মহাত্মা গান্ধী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলীর বরিশালে আগমন

Barisalpedia থেকে

মহাত্মা গান্ধী দুইবার ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী একবার বরিশাল এসেছিলেন।


১৯২১ খৃৃস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর আসতে না পারা

মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র বরিশালে ১৯২১ খৃৃস্টাব্দে এপ্রিলের প্রাদেশিক সম্মেলনে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু তখন তিনি না আসতে পেরে বাণী পাঠিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, “আমি নিশ্চয় বরিশালে যাবো। তবে এ সময়ে সম্ভবপর হলো না। আমি কিন্তু বরিশালের জন্য কিছুমাত্র চিন্তিত নই। কারণ যখন সমস্ত ভারত গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন ছিল, তখনও বরিশাল সদা জাগ্রত- (When India was deep asleep, Barisal was wide awake)।


মহাত্মা গান্ধীর ১ম বার বরিশাল আগমন

মহাত্মা গান্ধীর ১ম বরিশাল আগমন সম্বন্ধে দুর্গা মোহন সেন তার স্মৃতিকথায় বরিশাল হিতৈষী পত্রিকায় লিখেছেন যে, ১৩২৮ সনের ২২ ভাদ্র বুধবার বিকেল ৪টায় স্টীমারে মহাত্মা গান্ধীর বরিশাল আগমনের কথা। স্বরাজ সেবক, শান্তি সেনা, স্বেচ্ছাসেবক প্রভৃতি ১৭০০ স্বেচ্ছাসেবক ও হাজার হাজার লোক ষ্টীমার ঘাটে মহাত্মা গান্ধী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত। ষ্টীমার তিনটায় পৌঁছল। মহাত্মা গান্ধী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলী প্রথমবার বরিশালের মাটিতে অবতরণ করলেন। তাঁরা শহর প্রদক্ষিণ করে পুলিশ লাইনের নিকট জমিদার বিহারী লাল রায়ের বাড়ি গেলেন (বর্তমান ‘হোসেন ভিলা’)। সেখান থেকে অসুস্থ অশ্বিনীকুমার দত্তকে দেখে সভাস্থলে যান। ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিরাট মঞ্চ। জেলার দূর-দূরান্ত হতে হাজার হাজার লোক এসেছে। বাকেরগঞ্জ জেলাবাসীর পক্ষ হতে গান্ধী ও মুহাম্মদ আলীকে অভিনন্দনপত্র দেয়া হলো। মহাত্মা গান্ধী তাঁর বক্তৃতায় বললেন, আমি দাঁড়িয়ে বলতে অসমর্থ, অতএব আমি বসে বলতেছি। তিনি অশ্বিনীকুমারের অসুস্থতার, শরৎ কুমার ঘোষের কারাভোগের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। “তাঁর আবার জেল হয়েছে। সেজন্য আমার দুঃখ নেই। সরকার তাঁকে হোটেলে ডেকে নিয়েছে। এ সভায় তিনি উপস্থিত হতে পারেননি বলে আমার দুঃখ। আপনাদের আকাক্সিক্ষত স্বরাজ লাভ, খেলাফত উদ্ধার ও পাঞ্জাবের অত্যাচারের প্রতিকার করতে হলে তিনটি শর্র্ত পালন করতে হবে। প্রথম, হিন্দু-মুসলমানদের একতা। বাহ্যিক একতা নহে। হিংসা-বিদ্বেষ শূন্য হয়ে পবিত্র খোদাতায়ালার নামে মনেপ্রাণে মিলই প্রকৃত মিলন। এরূপ মিলন না হলে আপনারা ঔপনিবেশিক স্বরাজের অধীন হবেন। প্রকৃত স্বরাজ পাবেন না। দ্বিতীয়ত, শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলন, খেলাফত ও কংগ্রেস সেরূপ প্রতিজ্ঞা করেছে। ভগবান না করুন আলী ভ্রাতৃদ্বয় জেলে গেলেও কোন প্রকারে শান্তি ভঙ্গ করবেন না। কোন রকম শান্তি ভঙ্গ হলে আমাদেরই ক্ষতি, গভর্নমেন্ট অত্যাচারের সুযোগ পাবে। তৃতীয়ত, স্বদেশী গ্রহণ। বিদেশী সুতায় তৈরি কাপড়ও স্বদেশী নয়। আপনার দেশী তুলা হতে ভাই, ভগ্নি, মাতা, পিতা কর্তৃক সুতা প্রস্তুত করে নিজ তাঁতে তৈরি কাপড়ই পবিত্র এবং তাই স্বদেশী কাপড়। এটা যে পর্যন্ত না হবে সে পর্যন্ত স্বরাজ লাভ হবে না।”

প্রশ্নোত্তরে বলেন- “অন্যকে পীড়ন করার জন্য অথবা ব্যক্তিবিশেষের অর্থ লাভের জন্য কোনরুপ ধর্মঘাট আমি আদৌ পছন্দ করি না।”

হরতাল সম্পর্কে বলেন- “সরকারী কর্মচারী ও বিরুদ্ধবাদীদের কষ্ট দেয়ার উদ্দেশ্যে কখনও হরতাল করবেন না। কোন নেতাকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে বা শোক প্রকাশের জন্য আমি হরতাল চাই না। জেলকে ভয় করি না। সে তো সরকারী হোটেল। প্রত্যেককে প্রবিত্র ও নির্দোষ হতে হবে। যে জেলে গেলে বা মরলে দেশ উদ্ধার হয়, তার জন্য হরতাল করা নিষিদ্ধ। শরৎ কুমারের জেলের জন্য আমি দুঃখিত নই, তাঁর অনুপস্থিতির জন্য আমি দুঃখিত। পৌরসভার মেয়র ও জলের কল বন্ধের জন্য আপনাদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। শরৎ বাবু জেলে যাবার সময় আলো বন্ধ করতে কলেছেন এ কথা আমি বিশ্বাস করি না।”


মাওলানা মুহাম্মদ আলীর বরিশালে বক্তৃতা

মহাত্মা গান্ধীর বক্তৃতার পর মাওলানা মুহাম্মদ আলী বরিশালের জনসভায় বক্তৃতা দেন। গান্ধীর হিন্দী ও মাওলানা মুহাম্মদ আলীর উর্দু বক্তৃতা খান বাহাদুর হাশেম আলী খান বঙ্গানুবাদ করে সভায় উপস্থিত জনগনকে মোহিত করেন। ভারতের দুই বিখ্যাত জননেতার আগমনে বরিশালবাসী ধন্য হলো। তাঁরা জনগণের মধ্যে জাগরণ দেখে আনন্দিত হলেন। নেতাদ্বয় বিহারীলাল রায়ের বাড়িতে অবস্থান করেন। মহাত্মা গান্ধী যে খাটে ঘুমিয়েছিলেন, সে খাট বছর বিশেক পূর্বে হস্তচ্যুত হয়েছে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর সকালে গান্ধী ও মুহাম্মদ আলী অসুস্থঅশ্বিনী কুমার দত্তের সাথে বাসভবনে ছাতিমতলায় আধঘন্টা ধরে আলাপ করেন। ঐদিন সকালে তিনি ষ্টীমারে বরিশাল ত্যাগ করেন। পথে ঝালকাঠি বন্দরে মহাত্মা গান্ধী ও মুহাম্মদ আলী উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন।

মহাত্মা গান্ধীর ২য় বার বরিশাল আগমন

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুন মহাত্মা গান্ধী ষ্টীমার যোগে দ্বিতীয় বার বরিশাল আগমন করেন। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন শরৎ গুপ্ত এবং সম্পাদক হলেন সতীন্দ্রনাথ সেন। তিনি বরিশালের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করেন এবং জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান। তিনি খান বাহাদুর হাশেম আলী খানের বাসায় অবস্থান করেন এবং ১৫ জুন ষ্টীমার যোগে কলকাতা চলে যান। ঐদিনই বরিশালে খবর এলো যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ দার্জিলিংয়ে দেহ ত্যাগ করেছেন।


তথ্যসূত্র: ১। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। বরিশাল বিভাগের ইতিহাস (১ম খন্ড)। ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা। ২০১০।