্থাপনের চেষ্টায় কর্মীর সন্ধান করছিলেন। তাঁর সঙ্গে মহেন্দ্রনাথের যোগাযোগের ফলে কুড়ি দিনের মধ্যে তিনি বরিশালের ‘হিতৈষী’ প্রেসে কম্পোজিং-এর কাজ শিখে কলকাতার নির্দিষ্ট মেসবাড়িতে এসে ওঠেন। ২৬/১ বেনিয়াটোলা লেনের সেই মেসবাড়িতে পরবর্তীকালের শহিদ গোপীনাথ সাহা ও অনুজা সেনের সঙ্গে তিনি এক ঘরে থাকতেন।

শ্রীসরস্বতী প্রেস প্রতিষ্ঠা

মে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রী সরস্বতী প্রেস শুরু হলে তিনি একাই কম্পোজিটর, মেসিনম্যান, ঝাড়ুদার, বেয়ারা এবং ‘ম্যানেজার’-এর কাজ করতে থাকেন। প্রেসের তিনজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে শৈলেন্দ্রনাথ গুহরায় বাদে অরুণচন্দ্র গুহ এবং মনোরঞ্জন গুপ্ত দু-জনেরই বিপ্লবী কাজের জন্য অধিকাংশ সময় অন্যত্র বা কারাগারে কাটত। ফলে প্রেস চালানোর দায়িত্ব প্রধানত মহেন্দ্রনাথকেই পালন করতে হত। বিশের ও তিরিশের দশকে ব্রিটিশ সরকার বহুবার এই প্রেসে তল্লাশি চালিয়েছে, জামানত বাজেয়াপ্ত করেছে, ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে একবার এই প্রেস বন্ধও করে দিয়েছিল। কিন্তু মহেন্দ্রনাথের তৎপরতায় প্রেস আবার চালু হয়েছে, রাতারাতি প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলির ব্যবস্থা হয়েছে। তিনিই ছিলেন সকলের যোগাযোগের মাধ্যম। জানুয়ারি ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তর করে ছ-বছর আলিপুর সেন্ট্রাল জেল, বক্সা ও দেউলি ক্যাম্পে আটক রাখে। শেষের এক বছর তিনি গ্রামের বাড়িতে অন্তরীন ছিলেন। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে ছাড়া পেয়ে তিনি আবার শ্রীসরস্বতী প্রেসের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এসময় থেকে বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ অটুট থাকলেও সক্রিয় রাজনীতির সাথে তিনি নিযুক্ত হননি। শ্রীসরস্বতী প্রেসের ‘ম্যানেজারবাবু’ নামেই তাঁর পরিচিতি ছিল শেষ পর্যন্ত। এমনকী ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রেস থেকে অবসরগ্রহণের পরেও। প্রকাশনাজগতে তাঁর খ্যাতির সূত্রপাত ‘ছড়ার ছবি’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে এক বছরের মধ্যে প্রকাশিত রংচঙে ছবি-সহ ছন্দময় ছড়ার তিনখানি বই শিশু ও অভিভাবকমহলে বিপুল সাড়া জাগায়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘শিশু সাহিত্য সংসদ’ নাম দিয়ে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ এবং ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রদর্শন’ বই দু-খানি প্রকাশ করেন। সাহিত্য সংসদের ধ্রুপদি পর্যায়ের প্রথম গ্রন্থ ‘বঙ্কিমম রচনাবলী ১ম খন্ড’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে এবং অভিধান পর্যায়ের প্রথম বই ‘সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’ (১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে)। ৮৩ বছর বয়সে ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশনার উদ্দেশ্যে নিজ বাসভবনে ‘শ্রীকৃষ্ণ নিবাস’- এ তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণ প্রকাশনী’ স্থাপন করেন। সেখান থেকে প্রকাশিত হয় বাংলা ও ইংরেজিতে ‘স্বামী প্রেমানন্দতীর্থ- জীবন ও বাণী’ (১৯৮৪) এবং তাঁর নিজের লেখা বই ‘লাইফ অ্যান্ড মিশন অফ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী’ (১৯৮৪)। জনকল্যানমূলক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে নিজের বাড়িতে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। জনসেবামূলক বিভিন্ন কাজের জন্য তিনি তাঁর আয়ের যাবতীয় অর্থ দিয়ে ট্রাস্ট গঠন করে দিয়েছেন।


তথ্যসূত্র: সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (২য় খন্ড)।