মনোহর মুখোপাধ্যায়

Barisalpedia থেকে

স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী মনোহর মুখোপাধ্যায়ের (৩০.৪.১৯০৩- ৮.৮.২০০৩) আদি নিবাস গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া গ্রামে। পিতা প্রসন্নকুমার; মাতা হেমাঙ্গিনী।

১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে নলচিড়া হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনন্তকুমার সেনগুপ্ত (‘স্বরাজ গীতা’র লেখক) এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক অনন্তপ্রসাদ সেনগুপ্তের প্রেরণায় কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে তিনি ‘বিবেক সমিতি’ (পরবর্তীকালের ‘বিবেক আশ্রম’) নামে একটি সমাজসেবা এবং রাজনৈতিক কাজের কেন্দ্র গড়ে তোলেন। বিপ্লবীদের সহকর্মী সন্তোষ কুমারদে-র মাধ্যমে তিনি ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে যুগান্তর বিপ্লবী দলের ‘শঙ্কর মঠ’ শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে উজিরপুরে এক বিলেতি কাপড়ের দোকানে পিকেটিং করতে গিয়ে তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। ১৯২২ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত পটুয়াখালি জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এ সময় তিনি পটুয়াখালির জনপ্রিয় নেতা সতীন সেনের আন্দোলনে তাঁর সঙ্গী ছিলেন। ওই সময়ই তিনি ‘গৌড় সর্ব বিদ্যায়তন’ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অপরাধে তাঁর ৬ মাসের কারাদন্ড হয়। মুক্তির পর দলের নির্দেশে ওই বছরই উত্তরবঙ্গের যুগান্তর দলের নেতা উপেন রায়ের সঙ্গে কাজ করার জন্য দেরাদুন যান। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ডা. সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবস্থাপনায় তিনি ‘অল ইন্ডিয়া স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনে’র কাজে নিযুক্ত হন। পরে তিনি ঢাকায় ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদকপদে নির্বাচিত হন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশন ও ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোর কংগ্রেস অধিবেশনে নির্বাচিত ডেলিগেট হিসেবে যোগ দেন। ঢাকা জেলা সেলিব্রেশন কমিটির সম্পাদকরূপে তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের ব্যবস্থা করায় তার দেড়মাসের কারাদন্ড হয়। ঢাকা জেলায় আইন অমান্য আন্দোলনে তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। মেছুয়াবাজার বোমা মামলায় অভিযুক্ত আত্মগোপনকারীদের এবং চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় অভিযুক্ত আত্মগোপনকারীদের আশ্রয়দানের ব্যবস্থা করেন। সংগ্রাম আরম্ভ করার জন্য তাঁকে হাত বোমা পাঠানো হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সংগ্রাম আরম্ভ করার সংকেত আসার আগেই ২৩ আগস্ট ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘বেঙ্গল অর্ডন্যান্স’ আইনে গ্রেপ্তার হন। বিভিন্ন জেলে প্রায় আটবছর বন্দিজীবন কাটান। হিজলী বন্দিশিবিরে পুলিশের গুলিতে সন্তোষ মিত্র এবং তারকেশ্বর সেন নিহত ও কুড়ি জন আহত হন। এই বিষয়ে মামলা শুরু হলে বন্দিদের পক্ষীয় ব্যারিস্টারদের সাহায্য করার জন্য তিনি বন্দিদের প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ১৯৪২-এর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও তাঁদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার অভিযোগে তাঁকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ডি.এম.ডি.আই. অ্যাক্টে ১৮ মাসের জন্য ঢাকা থেকে বহিস্কার করা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা হস্তান্তরের কিছু আগে তাঁর গ্রেপ্তার হবার সম্ভাবনার খবর শুনে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির দ্বারা তিনি ক্রেডেনসিয়েল কমিটির চেয়ারম্যান এবং দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস কমিটির ইলেকশন ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে উদবাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গে প্রবশে করতে থাকেন। এ সময় শিয়ালদহ স্টেশনে বি.পি.সি.সি.-র ক্যাম্প রিলিফ সেন্টারের ভার তাঁর উপর ন্যস্ত ছিল। পঞ্চাশটির বেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তখন শিয়ালদহ স্টেশনে কাজ করছিল। তাদের কনভেনার ছিলেন তিনি। অত্যধিক পরিশ্রমে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। বন্ধুজনের সাহায্যে তাঁর চিকিৎসা চলে এবং তাঁর জীবিকার জন্য উইমকোর চিফ টিম্বর অফিসার তাঁকে ফ্যাক্টরির জন্য কাঠ সাপ্লাইয়ের একটা কন্ট্রাক্ট জোগাড় করে দেন। তিনি এই কাজে সিংভূমের গোয়েলাকরোয় প্রায় ১১ বছর ছিলেন। সেখানে হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক তিনি আদিবাসীদের উন্নতি করার কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন। কলকাতার কসবায় বসবাসকালে স্থানীয় নানা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখিকা সুরুচি চক্রবর্তী তাঁর স্ত্রী।

তথ্যসূত্র: সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান